এস আলমের মোট ঋণ ৩১৮৯৯ কোটি, মেয়াদোত্তীর্ণ ৩৩১০ কোটি টাকা
নানা কারণে বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় চলে আসে এস আলম গ্রুপ। চট্টগ্রামভিত্তিক এ শিল্পপ্রতিষ্ঠান ১৯৮৫ সালে যাত্রা করে। এরপর থেকেই অনিয়মের মাধ্যমে নিজেদের বাণিজ্যের বিস্তার ঘটাতে থাকে। শুরু থেকে এ শিল্প পরিবারটির দৃষ্টিতে ছিল ব্যাংকিং খাত। পর্যায়ক্রমে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, আল-আরাফাহ ইসলামি ব্যাংক লিমিটেড, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড, ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড, গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংক লিমিটেড নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। তারপর ইচ্ছামতো ঋণ তুলে নিতে থাকে তারা। যার মধ্যে ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বড় ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে ২০২২ সালে। ওই বছর ইসলামী ব্যাংকে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে। উচ্চ আদালত এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এ ঋণের নথিও তলব করে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে থেমে যায় সব কিছু।
এরপর সামনে আসে গ্রুপটির অর্থপাচারের ইস্যু। এ ছাড়া এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে কাগুজে কোম্পানি খুলে, অনিয়মের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির অভিযোগও রয়েছে। যদিও উচ্চ আদালত এস আলম গ্রুপের এসব অনিয়মের দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক বা বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউকে তদন্ত না করার নির্দেশনা জারি রেখেছে। ফলে গ্রুপটির অধিকাংশ আর্থিক অনিয়মই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
এস আলম গ্রুপের সিআইবির (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) রিপোর্টে দেখা গেছে, এ মুহূর্তে গ্রুপটির মোট ব্যাংক ঋণ ৩১,৮৯৯ কোটি ২৮ লাখ ৮২৫ টাকা। যার মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে ৩৩১০ কোটি ১০ লাখ ৬৯ হাজার ৪৭ টাকা। এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ, বছরের পর বছর কোনো টাকা না দিয়েই ঋণ নিয়মিতকরণ হচ্ছে। কিন্তু ঋণখেলাপি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না গ্রুপটির কোনো পরিচালক। যদিও বাংলাদেশ বাংকের হিসাব বলছে, প্রতিষ্ঠানটির কাছে যে পরিমাণ ব্যাড লোন আছে, তা যদি সঠিকভাবে হিসাব করা হয়, তাহলে এ প্রতিষ্ঠানের কোনো পরিচালক কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে থাকার কথা নয়। যদিও অদৃশ্য কারণে সবই জায়েজ করে নিচ্ছে এস আলম পরিবার।
আব্দুল্লাহ হাসান এস আলম গ্রুপের ১৯টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পরিচালক। বিভিন্ন ব্যাংকে তার ঋণ রয়েছে ৩১৩ কোটি ৭ লাখ ৪১ হাজার ১৯৫ টাকা।
আব্দুস সামাদ এস আলম গ্রুপের ১৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পরিচালক, অন্তত ২টি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও ৩টি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে তার ঋণ রয়েছে ৩০৭ কোটি ২৬ লাখ ৫৩ হাজার ৮০৯ টাকা। এ ছাড়া গ্যরান্টার হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ রয়েছে ৫১৫ কোটি ১৬ লাখ ৯৭ হাজার ৬২ টাকা।
আহসানুল আলম এস আলম গ্রুপের ৩টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। এর মধ্যে ১টির চেয়ারম্যান ও ১টির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আছেন তিনি। বিভিন্ন ব্যাংকে তার ঋণ রয়েছে ৭৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা।
মোহাম্মদ সাইফুল আলমের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে ঋণের গ্যরান্টার হিসেবে ঋণ আছে ১০৭২ কোটি ৪৯ লাখ ৭১ হাজার ৩৪৩ টাকা। এর মধ্যে ১৩৬ কোটি ৬৩ লাখ ৫৬ হাজার ২৫৮ টাকা ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
এস আলম গ্রুপের আরেক অন্যতম পরিচালক সহিদুল আলমের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ রয়েছে ৩২৬১ কোটি ৮৭ লাখ ৮৯ হাজার ৮০০ টাকা।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ক্যপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লি. এর চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন সাইফুল আলম। এ প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ রয়েছে ১৪১ কোটি ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৯০৭ টাকা।
গ্যালকো স্টিল বিডি লি. এর নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ রয়েছে ৩৫২ কোটি ৫৬ লাখ ৮১ হাজার ৩৩৫ টাকা। আর এই প্রতিষ্ঠানটির নন ফান্ডে ঋণ রয়েছে ১০ কোটি ২২ লাখ ৭৮ হাজার ৭০৩ টাকা।
এস আলমের মালিকানা প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স ব্রোকারেজ সার্ভিস লি. এর বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ রয়েছে ৬০ কোটি ১৬ লাখ ২৬ হাজার ৮৪৮ টাকা। ২০০৩ সালে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করা এস আলম ব্রাদার্সের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ রয়েছে ৪১১ কোটি ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ৩২০ টাকা।
এস আলম পাওয়ার লি. এর কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের নন ফান্ডেড ঋণ রয়েছে ৪ কোটি ৪০ লাখ ৫৯ হাজার ৭১৯ টাকা।
এস আলম রিফাইনড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লি. এর কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ রয়েছে ৬৫৯০ কোটি ৭৩ লাখ ৯৬ হাজার ১৩৫ টাকা। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ হয়ে গেছে ৫৭৭ কোটি৫৪ লাখ ৮৯ হাজার ২৩০ টাকা। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন ব্যাংকের নন ফান্ডেড ঋণ রয়েছে ১২৫৩ কোটি ৯৫ লাখ ১৫ হাজার ৩৭০ টাকা।
এস আলম কোল্ড রোলড স্টিল লি.। ২০০০ সালে যাত্রা শুরু করা এ প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ঋণ রয়েছে ৪৭৫৪ কোটি ১৬ লাখ ৮৯ হাজার ৪৭৮ টাকা। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ হয়ে গেছে ৮৩৬ কোটি ৪৭ লাখ ৮৫ হাজার ১৫৩ টাকা। এছাড়া নন ফান্ডেড ঋণ রয়েছে ৫৬৬ কোটি ৩৪ লাখ ১২ হাজার ৯২২ টাকা।
১৯৯৫ সালে কার্যক্রম শুরু করা এস আলম স্টিলস লি. এর বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণ রয়েছে ৩২৮ কোটি ৩৫ লাখ ২১ হাজার ৯৮২ টাকা। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির নন ফান্ডেড ঋণ আছে ১৯ কোটি ৫ লাখ ৩৯ হাজার ১৪০ টাকা।
২০০৩ সালে কার্যক্রম শুরু কার এস আলম ট্রেডিং কোম্পানি প্রাইভেট লি. এর বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ রয়েছে ২৫৫৭ কোটি ৬১ লাখ ৯৯ হাজার ১৩৪ টাকা। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ হয়ে গেছে ৭৩২ কোটি ২৫ লাখ ৩ হাজার ৫৭৮ টাকা। এছাড়া নন ফান্ডেড ঋণ রয়েছে ৩৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৫ হাজার ৪৪ টাকা।
এস আলম ভেজিটেবল অয়েল লি. ব্যবসা শুরু করে ২০০০ সালে। প্রতিষ্ঠানটির নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে ৭৭৯৩ কোটি ৬৪ লাখ ৭ হাজার ৮০০ টাকা। এর মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৭৮ কোটি ৮৬ লাখ ৭৫ হাজার ৬২৮ টাকা। এ ছাড়া নন ফান্ডেড ঋণ রয়েছে আরো ১৩১৮ কোটি ৩৪ লাখ ৭২ হাজার ২৯৮ টাকা।
এস আলম ব্যাগ ম্যনুফ্যকচারিং মিলস লি. এর নামে ঋণ রয়েছে ৯৬ লাখ ৫ হাজার ৬৬৮ টাকা।
এস আলম সিমেন্ট লি. এর নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ রয়েছে ১৬৩ কোটি ৭০ লাখ ৯১ হাজার ৫৩৩ টাকা। নন ফান্ডেড ঋণ রয়েছে ৫৫ কোটি ৮ লাখ ৭৩ হাজার ৯০৩ টাকা।
সোঁনালী কার্গো লজিস্টিকস প্রাইভেট লি. এর ব্যাংক ঋণ রয়েছে ১৫৭ কোটি ৭৬ লাখ ৫২ হাজার ১৭৮ টাকা।
এসএস পাওয়ার লি. এর ব্যাংক ঋণ আছে ১৯২ কোটি ৬৭ লাখ ৫২ হাজার ৯৭ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির নন ফান্ডেড ঋণ বকেয়া পড়ে আছে ৩৪৮ কোটি ৩২ লাখ ৫৯ হাজার ২০০ টাকা।
এসব বিষয়ে দ্য মিরর এশিয়ার পক্ষ থেকে এস আলম গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কোনো সাড়া মেলেনি। কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক।