ব্যাংকে ব্যাংকে বিক্ষোভ, অনিয়মকারী ও দখলদার তাড়ানোর মিশন

ব্যাংকে ব্যাংকে বিক্ষোভ, চলছে অনিয়মকারী ও দখলদার তাড়ানোর মিশন

 ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়েছে। এরপর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে আর্থিক দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও দখলদারদের বিতাড়িত করতে বিক্ষোভ করছেন ব্যাংকাররা। তারা বলছেন, ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন অনিয়ম-দুর্নীতি, দখলদার আর ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে পুরো আর্থিক খাতে ভঙ্গুর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এসব অপকর্মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিতাড়িত করে দ্রুত বিচারের দাবি জানান ব্যাংক কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর প্রথম কার্যদিবসে প্রথমে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংকে বিক্ষোভের শুরু হয়। এরপর বুধবার (৭ আগস্ট) বাংলাদেশ ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এর ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) বেসরকারি খাতের অনেক ব্যাংকে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সবমিলিয়ে দেশের ব্যাংক খাত এক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

গত মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম কর্মদিবসে ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক দখলের পর পদায়ন পাওয়া এক্সিকিউটিভসহ (নির্বাহী কর্মকর্তারা) যারা অবৈধভাবে নিয়োগ পেয়েছেন তাদের নিয়োগ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। এসব নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় এস আলম গ্রুপের নির্দেশে নিয়োগপ্রাপ্ত বলে দাবি ইসলামী ব্যাংকের সিবিএ নেতাদের। পরে বুধবার এস আলমের আমলে পদোন্নতি পাওয়া অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) কায়সার আলী ব্যাংকে এলে তাকে জোর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।

শুধু তাই নয়, বৃহস্পতিবার রাজধানীর দিলকুশায় ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে কয়েকজনকে মারধর করে বের করে দিতে দেখা গেছে। এর আগে ব্যাংকের আরেক ডিএমডি রেজাউর রহমানকে মারধর করেছেন ব্যাংকটির লোকজন। এ ছাড়া এস আলমের ‘বিশেষ কৃপায়’ পদোন্নতি পাওয়া আরও অন্তত চার-পাঁচজনকে মারধর করেছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।

বুধবার (৭ আগস্ট) নজিরবিহীন বিক্ষোভ হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। ওইদিন বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের চার ডেপুটি গভর্নর। তারা হলেন– কাজী সাইদুর রহমান, খুরশীদ আলম, হাবিবুর রহমান এবং নুরুন নাহার। এর মধ্যে কাজী সাইদুর রহমান ক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সাদা কাগজে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেন।

অন্যরা পদত্যাগ করবেন জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ত্যাগ করেন। আর বিএফআইইউ প্রধান মাসুদ বিশ্বাস এবং নীতি উপদেষ্টা আবু ফরাহ মো. নাসেরকে বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকতে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিক্ষোভকারী কর্মকর্তারা।

এদিকে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর খোঁজ মিলছে না গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে আসছেন না। অনেকে বলছেন দেশ থেকে পালাতে তিনি অনেক মহলে দেনদরবার করে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকদের পক্ষ থেকে মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, কর্মকর্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়েছেন। এ ছাড়া অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশসহ সব আইন সংশোধন করতে বলেছেন। এ ছাড়া তারা সব ডেপুটি গভর্নর, বিএফআইইউ প্রধান ও নীতি উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেন। তবে তারা সরকারের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায় সরকারের কাছেই পদত্যাগপত্র দিতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর বিবেচনার জন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া ব্যাংকের সব পর্যায়ের কর্মকর্তার সুশৃঙ্খলভাবে দায়িত্ব পালনের সিদ্ধান্ত হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যাংক খাতের সব কাজ স্বাভাবিক নিয়মে চলবে।

কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংক খাতের ভঙ্গুরতার কারণে দেশে অর্থনীতির আজকের এই খারাপ অবস্থা তৈরি হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ কষ্টে আছে। তাই গভর্নরসহ বিভিন্ন অনিয়মে দায়ী কর্মকর্তা যেন দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন, সে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং বিচার করতে হবে। এ ছাড়া যেসব নির্বাহী পরিচালক অনিয়মে সহায়তা করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রাথমিকভাবে তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে হবে।

বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) গুলশানে বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন ব্যাংকের দেড় শতাধিক শেয়ারধারী। ওই সময় তারা বিভিন্ন ফেস্টুন প্রদর্শন করে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর ‘বিদেশে অর্থ পাচার’ ও ব্যাংকটির নানা অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ উত্থাপন করেন।

ইউসিবির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বাবা চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী। শুরু থেকে ব্যাংকটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এম এ হাসেম। তারা বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত উভয়ের পরিবারের সদস্যরাই ব্যাংকটিতে যুক্ত ছিলেন ও নেতৃত্ব দেন।

ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে পারটেক্স গ্রুপের মালিক পরিবারের সদস্যদের ইউসিবি ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। ব্যাংকটির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নেন সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্ত্রী রুকমিলা জামান। তবে রুকমিলা জামান যুক্তরাজ্যে অবস্থান করায় ব্যাংকটি মূলত সাইফুজ্জামান চৌধুরী পরিচালনা করেন, এমনটাই জানিয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। তাদের অভিযোগ ২০১৭ সাল থেকে ব্যাংকটিকে একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে ‘অবাধ লুটপাট, আর্থিক দুর্নীতি ও বিদেশে টাকা পাচার’ করা হয়েছে। ফলে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০১৭ সালে ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সাল শেষে বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা।

এদিকে, করোনা মহামারির সময় চাকরিচ্যুত বেশ কিছু ব্যাংক কর্মকর্তারা চাকরি ফেরত পেতে আইএফআইসি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। এসময় তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার ২১ বাস্তবায়ন করে তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল করার দাবি জানান।

তারা জানান, সার্কুলার অনুযায়ী ব্যাংকের চাকরিতে পুনর্বহালে আবেদন করলেও ব্যাংকগুলো তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল না করায় বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর বরাবর আবেদনসহ বিভিন্ন ব্যাংকের ৫০ জন ব্যাংক কর্মকর্তা একত্রে হাইকোর্টে রিট করেন। পরে হাইকোর্ট রুলের শুনানি শেষে রিটকারী মোট ৪৭ জন ব্যাংক কর্মকর্তাদের চাকরিতে পুনর্বহালের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেন। কিন্তু তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।

বেসরকারি খাতের সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তাদের পুনর্বহালের দাবিতে, ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডারদের একটি গ্রুপ এবং সিটি ব্যাংক ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে বিক্ষোভ করেছেন কর্মকর্তারা। এ ছাড়া অসন্তোষ দেখা দিয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংকে। এ ছাড়া বুধবার রাষ্ট্রীয় মালিকানার সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকে বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা বিক্ষোভ করেন।