অর্থাভাবে সমালোচনামূলক কনটেন্ট ঠেকানোর যন্ত্র কেনা পিছিয়েছে
গত দুই বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মিডিয়া আউটলেটে প্রকাশিত সরকারের সমালোচনামূলক সংবাদ ও প্রতিবেদন ফিল্টারিং ও বন্ধ করার যন্ত্র কিনতে অর্থ বরাদ্দ পাচ্ছে না জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি)।
জানা গেছে, অর্থাভাবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাশ করা এনটিএমসি কনটেন্ট ব্লকিং অ্যান্ড ফিল্টারিং যন্ত্র কেনার প্রস্তাবটির জন্য অর্থ এখনও ছাড় করা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনের পর প্রায় দুই বছর ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ২২১ কোটি টাকা চেয়ে আসছে এনটিএমসি।
গত দুই বছরে অর্থ মন্ত্রণালয় কৃচ্ছতা সাধন নীতি ও তহবিলের অপ্রতুলতার কারণে যন্ত্র কেনার তহবিল ছাড় করার অনুমোদন দেয়নি। চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে বার বার তদবির করার ফলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ফাইলটি নিয়ে নড়াচড়া করতে শুরু করেন। কিন্তু অর্থ বিভাগ বলছে, সম্পূর্ণ টাকা এ অর্থ বছরে দেওয়া সম্ভব না। তারা কিস্তিতে অর্থ দিতে চাইছে ।
এনটিএমসির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ১ জুন ২০২২ তারিখে সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভার নিদের্শনা অনুসারে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণের পরিবর্তে সীমিত পদ্ধতি অনুসরণ পূর্বক যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়। সিস্টেমটির হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারসমূহ কাস্টমাইজড হওয়ায় এবং এর বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে বাজারে এই যন্ত্র সহজে পাওয়া যায় না। আন্তর্জাতিকভাবে যন্ত্রগুলো সংগ্রহ করা হয়। অভ্যন্তরীণ ক্রয়ের ক্ষেত্রেও স্থানীয় সরবরাহকারী কর্তৃক আন্তজার্তিকভাবে ক্রয় করে সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
কনটেন্ট ব্লকিং অ্যান্ড ফিল্টারিং সিস্টেমের কর্মসূচি ১৭ জুন ২০১৮ সালে বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফিল্টারিং এবং ব্লকিং এমন একটি প্রক্রিয়া যা নির্দিষ্ট ইমেল বা ওয়েব পৃষ্ঠাগুলিতে অ্যাক্সেস পরিচালনা বা স্ক্রিনিং করে । লক্ষ্য হলো, সরকারের সমালোচনামূলক তথ্য ও কন্টেন্ট ব্লক করা। বিষয়বস্তু ফিল্টারিং প্রোগ্রামগুলি সাধারণত তাদের ফায়ারওয়ালের মাধ্যমে অ্যাক্সেস নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহার করে।
এনটিএমসির প্রস্তাবে আরও বলা হয়, দেশের চার মোবাইল অপারেটর- টেলিটক, বাংলালিংক, রবি ও গ্রামীণফোন মোট ৯ টি ডাটা সেন্টারের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সরকার বিরোধী এবং মানবাধিকার লংঘন বিষয়ক রিপোর্ট ও সংবাদগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমানে ডাটা সেন্টারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সিস্টেমটির সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। এই সম্প্রসারণ কাজে অর্থবরাদ্দের জন্য ২০২৩-২৪ অর্থ বছর এবং ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরের বাজেট সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে বলে এনটিএমসি থেকে জানানো হয়েছে। চলতি অর্থ বছর বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭৫ কোটি টাকা। বাকি টাকা ২০২৪-২৫ অর্থ বছর বরাদ্দ রাখা হবে ।
গত ২০১৯ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ১৪৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। আইনে অনলাইনে দূষিত বিষয়বস্তু নিরীক্ষণ , ফিল্টার ও ব্লক করার জন্য একটি সংস্থা গঠনের কথা বলা হয়েছিল। প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। সেই সূত্র ধরেই জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) স্থাপন করা হয়েছে ।
সম্প্রতি সংঘবদ্ধভাবে অসত্য প্রচারের কারণে বাংলাদেশের ৫০টি ফেসবুক আইডি ও ৯৮টি পেজ বন্ধ করেছে ফেসবুক। এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও দলটির গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফর্মেশন (সিআরআই)-এর সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফেসবুকের মাতৃপ্রতিষ্ঠান মেটা।
২০ মার্চ ২০১৯-এ সরকার কাতারভিত্তিক নিউজ চ্যানেল আল জাজিরাকে ব্লক করে দেয়।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সরকার সুইডেন ভিত্তিক নিউজ ওয়েবসাইট নেত্র নিউজ ব্লক করে।
২০২০ সালে, শফিকুল ইসলাম কাজল বাংলাদেশে ৫৩ দিনের জন্য জোরপূর্বক গুমের শিকার হন। তিনি আবার হাজির হওয়ার পর তাকে গ্রেফতার করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক করা হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাকে বিবেকের বন্দি বলে অভিহিত করেছে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সরকারের সমালোচনামূলক নিউজ ও রিপোর্ট বন্ধ করার কর্মসূচিগুলোকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিপক্ষের বিষয় হিসেবে অভিহিত করে আসছে।
অর্থনীতিবিদ ড. রেজা কিবরিয়া দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক সরকার টিকে থাকতে বিরোধী দলের মানুষজনকে গুম-খুন এবং আড়িপাতা জন্য অনেক ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করে আসছে। এই নির্যাতনমূলক কর্মকাণ্ড চালু রাখার জন্য অবশ্যই টাকা প্রয়োজন। এ টাকার সংস্থান কমে গেলেও তারা টাকা ছাপিয়ে জনগণের ওপর মূল্যস্ফীতির বোঝা চাপিয়ে দিয়ে এসব নির্যাতন কর্মসূচি অব্যাহত রাখবে।
মানবাধিকারকর্মী, আইন ও শালিস কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির সদস্য, হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির উপদেষ্টা এবং গুম-খুনের শিকার পরিবারগুলোর সংগঠন মায়ের ডাকের সঙ্গে যুক্ত নূর খান লিটন ‘দি মিরর এশিয়া’কে বলেন দেশের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার কর্মসূচিগুলোকে প্রশ্নের মুখে আনতে হবে।