নাগরিকদের দীর্ঘশ্বাস ও কষ্ট প্রলম্বিত করবে প্রস্তাবিত বাজেট
দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলমান থাকায় সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন মহল থেকে দাবি জানানো হয়েছিল। সরকারের তরফ থেকেও করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর ইঙ্গিত দেওয়া হয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটে তা বাড়ানো হয়নি। উল্টো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর কর প্রস্তাব করায় সাধারণ মানুষের দীর্ঘশ্বাস ও কষ্ট প্রলম্বিত হবে বলে ধারণা করছেন ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদরা।
গত মে মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। টানা ১৫ মাস ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর রয়েছে। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে খাদ্য কিনতে বেশির ভাগ অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। এমন অবস্থায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ব্যক্তিখাতে আয়কর সীমা বাড়ানোর আহ্বান জানায়। গত ৫ মার্চ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এক প্রাক-বাজেট আলোচনায় ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তার মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ব্যক্তি খাতে করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
বাজেটের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট লুটেরাদের বাজেট। লুটপাট করতেই বাজেট দেওয়া হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট লুটেরাদের শুধু নয়, গণবিরোধী এবং দেশ বিরোধী বাজেট। তথাকথিত বাজেটে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। সাধারণ মানুষের ওপর সমস্ত বোঝা চাপানো হচ্ছে। ব্যাংক ও বিদেশিদের ঋণ আরও বাড়বে।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বাজেটের সঙ্গে সবকিছুর দাম আবার বাড়বে। মানুষ আর পারছে না। নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। পুরো বাজেট দেশবিরোধী বাজেট। জনগণের জন্য কিছু নেই। মেগা প্রজেক্টের নামে মেগা দুর্নীতির জন্য এ বাজেট।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, ‘ঋণের ভারে জর্জরিত এই বাজেট প্রস্তাবনা স্ববিরোধী ও বেসামাল। এ বাজেট জনকল্যাণের পরিবর্তে জীবন জীবিকায় জনদুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দেবে। ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি পোষাতে ব্যাংক ব্যবস্থা আরও বেসামাল ও ঝুঁকির মধ্যে পডবে। আর এ ঘাটতির শেষ অভিঘাত এসে পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। প্রস্তাবিত বাজেটে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার ওপর যাবে কেবল ঋণের সুদ পরিশোধে। আর বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্রে হাত বাড়ালে তারও ভুক্তভোগী হবে সাধারণ মানুষ।’
তিনি বলেন, ‘এ বাজেট দারিদ্র্য ও নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়াকে পরোক্ষভাবে আরও জোরদার করবে এবং জনগণের দীর্ঘশ্বাস ও হাহাকার আরও প্রলম্বিত করবে।’
বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেছেন, ‘২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জনগণের জন্য কিছু নেই। প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার এ বাজেটে মূল্যস্ফীতি ছাড়াবে ১৫ শতাংশ। জনগণকে বোঝাতে গোঁজামিলের বাজেট দিয়েছে সরকার। বাজেটে এত ঋণ কীভাবে শোধ হবে তার সঠিক খাত নেই। সরকারকে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভর করতে হবে।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুবিধা দেওয়ায় লুটেরা ও দুর্নীতিবাজরা আরো সুযোগ পাবে।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী আগের মতো বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করেছেন। পাশাপাশি ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে ৩০ শতাংশ হারে নতুন একটি কর স্তর তৈরি করার প্রস্তাব দেন অর্থমন্ত্রী। জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করে তিনি কর স্তর পুনর্বিন্যাস করারও প্রস্তাব করছেন।
এখন ৫, ১০, ১৫, ২০ ও ২৫ শতাংশ কর হারের পর উচ্চস্তরে আরেকটি কর হার এসেছে। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রথম সাড়ে তিন লাখ টাকার পর প্রথম এক লাখ টাকার জন্য ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৪ লাখ টাকার জন্য ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ টাকার জন্য ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ টাকার জন্য ২০ শতাংশ এবং পরবর্তী ২০ লাখ টাকা আয়ের জন্য ২৫ শতাংশ কর দিতে হবে। বাকি অর্থের ওপর কর বসবে নতুন ৩০ শতাংশ হারে।
এ ছাড়া নারী করদাতা এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা হলো চার লাখ টাকা। তৃতীয় লিঙ্গের করদাতা ও প্রতিবন্ধী স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতার করমুক্ত আয়সীমা হবে পৌনে পাঁচ লাখ টাকা। গেজেটভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা করদাতার করমুক্ত আয়ের সীমা পাঁচ লাখ টাকা হবে। আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তির বাবা-মা বা আইনানুগ অভিভাবকের প্রত্যেক সন্তান বা পোষ্যের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা আরও ৫০ হাজার টাকা বেশি হবে।
এমনকি বাজেটে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এতে গ্রাহকদের ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ আরও বাড়বে। এর আগে মোবাইল ইন্টারনেটের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক দিতে হতো গ্রাহকদের। এখন তা আরও ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এর সঙ্গে ভোক্তাদের ১ শতাংশ সারচার্জও দিতে হবে। নতুন করে সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়ানোয় একজন গ্রাহককে এখন ১০০ টাকার ইন্টারনেট প্যাকেজে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ ৩০ টাকা ৬৫ পয়সা করে দিতে হবে। বাকি ৬৯ টাকা ৩৫ পয়সার ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন তিনি।
আগে ১০০ টাকার ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনলে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কাটা হতো ২৭ টাকা। বাকি ৭৩ টাকার ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারতেন গ্রাহকরা। দেশে বর্তমানে ১৯ কোটি সিমকার্ড গ্রাহক রয়েছে। তাদের মধ্যে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে প্রায় ১৩ কোটি। এদিকে, প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার পরপরই নতুন এ শুল্ক কার্যকর করেছে দেশের মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলো।