আইএমএফের কর্মসূচি সফল করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ
করোনাকালীন ক্ষতি, বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরো বেশি চাপের মুখে ফেলেছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর এই চাপ মোকাবিলা এবং আসন্ন অর্থনৈতিক পতন আটকাতে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রকল্প অনুমোদন দেয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ নীতি সংশোধনের মধ্যে দিয়ে সামষ্টিক অর্থনৈতিক সমন্বয়, কাঠামোগত সংস্কার এবং প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিশালীকরণের কাজ গুলো করবে।
আইএমএফেএর প্রকল্পটি ছয়টি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল। সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় অংশের অনেক শর্ত পূরণ করতে সফল হয়েছিল এবং এইএমএফকে আরো কিছু বিষয়ে আরো নমনীয় হতে রাজি করিয়েছিল। বস্তুত, এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি সংস্কার হল বিনিময় হার এবং সুদের হারের নমনীয়তা। তবে রাজস্ব সংশোধন হয়নি এবং কর, ভর্তুকি, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগ, বাণিজ্য নীতি এবং ব্যাংকিং খাতে কাঠামোগত সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকার যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি।
আইএমএফ ৯টি ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার জায়গা চিহ্নিত করেছে, যা তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। সেই সঙ্গে সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে এবং একটি টেকসই প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু করতে বাংলাদেশের সক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এই ঝুঁকির মধ্যে পাঁচটি বৈশ্বিক এবং চারটি অভ্যন্তরীণ।
বৈশ্বিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে- আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব, পণ্যমূল্যের অস্থিরতা, বৈশ্বিক মন্দা, আর্থিক অস্থিতিশীলতা এবং ভূ-অর্থনৈতিক বিভাজন। অভ্যন্তরীণ ঝুঁকির মধ্যে- বাজারভিত্তিক নমনীয় বিনিময় ব্যবস্থা বজায় রাখতে ব্যর্থতা, ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের সমাধানে ব্যর্থতা, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে অপর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা।
এই ঝুঁকিগুলোর ভেতর অনেকগুলো কয়েক দশক ধরে দেশে বিরাজ করছে। ঝুঁকিগুলোর প্রধান নীতিগত অন্তর্নিহিততা হল সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা এবং যত দ্রুত সম্ভব টেকসই প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়া আবার শুরু করা।
অভ্যন্তরীণ ঝুঁকির ভেতর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল রোহিঙ্গা সংকট। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাতে বাংলাদেশ যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। আর্থিক সংস্কারের অগ্রগতি রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান পেতে সহায়তা করবে।
জলবায়ু সম্পর্কিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি একটি দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ। যদিও স্বীকার্য যে, জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা গড়ে তোলার জন্য নীতি ও কর্মসূচি প্রবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া এখনো পর্যন্ত দুর্বল। বিশেষ করে পরিকল্পনা, বাজেট, প্রণোদনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন নীতিগুলোকে পুনর্বিন্যাস করার ক্ষেত্রে।
আইএমএফ প্রকল্প অনুমোদনের ১৮ মাস পার হয়ে গেছে এবং ব্যাংকিং খাতে সামান্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। ব্যাংকিং সংস্কারে অর্থপূর্ণ অগ্রগতি না হলে আইএমএফের কর্মসূচির সামগ্রিক গুণমান ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক কাঠামোর অন্যতম দিক হল রাজস্ব নীতির দুর্বলতা। এটি বাংলাদেশের উন্নয়ন কৌশলের সবচেয়ে বড় দুর্বল দিক, যার অগ্রগতি দীর্ঘকাল ধরে স্থবির অবস্থায় আছে। আইএমএফের কর্মসূচি কিছুটা অগ্রগতি এনেছে, কিন্তু কর সংস্কার কর্মসূচির বেশিরভাগ প্রাতিষ্ঠানিক এবং কাঠামোগত দিকগুলোর কোনো সুরাহা হয়নি।
আরেকটি বড় কাঠামোগত সংস্কার যেখানে খুব সামান্য অগ্রগতি হয়েছে তা হল বাণিজ্যিক সুরক্ষা। এটি আরেক দীর্ঘস্থায়ী চ্যালেঞ্জ। সম্পূরক এবং নিয়ন্ত্রক শুল্কসহ কর রাজস্বের উপর অত্যধিক নির্ভরতা, আইএমএফের কর্মসূচির সঙ্গে বাণিজ্য সংস্কারের অগ্রগতি রোধ করেছে।
বাংলাদেশের দুর্বল অর্থনৈতিক কাঠামোকে সবল করতে এই প্রত্যেকটি চিহ্নিত খাতে কেন অগ্রগতি হয়নি, চ্যালেঞ্জগুলো কী, সেটা খুঁজে করতে বের করতে হবে এবং দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। তাহলেই আইএমএফের কর্মসূচিগুলোর সফল বাস্তবায়ন ঘটানো সম্ভব হবে।