ব্যাংক লুটে দানবীর থার্মেক্স গ্রুপের কাদির মোল্লা: ব্যাংকের পাওনা ১০ হাজার কোটি
রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকের টাকায় ফুলেফেঁপে উঠেছে আলোচিত শিল্প গ্রুপ থার্মেক্স। গ্রুপটির সত্ত্বাধিকারী আব্দুল কাদির মোল্লা সেজেছেন দানবীর। একের পর এক তফসিলি ব্যাংক থেকে নিজের প্রতিষ্ঠিত অর্ধশতাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেওয়ার নাম নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক অন্তত শতাধিকবার ঋণ খেলাপি হিসেবে কাদির মোল্লা এবং তার স্ত্রী নাসিমা বেগম পরিবারের সদস্য নাহিদা সুলতানাকে অন্তর্ভুক্ত করলেও কিছুতেই আদায় হচ্ছে না ঋণের টাকা।
আব্দুল কাদির মোল্লার থার্মেক্স গ্রুপের কাছে ব্যাংকগুলোর মোট পাওনা অন্তত দশ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এর মধ্যে দেড় হাজার কোটি টাকা ইতিমধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ রয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি তালিকা থেকে নাম কাটাতে এ পর্যন্ত ৩২১ বার উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। রিট আবেদনের আদেশ মতো চলতি মাসের ২৮ তারিখের মধ্যেই সবগুলো নির্দেশের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় এই সময়ের মধ্যে আব্দুল কাদির মোল্লার কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনাও পরিশোধের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে ঋণের টাকা পরিশোধ করে ব্যাংকের ঋণ নিয়মিত না করতে পারলে আব্দুল কাদির মোল্লার প্রায় সবগুলো শিল্পপ্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে। যদিও প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে সখ্য বা লেনদেনের মাধ্যমে আবারো হয়তো ঋনখেলাপি তালিকা থেকে নাম কাটিয়ে নিতে পারেন বলে আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক।
আব্দুল কাদির মোল্লার অর্ধশতাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৮টি প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বর্তমানে এ শিল্প পরিবারটির বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ রয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা ফান্ডেড ঋণ রয়েছে। আর বিভিন্ন ব্যাংকের এলসি এবং ব্যাংক গ্যরান্টি বাবদ পাওনা রয়েছে ৬৭৭ কোটি টাকা। এই ঋণের মধ্যে ১ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এ ছাড়া ৪৭ কোটি টাকার সাব-স্ট্যান্ডার্ড বা এসএস, ১০ কোটি টাকার ক্ষতিজনক বা বিএল ঋণ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবিতে যা উল্লেখ করা হয়েছে
২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত আদুরী এ্যপারেলস লি. এর নামে মোট ঋণ রয়েছে ৩৭১ কোটি ৫৯ লাখ ৭৫ হাজার ৫০৩ টাকা। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে ৩৯ কোটি ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯৮ টাকা। এর বাইরে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এলসি এবং ব্যাংক গ্যরান্টি বাবদ ঋণ রয়েছে ২৪০ কোটি ২৫ লাখ ৭০ হাজার ৮৪৯ টাকা।
২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত আদুরী এ্যপারেল্স অ্যান্ড প্রিন্ট লি. এর নামে ৩ কোটি ৬৬ লাখ ৪৩ হাজার ২০৬ টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে। একই প্রতিষ্ঠানের নামে অপর এক হিসাব থেকে ১৯৫ কোটি ২০ লাখ ১১ হাজার ৪৭১ টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে। এই ঋণের ১ কোটি ৪২ লাখ ৩৩ হাজার ১৮৯ টাকা ঋন মেয়াদোত্তির্ণ হয়ে গেছে। ২০২৩ সালে এই ঋণের দায়ে আব্দুল কাদির মোল্লাকে ঋণ খেলাপি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন কাদির মোল্লা। চলতি ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত ঋণ খেলাপির তালিকা ভুক্তি না করার নির্দেশ দেয় আদালত।
২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত আদুরী নিট কম্পোজিট লি. এর নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৮১ কোটি ৬৬ লাখ ৮১ হাজার ৫২১ টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭ কোটি ৭ লাখ ১৭ হাজার ৭০৯ টাকা ঋণ ইতিমধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এর বাইরে ৭ কোটি ৯২ লাখ ৮৪ হাজার ৪৮৯ টাকা বিভিন্ন ব্যাংকে এলসি এবং গ্যারান্টি বাবদ ঋণ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ইনডিগো সিপিং লি. এর নামে ১০৩ কোটি ২৩ হাজার ৫৮২ টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৪ কোটি ৪৭ লাখ ২৭ হাজার ৭৮০ টাকা ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এর বাইরে এলসি এবং গ্যরান্টি বাবদ বিভিন্ন ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ রয়েছে ১৯ কোটি ১৩ লাখ ৫৯ হাজার ৫৫১ টাকা। ঋণের বিপরিতেও ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ খেলাপি ঘোষণা করে কাদির মোল্লাকে। কিন্তু উচ্চ আদালতের মাধ্যমে চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত ঋণ খেলাপি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত না করার আদেশ নেন তিনি।
একই প্রতিষ্ঠানের নামে অপর এক হিসাব থেকে ১৪১ কোটি ৪০ লাখ ৬৩ হাজার ৫৪৫ টাকা ঋণ তোলা হয়েছে। এ ঋণের মধ্যে ৩১ কোটি ৬৪ লাখ ৫০ হাজার ৫৯৫ টাকা ইতিমধ্যে কুঋণ হিসেবে অন্তভূক্ত হয়েছে। আর মেয়াদোত্তীর্ণ রয়েছে ১৯৭ কোটি ৭৪ লাখ ১৫ হাজার ৪৩৩ টাকা। এলসি এবং গ্যারান্টি বাবদ রয়েছে আরো ২ কোটি ৮ লাখ ৪৩ হাজার ৭০৬ টাকার ঋণ। এই ঋণের বিপরীতেও ঋণখেলাপি হন কাদির মোল্লা। কিন্তু উচ্চ আদালতের মাধ্য ৬টি রিটের মাধ্যমে ২৮৫ কোটি ৭৩ লাখ ৮৪ হাজার ২৫৪ টাকার ঋণ খেলাপি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত না করার জন্য উচ্চ আদালত থেকে স্টে অর্ডার নেন তিনি।
২০২০ সালের কার্যক্রম শুরু করা সিস্টার কম্পোজিট ইউনিট-২ এর নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৫৮ কোটি ৪৮ লাখ ৩৯ হাজার ৫৪ টাকা ঋণ তোলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা ইতিমধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। আর এলসি এবং গ্যরান্টি বাবদ বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনা রয়েছে ১৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সিস্টার ডেনিম কম্পোজিট লি. এর নামে রয়েছে ৬৬৮ কোটি ৪২ লাখ ৬৭৯ টাকার ঋণ। এর মধ্যে ৩০ কোটি ৭৪ লাখ ৩১ হাজার ৭৬৪ টাকা রয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ। আর ১৫২ কোটি ২৬ লাখ ৩৪ হাজার ৪০২ টাকা রয়েছে এলসি এবং গ্যরান্টি বাবদ ঋণ। এই কোম্পানিও ২০২৩ সালে ঋণ খেলাপি হিসেবে ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু উচ্চ আদালতের মাধ্যমে ১১ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত ঋণ খেলাপি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশনা নেন কাদির মোল্লা। সেই সময়ের মধ্যেও কোনো ঋণ পরিশোধ করে নিয়মিত না হওয়ায় এখন আবারো ঋণ খেলাপি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটি।
২০০৭ সালে কার্যক্রমে আসা থার্মেক্স ব্লেন্ডেড ইয়ার্ন লি. এর নামে রয়েছে ২ কোটি ২০ লাখ ৫২ হাজার ৯১৩ টাকার ঋণ।
২০১৩ সালে শুরু করা থার্মেক্স চেক ফেব্রিক্স লি. এর নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ তোলা হয়েছে ১৫৩ কোটি ১২ লাখ ৪৪ হাজার ৩৫৮ টাকা। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ রয়েছে ১১৭ কোটি ৭ লাখ ৭৯ হাজার ৬০৬ টাকা। আর এসএস বা সন্দেহজনক ঋণ রয়েছে ১৬ কোটি ৯৩ লাখ ৭৯ হাজার ৪৪১ টাকা। এর বাইরে এলসি এবং গ্যরান্টি বাবদ এ প্রতিষ্ঠানের ঋণ রয়েছে ২৬ কোটি ১৮ লাখ ১১ হাজার টাকা। ২০২৩ সালে এই কোম্পানিটিও ঋণ খেলাপি হয়ে যায়। কিন্তু উচ্চ আদালত থেকে অন্তত ৫ বারে ৩১২ কোটি ১৩ লাখ ৭৭ হাজার ১৫৯ টাকা ঋণের ওপর স্টে অর্ডার নিয়েছেন কাদির মোল্লা।
২০১৪ সালে কার্যক্রমে আসা থার্মেক্স কালার কটন লি. এর নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৪৩ কোটি ৭৩ লাখ ৩৩ হাজার ১১৬ টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১০ কোটি ২০ লাখ৮৩ হাজার ৪৪৬ টাকা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এর বাইরে এলসি এবং গ্যরান্টি বাবদ বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ রয়েছে ৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
একই প্রতিষ্ঠানের নামে অপর এক হিসাব থেকে ২৪ কোটি ৯২ লাখ ৮ হাজার ৭৫ টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ লাখ ৮৬ হাজার টাকা ঋণ ইতিমধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত থার্মেক্স নিট ইয়ার্ন লি. এর নামে ৩০৯ কোটি ৩৯ লাখ ৪৯ হাজার ৮৭০ টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৬৭ কোটি ৪৭ লাখ ৮৩ হাজার ৫০০ টাকার ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। আর ২ কোটি ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৪৬৩ টাকা বিশেষ সন্দেহজনক ঋণ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। কাদির মোল্লাকে এই ঋণের দায়ে ঋণ খেলাপি হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু উচ্চ আদালতে ৫৩ বার রিট আবেদনের মাধ্যমে ২৪১ কোটি ৬৮ লাখ ৮৮ হাজার ৬৯৪ টাকা ঋণের উপর স্থগিতাদেশ নিয়ে নেন কাদির মোল্লা। কিন্তু এখনো ঋণের কোনো টাকাই পরিশোধ করেননি তিনি। চলতি মাসেই শেষ হচ্ছে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ। এর বাইরে ২৬ কোটি ৭৬ লাখ ৬৬ হাজার ২০৫ টাকা এলসি এবং ব্যাংক গ্যরান্টি বাবদ বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ রয়েছে কাদির মোল্লার।
২০১৫ সালে কার্যক্রমে আসা থার্মেক্স মিল্যঞ্জ স্পিনিং লি. বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ২৬৭ কোটি ৭০ লাখ ৬৯ হাজার ৪৯৬ টাকা ঋণ নেয়। এর মধ্যে ৩৬৪ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ৩২৫ টাকার ঋণ ইতিমধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এছাড়া এলসি এবং ব্যাংক গ্যরান্টি বাবদ ২৬ কোটি ১২ লাখ ৮১ হাজার ২০০ টাকার ঋণ রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকে। ঋণ খেলাপি তালিকা থেকে নাম কাটাতে মোট ১৮৮ বার উচ্চ আদালতে রিট আবেদনের মাধ্যমে ৯৬৩ কোটি ৪৭ লাখ ৬০ হাজার ৭৬১ টাকার ঋণের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে বহাল তবিয়তেই ব্যবসা চালিয়ে আসছে থার্মেক্স গ্রুপ।
২০২২ সালে শুরু করা থার্মেক্স স্পিনিং লি. বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৮৮৯ কোটি ৭৮ লাখ ৭৭ হাজার ৪৩৬ টাকা ঋণ নেয়। এর মধ্যে ৪৫৭ কোটি ১৪ লাখ ২৩ হাজার ৩৩৬ টাকা ঋণ ইতিমধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। আর ২১ কোটি ৪৮ লাখ ১৮ হাজার ৮০৩ টাকা বিশেষ সন্দেহজনক ঋণ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর বাইরে ৩৪ কোটি ৮১ লাখ ৫২ হাজার ৬৭৪ টাকা এলসি এবং ব্যাংক গ্যরান্টি বাবদ ঋণ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের তালিকা থেকে প্রতিষ্ঠানটির নাম বাতিল করতে ৭টি রিট আবেদনের মাধ্যমে ৩৭৮ কোটি ৬৭ লাখ ৯১ হাজার ৬৬২ টাকা ঋণের ওপর স্টে অর্ডার আনে থার্মেক্স।
১৯৯৭ সালে যাত্রা শুরু করা থার্মেক্স টেক্সটাইল মিলস লি. বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ২২৪ কোটি ৩০ লাখ ৮৩ হাজার ৭২২ টাকা ঋণ নেয়। এর মধ্যে ৫১ কোটি ৪৩ লাখ ২০ হাজার ৭৩৬ টাকা ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এছাড়াও ২৩ কোটি ৭৩ লাখ ৯০ হাজার টাকার এলসি এবং ব্যাংক গ্যরান্টি বাবদ ঋণ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এই প্রতিষ্ঠানটিও ঋণ খেলাপি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু উচ্চ আদালতে রিট আবেদনের মাধ্যমে ১৬ জুন ২০২৪ পর্যন্ত ৪১ কোটি ৮৫ লাখ ৮ হাজার ৭০০ টাকা ঋণের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে নেয় থার্মেক্স। একই প্রতিষ্ঠানের নামে অপর এক হিসাব থেকে কোম্পানির অপর পরিচালক নাহিদা সুলতানা এবং নাসরিন সুলতানা দিনার নামে ঋণ নেয়া হয়েছে ৫২ কোটি ৫৫ লাখ ৫৬ হাজার ১৮৮ টাকা। এর মধ্যে ৩৩ কোটি ৯৯ লাখ ১২ হাজার ৮০৫ টাকা ঋণ ইতিমধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। উচ্চ আদালত থেকে এই ঋণের ওপরও উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়েছে থার্মেক্স গ্রুপ।
২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত থার্মেক্স ওভেন লি. বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ২০ কোটি ৪০ লাখ ৩৪ হাজার ৬৭১ টাকা ঋণ নেয়। এই প্রতিষ্ঠানটির ঋণের চেয়ে দায় বেশি। এখনো পর্যন্ত ১০৯ কোটি ২২ লাখ ৯৩ হাজার ৭০৬ টাকা মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ রয়েছে। আর এলসি এবং গ্যরন্টি বাবদ ঋণ রয়েছে ৭ কোটি ৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৬ টাকা। উচ্চ আদালতে মোট ৫৮ বার রিট আবেদনের মাধ্যমে ঋণের বিপরীতে ৩৬৮ কোটি ৮৯ লাখ ৯৮ হাজার ৬২৮ টাকার স্থগিতাদেশ নিয়েছে থার্মেক্স গ্রুপ।
থার্মেক্স ইয়ার্ন ডাই ফেব্রিক্স লি. এর নামে রয়েছে ২৯৫ কোটি ৩১ লাখ ১৯ হাজার ৮৫৮ টাকার ঋণ। এর মধ্যে ২৪ কোটি ৮৭ লাখ ৬ হাজার ৫৮৫ টাকা ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। আর এলসি ও গ্যরান্টি বাবদ ঋণ রয়েছে ৭৭ কোটি ৬০ লাখ ৩৮ হাজার ২৯৩ টাকা। একই প্রতিষ্ঠানের নামে অপর এক হিসাব থেকে ৪৫ কোটি ২৮ লাখ ১৪ হাজার ১৮৪ টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে উচ্চ আদালত থেকে রিট আবেদনের মাধ্যমে ৮৬ লাখ ৫৫ হাজার ৭৪১ টাকা ঋণের ওপর স্থগিতাদেশ নেয় গ্রুপটি।
সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন (২০২৩) অনুযায়ী, সামর্থ্য থাকার পরও যে গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করবে না, তাদের ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে বিবেচনা করা হবে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঋণ গ্রহণ ও ব্যাংকের কাছে ঘোষিত উদ্দেশ্যে ঋণের টাকা ব্যয় না করলে ওইসব গ্রাহককে বিবেচনা করা হবে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে।
এই কাজটিই করেছেন আবদুল কাদির মোল্লা। রপ্তানি থেকে বিপুল অর্থ আয় করলেও তারা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে থাকা দায় পরিশোধ করছে না। উল্টো পুনতফসিলের নির্দিষ্ট ডাউন পেমেন্ট না করেই ঋণ নবায়ন করতে বিশেষ সুবিধা চায় এই শিল্প গ্রুপটি।
ব্যাংকিং কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো ঋণখেলাপির ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। অথচ বিভিন্ন ব্যাংকে খেলাপি হয়েও উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক-এসবিএসি’র পরিচালক পদে বহাল রয়েছেন থার্মেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল কাদির মোল্লা।
উল্লেখ্য, থার্মেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো রপ্তানি করা পণ্যের কাঁচামাল আমদানির এলসি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকে খুললেও রপ্তানির অর্থ আনছে নিজের সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক-এসবিএসি ব্যাংকের মাধ্যমে। এমনকি সেই এলসির দায়ও পরিশোধ করছে না। বাধ্য হয়ে ফোর্সড লোন সৃষ্টি করে এলসি দায় পরিশোধ করছে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকটি। ফলে ওইসব ব্যাংকে ঋণ বাড়ছে থার্মেক্সের। সেই ঋণ পরিশোধ না করায় খেলাপি হয়ে পড়ছে এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটি।
এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান আইন দুর্বল হয়ে পড়েছে। আর উচ্চ আদালতও এসব লুটেরাদের সুযোগ করে দিচ্ছে। ফলে দিন দিন খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আর ঋণ খেলাপিরাও আইনের সুযোগ নিচ্ছে। আর এই ঋণ খেলাপিরা সব সময়ই ক্ষমতার মধ্যেই থাকে। সুতরাং ক্ষমতাসীনরা বা সরকার না চাইলে এদের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। আর ব্যাংকিং সেক্টরেও সুশাসন ফেলানো যাবে না।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আইনের শাসনের অভাবেই এটা হচ্ছে। এ দায় নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষেরই নিতে হবে। সর্বোপরী সরকারে যারা আছেন তাদেরই দায় বেশি। সুতরাং উদ্যোগও তাদের নিতে হবে।