৭ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা রফতানি বেশি দেখিয়েছে ইপিবি
১০ অর্থবছরে প্রায় ৬৫ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলার রফতানি বেশি দেখিয়েছে সরকারি সংস্থা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। টাকার অংকে যা ৭ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা বা চলতি অর্থবছরের বাজেটের প্রায় সমান। শুধু গেল অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে প্রকৃত রফতানির তুলনায় প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার বেশি দেখিয়েছে সংস্থাটি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, রফতানি বাড়িয়ে দেখানোর বিষয়টি খোদ রফতানি খাতের ব্যবসায়ীরা বেশ আগে থেকে বলে আসছেন। ইপিবির তথ্যের সঠিকতা নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তোলেন অনেকে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ইপিবির তথ্যে বড় পার্থক্য নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে রিপোর্ট হয়েছে। অদৃশ্য কারণে সরকার এতদিন বিষয়টি আমলে নেয়নি; বরং ভুল তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে।
এদিকে, রফতানি তথ্যে গোঁজামিল নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের সমালোচনার মধ্যে আজ ইপিবিতে সরকারি চার সংস্থার বৈঠক ডাকা হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং ইপিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। বৈঠকে কেবল গত দুই অর্থবছরের তথ্য সংশোধন করা হবে, নাকি আগের ভুল সংশোধন হবে– সে বিষয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়া সব ধরনের সরকারি তথ্যের সঠিকতা নিশ্চিত করা এবং নিজেদের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর মাধ্যমে বিভিন্ন ত্রুটি নিরসনসহ অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা হবে। আবার ইপিবির মূল কাজ রফতানি উন্নয়নে কাজ করা। আর সরকারি পরিসংখ্যান প্রকাশের দায়িত্ব পরিসংখ্যান ব্যুরোর। ফলে আগামীতে ইপিবির পরিবর্তে বিবিএস থেকে রফতানির তথ্য প্রকাশ করা হবে কিনা, তা নিয়েও আলোচনা হবে।
তবে সম্প্রতি আইএমএফ প্রকৃত রফতানির সঙ্গে এনবিআরের তথ্যে এত পার্থক্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও ইপিবি কয়েক দফা বৈঠক করে পরীক্ষামূলকভাবে বেশকিছু রফতানি বাড়িয়ে দেখানোর বিষয়টি খোদ রফতানি খাতের ব্যবসায়ীরা বেশ আগে থেকে বলে আসছেন। ইপিবির তথ্যের সঠিকতা নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তোলেন অনেকে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ইপিবির তথ্যে বড় পার্থক্য নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে রিপোর্ট হয়েছে। অদৃশ্য কারণে সরকার এতদিন বিষয়টি আমলে নেয়নি; বরং ভুল তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন তথ্য যাচাই করে। সেখানে একই রপ্তানি একাধিকবার দেখানো, রফতানি নয় এমন তথ্য দেওয়াসহ বিভিন্ন অসংগতি ওঠে আসে। প্রকৃত রফতানির সঙ্গে এত বেশি পার্থক্য বের হওয়ার পর সরকারি তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
গত বৃহস্পতিবার নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ২০২২ সালের নভেম্বরে হঠাৎ করে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের বেশি রফতানি দেখানো হলো। তখন এ নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি কথা বলেন। তার বক্তব্য ছিল– এত রফতানি ব্যবসায়ীরা করেননি। এটা কে করেছে, তাদের জানা নেই। তবে তাদের বক্তব্য আমলে না নিয়ে বরং কেন তিনি সরকারি তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। এ ভুল তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন নীতি করা হয়েছে। তাদের সুবিধা কমানো হয়েছে। এরই মধ্যে রফতানিতে প্রণোদনার হার কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে রফতানিকারকদের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কার স্বার্থে এটা করা হচ্ছে, বোধগম্য নয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যের ভিত্তিতে ইপিবি রফতানির তথ্য প্রকাশ করে। আর ইপিবির তথ্যের আলোকে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের (বিওপি) রিপোর্ট প্রস্তুত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক স্থানীয় ব্যাংক থেকে প্রকৃত রফতানির তথ্য সংগ্রহ করে। গত এপ্রিলে প্রথমবারের মতো প্রকৃত রফতানির হিসাব ধরে বিওপির তথ্য প্রকাশের ফলে বড় বিভ্রাট ধরা পড়ে, যা সব হিসাব ওলটপালট করে দেয়।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে আসলে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলারের পণ্য জাহাজীকরণ হয়েছে। যেখানে ইপিবি দেখিয়েছে ৪ হাজার ৭৪৭ কোটি ডলার। এতে গত মার্চ পর্যন্ত চলতি হিসাবে যেখানে ৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত দেখানো হয়েছিল। এপ্রিলে এসে ঘাটতি ধরা পড়ে ৫ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। আর আর্থিক হিসাবে মার্চ পর্যন্ত ৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ঘাটতির পরিবর্তে এপ্রিলে ২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছে।
রফতানির এই ভুল তথ্যের ফলে বিওপির হিসাবে ওলটপালট নিয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়ে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চিঠিতে বলা হয়, এনবিআরের তথ্যে একই ইএক্সপি এবং পণ্যের এইচএস কোডের একাধিক এন্ট্রি পাওয়া গেছে। সিএমটির ক্ষেত্রে শুধু মেকিং চার্জ রফতানি হিসেবে দেখানোর নিয়ম থাকলেও এনবিআর কাপড়ের দরসহ সবই রফতানি দেখিয়েছে।
স্যাম্পল আইটেমও রফতানি দেখানো, ইপিজেড থেকে দেশের ভেতরে বিক্রিকে রফতানি দেখিয়ে পরে পুনরায় রফতানি বিবেচনা করা হয়। সাধারণত শুরুর এলসি মূল্যের তুলনায় প্রকৃত রফতানি মূল্য কম পাওয়া গেলেও ইপিবি তা বাদ দেয় না। এ ছাড়া স্টক লট, ডিসকাউন্ট এবং কমিশনজনিত ক্ষয়ক্ষতি ইপিবি সমন্বয় করে না। এতদিন রফতানির পণ্য জাহাজীকরণ এবং প্রকৃত রফতানি আয়ের ব্যবধানের কারণে বিওপিতে ট্রেড ক্রেডিট উল্লেখযোগ্য হারে বেশি ছিল। এখন সঠিক পরিসংখ্যানের ফলে ব্যালান্স অব পেমেন্ট (বিওপি) ওলটপালট হয়ে গেছে।
কোন বছরে কত বেশি দেখানো হয়েছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর (এপ্রিল) পর্যন্ত ১০ বছরে প্রকৃতপক্ষে রফতানি হয়েছে ৩৪০ বিলিয়ন ডলার। এ সময়ে ইপিবির হিসাবে রফতানি দেখানো হয়েছে ৪০৫ বিলিয়ন ডলার। এর মানে প্রকৃত রফতানির তুলনায় গত ১০ বছরে বেশি দেখানো হয়েছে ৬৪ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের রফতানির চূড়ান্ত হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি। তবে এপ্রিল পর্যন্ত আসলে ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার রফতানি হলেও দেখানো হয়েছে ৪৭ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার। এর মানে বেশি দেখানো হয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার।
২০২২-২৩ অর্থবছরে আসলে রফতানি হয়েছিল ৪৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। তবে ইপিবি দেখিয়েছিল ৫৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। একইভাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার, তার আগের অর্থবছরে ৪ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন এবং তার আগের অর্থবছরে ৩ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার বেশি দেখানো হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আসলে ৩৩ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের রফতানি হলেও দেখানো হয় ৪০ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। তার আগের অর্থবছরে ৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন, তার আগের অর্থবছরে ৪ বিলিয়ন এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার বেশি দেখিয়েছে সরকারি সংস্থা ইপিবি।
রিজার্ভ আসলে কত
আইএমএফের প্রশ্নের মুখে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাবেও বড় পরিবর্তন হয়েছে। এতদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেদের মতো করে রিজার্ভের একটি হিসাব প্রকাশ করত। তবে গত বছরের জুলাই থেকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি বিপিএম৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী হিসাব প্রকাশ করতে হচ্ছে। সে অনুযায়ী গত জুন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। আর নিট রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। প্রথমবারেরর মতো যা প্রকাশ করা হলো। এ ছাড়া ইডিএফসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগসহ এতদিন যে উপায়ে হিসাব করা হতো, সে অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ ২৬ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। দেশের ইতিহাসে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ উঠেছিল সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার।