বাংলাদেশের রিজার্ভে নেই ৩ মাসের আমদানি ব্যয়: আইএমএফ
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে না। আইএমএফের বর্ধিত ঋণ সহায়তার আওতায় দ্বিতীয় পর্ষবেক্ষণ প্রতিবেদনে এ তথ্য দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন ও আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নের বিষয়ে সোমবার রাতে সংস্থাটির ওই প্রতিবেদন থেকে আরো কিছু তথ্য পাওয়া যায়।
এতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের মোট রিজার্ভ এখন ১ হাজার ৮৯৯ কোটি ডলার। যা দিয়ে ২ দশমিক ৩ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। নিট রিজার্ভ ১ হাজার ৪৭৯ কোটি ডলার, যা দিয়ে ১ দশমিক ৮ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
আইএমএফ মনে করে, রিজার্ভ ঝুঁকিমুক্ত রাখতে তা তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমপর্যায়ে উন্নীত করতে হবে। আর মোট রিজার্ভ তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান করতে হলে বাংলাদেশকে আরো দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে। প্রকৃত রিজার্ভ তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান করতে হলে অপেক্ষা করতে হবে আরো তিন বছর। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এ তথ্য মানতে নারাজ।
তারা বলেছে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন নিট ও গ্রস দুই হিসাবেই তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের ওপরে রয়েছে। গ্রস হিসাবে এখন রিজার্ভ ২ হাজার ৫২৩ কোটি ডলার ও নিট হিসাবে ১ হাজার ৯৯১ কোটি ডলার। যা দিয়ে সাড়ে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে।
অর্থনীতির সূত্রে, কোনো দেশের রিজার্ভ নিরাপদ থাকে তখন, যখন তা কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান হয়। সে হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ কম রয়েছে।
আইএমএফ নির্ধারিত ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বিপিএম-৬ পদ্ধতিতে গত এপ্রিল শেষে বাংলাদেশের নিট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (এনআইআর) নেমে যায় ১২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে। ২০২৩ সালের জুন শেষে যা ছিল ১৯ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে ১০ মাসে নিট রিজার্ভ কমেছে ৬ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুল রউফ তালুকদার গত মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, পাকিস্তানের মতো দেশেও তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান বৈদেশিক রিজার্ভ রাখার প্রয়োজন হয় না। বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদেরও বলেন তিনি। কর্মকর্তারা তখন গভর্নরকে স্মরণ করিয়ে দেন, বাংলাদেশে আইএমএফের ঋণের মধ্যে রয়েছে। ঋণের শর্ত মেনে বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ না রাখলে আইএমএফ কিস্তি ছাড় করবে না। বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য ব্যবসায়ীদের ঋণপত্র খুলতে জরিমানা দিতে হবে।
বর্তমানে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ ১৪ দশমিক ৪১ বিলিয়ান মার্কিন ডলার। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৮ দিনের আমদানি খরচ বা ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার।
আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পেতে যেসব শর্ত পরিপালন করতে হচ্ছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নির্ধারিত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুত থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ আইএমএফের দেওয়া শর্ত অনুযায়ী নির্ধারিত পরিমাণ রিজার্ভ রাখতে পারেনি। এ জন্য সংস্থাটি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে রিজার্ভের নতুন লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে। যা অনুসারে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নিট রিজার্ভ ১ হাজার ৫৩২ কোটি ডলারে উন্নীত করতে হবে। বর্তমানে নিট রিজার্ভ রয়েছে ১ হাজার ৪৭৯ কোটি ডলার। অর্থাৎ ২০২৬ সালের জুনে গ্রস রিজার্ভ ও ২০২৭ সালের জুনে নিট রিজার্ভ তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান হবে। অথচ আইএমএফ থেকে চলতি জুন পর্যন্ত নিট রিজার্ভ ধারণের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল ১ হাজার ৭৭৮ কোটি ডলার। ওই সময়ে এ লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না। রিজার্ভ জুন শেষে ১ হাজার ৬৭৩ কোটি ডলারে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
আগামী বছর জুনের মধ্যে রিজার্ভের আগাম সংরক্ষণের সম্ভাবনার তথ্য তুলে ধরে আইএমএফ বলেছে, আগামী বছরের জুনের মধ্যে মোট রিজার্ভ বেড়ে ২ হাজার ৩২৭ কোটি ডলারে উন্নীত হতে পারে। আর এ রিজার্ভ দিয়ে আড়াই মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে। পাশাপাশি আলোচ্য সময়ে প্রকৃত রিজার্ভ বেড়ে ১ হাজার ৯৪৭ কোটি ডলারে উন্নীত হতে পারে, যা দিয়ে ২ দশমিক ১ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে।
আইএমএফ মনে করে, রিজার্ভ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে মোট রিজার্ভ ২০২৬ সালের জুনে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান হবে। ওই সময়ে রিজার্ভ বেড়ে হবে ৩ হাজার ২১৫ কোটি ডলার। তবে নিট রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তখন প্রকৃত রিজার্ভ বেড়ে হবে ৩ হাজার ৭৭৪ কোটি ডলার। যা দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
সংশিষ্টদের তথ্য হলো, এখন প্রতি মাসে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। আগামী মাসে এশিয়ান ক্লিয়ারিংয়ের দায় পরিশোধ করতে হবে প্রায় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভ কমে যাওয়ার এ ধারা থেকে বের হতে চাপ দিচ্ছে আইএমএফ। আর এ জন্য রেমিট্যান্স বাড়ানোর কথা বলছে। কিন্তু বকেয়া বৈদেশিক দেনা থাকায় রিজার্ভ বাড়াতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের প্রধান দুটি খাত রেমিট্যান্স ও রফতানির মাধ্যমে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ হচ্ছে, তা, চলতি আমদানি দায় পরিশোধ করতেই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাধ সেধেছে বকেয়া দেনা। আর এ কারণে লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকলেও আর্থিক হিসাবে সার্বিক লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি বৃদ্ধি পেয়ে ১৩০ কোটি ৩০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। এতেই বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।