মোংলা বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব চায় ভারত
ভারত এবার বাংলাদেশের দ্বিতীয়-সমুদ্র বন্দর মোংলা পরিচালনার দায়িত্ব চায়। ইতোমধ্যে স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে কার্গো পরিবহনের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা উপভোগ করছে প্রতিবেশী দেশটি।
প্রস্তাবটিকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এশিয়ান বন্দরগুলোতে ভারতের পদচিহ্ন সম্প্রসারণের অংশ হিসাবে দেখা হচ্ছে।
মে মাসের মাঝামাঝি ইরানে চাবাহার বন্দর পরিচালনার জন্য দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার কয়েকদিন আগে, পরিকল্পনাটি অনুধাবন করার জন্য, ইন্ডিয়া পোর্টস গ্লোবাল লিমিটেড (আইপিজিএল), বন্দর, নৌপরিবহন ও জলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি সংস্থা, মোংলা সমুদ্রবন্দর পরিদর্শন করে।
চলতি বছরের এপ্রিলে, মিয়ানমারের সিটওয়ে বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব পায় ভারত, যা আইপিজিএল দ্বারাও পরিচালিত হবে।
আইপিজিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুনীল মুকুন্দন ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে মোংলা বন্দরে যান যেখানে তিনি সমুদ্রবন্দর পরিচালনায় আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মধ্যে আইপিজিএল’র অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তাও ছিলেন।
তারা বন্দরের জেটি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পরিদর্শন শেষে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী (যান্ত্রিক ও বৈদ্যুতিক) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. ফিরোজ আল ওয়াহিদ এবং তার টিমের সাথে বৈঠক করেন।
যোগাযোগ করা হলে, মি. ওয়াহিদ বৃহস্পতিবার জানান যে ভারতীয় প্রতিনিধিদল বন্দরটি পরিচালনা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
"আমরা তাদের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছি এবং লিখিতভাবে প্রস্তাবটি জমা দিতে বলেছি," তিনি বলেন।
মি. ওয়াহিদ বলেন, প্রস্তাবটি গৃহীত হলে, বন্দর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে এর সুবিধা-অসুবিধা যাচাই করবে।
তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ এখনো আইপিজিএল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পায়নি।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল শাহীন রহমান বৃহস্পতিবার বলেন, "এখন পর্যন্ত আমরা ভারতীয় কোম্পানির কাছ থেকে কোনো লিখিত প্রস্তাব পাইনি।"
আইপিজিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সুনীল মুকুন্দন শুক্রবার টেলিফোনে জানান যে ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তিনি সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশ ও শ্রীলংকা সহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি বন্দর পরিদর্শন করেছেন।
এটি দুই দেশের সরকার টু সরকার ইস্যু উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আমি এখনো আমাদের সরকারের কাছে সফরের প্রতিবেদন জমা দিতে পারিনি।"
মি. মুকুন্দন বলেন, দুই দেশের সরকার যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিলেই পরিকল্পনাটি এগিয়ে যেতে পারে। সরকারের নির্দেশনা পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক চিঠি লিখবো।
সাম্প্রতিক অতীতে সরকার বিশ্বব্যাপী স্বনামধন্য বন্দর অপারেটর নিয়োগের মাধ্যমে বন্দর খাতে বিদেশি বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যে, নবনির্মিত পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল জেদ্দা ভিত্তিক রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি)-এর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
আবুধাবি পোর্টস গ্রুপ, পিএসএ সিঙ্গাপুর, ডিপি ওয়ার্ল্ড এবং স্থানীয় ইস্ট কোস্ট গ্রুপ এবং এর অংশীদাররা বে টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগের জন্য সম্মত হয়েছে। এছাড়াও, ডেনিশ বন্দর জায়ান্ট মারস্ক গ্রুপ চট্টগ্রামে লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণে ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে।
মোংলা সমুদ্রবন্দরে বর্তমানে পাঁচটি জেটি রয়েছে যেখানে কন্টেইনার এবং বাল্ক-ক্যারিয়ার জাহাজ উভয়ই পরিচালনা করা হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণের পর বন্দর ব্যবহারে শিপারদের আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় এর ক্ষমতা বাড়াতে আরো দুটি জেটি নির্মাণাধীন রয়েছে যা রাজধানীর সাথে এর দূরত্ব কমিয়ে দিয়েছে।
দ্রুততম সময়ে এবং সস্তায় পণ্যসম্ভার ও কন্টেইনার পরিবহনের সুবিধার্থে বন্দরটি শীঘ্রই রেল সংযোগের আওতায় আসবে।
গত বছরের এপ্রিলে, বাংলাদেশ চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ভারতকে সেভেন সিস্টার রাজ্যে কার্গো পরিবহনের জন্য স্থায়ী ট্রানজিট এবং ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা দেয়।
মোংলা বন্দরটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ যেখানে ভারত এবং চীন উভয়ই টার্মিনাল নির্মাণসহ এর সুবিধাগুলোর আপগ্রেডিং এবং আধুনিকীকরণে অর্থায়নের জন্য এগিয়ে এসেছে।
ভারতের মোংলা বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব চাওয়ার পেছনে ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে করছেন চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ।
তিনি বলেন, পায়রা বন্দরে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে এবং জাপান মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করছে। তাই বাংলাদেশের বন্দর সেক্টরে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে মোংলা বন্দরের কর্তৃত্ব চাইছে ভারত।
বাংলাদেশের সার্বিক বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরামর্শ দেন এই কূটনীতিক। চীন এবং জাপানকে অন্যান্য বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়ার কারণে ভারতকে অংশীদারিত্ব দেওয়ার দরকার নেই বলে মনে করেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সাবেক চেয়ারম্যান মি. আহমেদ বলেন, যদি ভারতকে বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়, তবে অন্যান্য দেশের চলমান বিনিয়োগ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।এটি অন্যদের জন্য একটি ভুল সংকেত দেবে।
"এটি অন্যদের জন্য একটি ভুল সংকেত দেবে।"
তিনি পরামর্শ দেন যে ভারতকে পুরো বন্দরের পরিবর্তে আংশিক ব্যবস্থাপনার জন্য কর্তৃত্ব দেওয়া যেতে পারে -- যেমন এক বা দুটি জেটি বা টার্মিনাল -- অবশিষ্টগুলো অন্য বিনিয়োগকারীদের দেওয়া যেতে পারে।