কালোটাকার আশায় বুক বেঁধেছে সরকার

চার বছর পর প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বাজেটে ১৫ শতাংশ কর হিসেবে আবারো কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সরকার আশা করছে অবৈধ অর্থ ফেরত আনার এ সুযোগ কাজে লাগাবে অনেকে। এতে কালো টাকা অর্থনীতির মূল স্রোতে আসবে। যা চলমান অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে সহায়তা করবে বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।

১৯৭২-৭৩ অর্থ বছর থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত ৫০ বছরে পুঞ্জীভূত কালো টাকা ও দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ ১ কোটি ৪৪ লাখ কোটি টাকা। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি এ অর্থের মাত্র দেড় শতাংশ উদ্ধারের প্রস্তাব দিয়েছে। সমিতি আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনায় এ তথ্য দিয়েছে। তাদের হিসাবে, গড়ে বছরে অন্তত ২৪ হাজার কোটি টাকা করে পাচার হয়েছে।

আবার ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি (জিএফআই)-র পরিসংখ্যান দেখায় যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ২০০৯-২০১৫ সময়কালে মোট অন্তত ৮২৭ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা টাকার অঙ্কে ৯১ হাজার কোটি টাকার বেশি। মানে, বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে পণ্য আমদানিতে অধিক মূল্য ও পণ্য রপ্তানিতে কম দর দেখিয়ে।

এদিকে আর্থিক সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে এ বছর বাজেটের আকার কমানো হয়েছে। নিত্যপণ্যের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে ধান, গম ভুট্টা, আলু, পিঁয়াজ, আটা, লবণ, ভোজ্যতেল, চিনিসহ ৩০ ধরনের নিত্যপণ্যের আমদানি শুল্ককর কর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

যদিও চড়া মূল্যস্ফীতির বাজারে এবারও ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্ত আয়সীমা অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব রয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে বহাল থাকা বিভিন্ন শিল্পের কর অবকাশ সুবিধা সংকুচিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আবার ব্যবসা-বাণিজ্যের সুুবিধার্থে করপোরেট কর হার শর্ত সাপেক্ষে আড়াই শতাংশ কামনোর প্রস্তুাব করা হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণে বিত্তশালীদের সম্পদের ওপর বলবত থাকা ১০ শতাংশ সারচার্জের বিদ্যমান কাঠামো অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

কর ব্যবস্থায় সংস্কার এনে ‘সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক’ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি তার বক্তৃতায় বলেছেন, নতুন আয়কর আইন ২০২৩ ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ই-টিআইএন প্রবর্তনের পর ব্যাপক হারে নতুন করদাতা করনেটের আওতায় যুক্ত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে এক কোটি ই-টিআইএনধারী রয়েছে। এপ্রিল ২০২৪ পর্যন্ত ৪১ লাখ ই-টিআইএনধারী আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন। যাদের অধিকাংশই ব্যক্তি করদাতা।

রাজস্ব আয় বাড়াতে প্রতি বছর নতুন নতুন করদাতার অনুসন্ধানের ঘোষণার মত এবারও একই রকম ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তবে এর বিস্তারিত কোন পরিকল্পনা তিনি তুলে ধরেননি। বরং কর ব্যবস্থায় সংস্কার আনার ব্যাপারে যে পরিকল্পনা করা হয়েছে তাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের ওপরই করের বোঝা চাপাবে।

প্রস্তাবিত নতুন বাজেটের বাজেটের মূল আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এতে আয়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। যদিও চলতি বছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ থেকে অনেক দূরে রয়েছে এনবিআর। কৃচ্ছ্রসাধনের পর ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেটে অনুদানসহ ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। যা জিডিপির ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এ বিশাল পরিমাণ ঘাটতি পূরণে কয়েকটি খাতকে উৎস হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে ব্যাংকিং খাত। এই খাত থেকে মোটা দাগে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর বাইরে বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য বিদেশী উৎস থেকে ঋণ ও অনুদান নেওয়া হবে ১ লাখ ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার। এর পাশাপাশি ব্যাংক বহির্ভূত খাত হিসেবে বিবেচিত সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া হবে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থের জোগান দিতে সরকারকে এখন আগের চেয়ে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে। ফলে বাড়ছে ঋণ পরিশোধের চাপ। পাশাপাশি ডলার-সংকট ও ডলারের বাড়তি দাম সরকারকে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে আরও বেশি চাপে ফেলেছে। আগামী অর্থবছরের জন্য সুদ পরিশোধে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

নতুন অর্থবছরে মোট রাজস্ব প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে যা ছিল ৫ লাখ কোটি টাকা। রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮ শতাংশ। নতুন রাজস্ব প্রাপ্তির মধ্যে বরাবরের মতো এবারো বেশির ভাগ আয় করার দায়িত্বটি থাকবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে এনবিআরকে রাজস্ব আয়ের টার্গেট দেয়া হয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। নন-এনবিআর খাত থেকে আসবে আরো ১৫ হাজার কোটি টাকা। আর কর ব্যতীত রাজস্ব প্রাপ্তির টার্গেট ধরা হচ্ছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।

নতুন অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে ১৮ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে এডিপির আকার করা হয়েছে দুই লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা।

জিডিপি প্রবৃদ্ধি : আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। যদিও আর্থিক সংকটের  কারণে পরে তা কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়। এদিকে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে বড় জোর ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রায় কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ)।

মূল্যস্ফীতি: আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছর মূল্যস্ফীতির চাপকে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে আটকে রাখার ঘোষণা করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ ১০ শতাংশের কাছাকাছি। মূল্যস্ফীতির এই চাপ সবচেয়ে রয়েছে খাদ্যে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, বর্তমানে খাদ্যে মূল্যষ্ফীতি ১২ শতাংশে বেশি।

গতকাল বৃহস্পতিবার (৬ জুন) অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন। বিকাল ৩টায় জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট সংসদে পেশ করেন অর্থমন্ত্রী।

এবারের বাজেট বক্তৃতায় বার বার এসেছে মূল্যস্ফীতি ও বৈশ্বিক সংকটের কথা। এজন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারও দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে থাকছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নয়ন ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর চ্যালেঞ্জের কথাও বলা হয়েছে।

অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’। অর্থাৎ নানা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও অর্থমন্ত্রী স্বপ্ন দেখছেন স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের। দেশের অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় হবে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।

প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কমিয়ে আনবে সরকার। চলতি অর্থবছরের ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আসন্ন বাজেটে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন আসছে আমদানি শুল্ক কাঠামোয়। এসব প্রস্তাবের মধ্যে যেমন রাজস্ব আয় বাড়ানোর উপায় দেখিয়েছেন অর্থমন্ত্রী, আবার দেশীয় শিল্প সুরক্ষায়ও কিছু প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বাতিল হবে এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি সুবিধা। এক্ষেত্রে তিনি ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেছেন নতুন এই বাজেটে।  

অন্যদিকে মেট্রোরেলের টিকিটের ওপর বর্তমানে ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) মওকুফ আছে, যার সময়সীমা ৩০ জুন পর্যন্ত। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট মওকুফের সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে কিছু বলেননি অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। অর্থাৎ আগামী ১ জুলাই থেকে মেট্রোরেলের টিকিটে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসছে। এতে করে সরকারের রাজস্ব যেমন বাড়বে তেমন জনগনের খরচের বোঝাও বাড়বে। যা মূল্যস্ফীতিতে আরো বেশি চাপ তৈরি করবে।