সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ তলানিতে
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ আট মাস ধরে ঘাটতিতে রয়েছে সঞ্চয়পত্র খাত। প্রথম দুই মাস সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ইতিবাচক থাকলেও পরের আট মাস ঋণাত্মক হয়েছে। এর কারণ, গ্রাহকদের মাঝে এই সময়ে সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙানোর প্রবণতা বেশি দেখা গেছে। এর ফলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ তলানিতে নেমেছে। এ খাত থেকে সরকার ঋণ তো পাচ্ছেই না উল্টো মোটা অংকের টাকা অন্য খাত থেকে এনে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এপ্রিলে সঞ্চয়পত্রে ঘাটতি তৈরি হয়েছে ২ হাজার ১০৩ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ৩ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ গুণেরও বেশি।
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ তলানিতে নেমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস (জুলাই-আগস্ট) সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি ৫ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা বেশি ছিল। তবে এরপর থেকে নিট বিক্রিতে ঘাটতি হতে থাকে। সেপ্টেম্বরে ঘাটতি হয় ১৪৭ কোটি, অক্টোবরে ১ হাজার ৪০ কোটি, নভেম্বরে ১ হাজার ৫৫৪ কোটি, ডিসেম্বরে ২ হাজার ২০৪ কোটি, জানুয়ারিতে ১ হাজার ২৮৭ কোটি, ফেব্রুয়ারিতে ১ হাজার ৫৪১ কোটি এবং মার্চে ঘাটতি ছিল ৩ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা।
সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ কমবে, এটা সরকারের পর্যালোচনায় ছিল। তাই ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৩২ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছিল। ঐ অর্থবছরের শেষে ঋণ পাওয়ার চেয়ে উল্টো ৩ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা ঘাটতি তৈরি হয়। তবে আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার।
গ্রাহকদের মাঝে এই সময়ে সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙানোর প্রবণতা বেশি দেখা গেছে। এর ফলে এ খাত থেকে সরকার ঋণ তো পাচ্ছেই না উল্টো মোটা অংকের টাকা অন্য খাত থেকে এনে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
তথ্য অনুযায়ী, সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকারের নেয়া ঋণের পুঞ্জীভূত পরিমাণ ২০২৩ সালের এপ্রিলে ছিল ৩ লাখ ৬০ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা, যা চলতি এপ্রিলে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এক বছরে ৭ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা ঋণ কমেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তিন কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমছে। জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) ও ৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা; সঞ্চয়পত্রের সুদের বিপরীতে উচ্চ করারোপ ও সুদ কমানো এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংকে আমানতের সুদ বৃদ্ধি। ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে এনআইডি ও টিআইএন জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা শুরু হয়। ফলে যারা আগে সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন, তাদের অনেকেই মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে নতুন করে আর এতে বিনিয়োগ করেননি।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকারের নেয়া ঋণের পুঞ্জীভূত পরিমাণ ২০২৩ সালের এপ্রিলে ছিল ৩ লাখ ৬০ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা, যা চলতি এপ্রিলে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এক বছরে ৭ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা ঋণ কমেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার।
৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ওপর অর্জিত সুদের বিপরীতে ১০ শতাংশ কর দিতে হয়। এছাড়া বিনিয়োগের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে সঞ্চয়পত্রের সুদের হারের যে স্তর চালু করা হয়েছে, তাতে নতুন বিনিয়োগে বিমুখ হয়েছেন অনেকেই।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাসে দেশে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। গত বছরের মার্চে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ শতাংশে অতিক্রমের পর তা আর কোনো মাসেই ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। অর্থাৎ ১৫ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন একশ্রেণির বিনিয়োগকারী। আবার অতি হিসাবি বিনিয়োগকারী কর কাটার পর যা পাচ্ছেন, মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় তাতে লাভ খুঁজে পাচ্ছেন না।
সুতরাং উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন একশ্রেণির বিনিয়োগকারী। আবার অতি হিসাবি বিনিয়োগকারী কর কাটার পর যা পাচ্ছেন, মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় তাতে লাভ খুঁজে পাচ্ছেন না। আইএমএফের পরামর্শে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়ানো হয়েছে। সেজন্য কেউ কেউ সঞ্চয়পত্র ভেঙে উচ্চ সুদে ব্যাংকে আমানত রাখছেন বলে অনুমান করেন বিশ্লেষকরা।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের যে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে, তাতে বিভিন্ন শর্তের মধ্যে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকারের ঋণ বিষয়ক শর্তও রয়েছে। এটি হচ্ছে, ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সঞ্চয়পত্রকে সরকারের মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের এক-চতুর্থাংশের মধ্যে রাখতে হবে।