বিপিডিবির বকেয়া দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার কোটিতে
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) বকেয়া বিলের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা, যা নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য একটি জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিদ্যুৎ বিভাগে সর্বশেষ আর্থিক হিসাব জমা দেওয়া হয়েছে, যাতে বিদ্যুৎ খাতের ওপর ব্যাপক আর্থিক চাপের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
দাপ্তরিক ও খোলা বাজার উভয় বিনিময় হার ব্যবহার করে বিপিডিবির প্রতিবেদনে ঋণের হিসাব করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, দাপ্তরিক হিসাবে প্রতি ডলার ১১৭ টাকা দরে প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৮৪৬ বিলিয়ন ডলার এবং খোলা বাজারের দর অনুযায়ী ১২৪ টাকা করে হিসাব করলে তা হয় ৪ দশমিক ৩৫৪ বিলিয়ন ডলার।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এই খাতের বর্তমান চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে অবহিত করার উদ্দেশ্যেই এই আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে।
বিপিডিবির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতের পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) স্পষ্ট ধারণা দেওয়ার জন্যই আমরা আয়-ব্যয়ের এই তালিকা তৈরি করেছি।’
বিপিডিবির দায়ের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে গিয়ে দেখা যায়, শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত পেট্রোবাংলার আওতাধীন বিভিন্ন গ্যাস কোম্পানির কাছেই প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। বাকি অর্থ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রকে পরিশোধ করতে হবে তাদের।
বিদ্যুৎ খাতের নগদ অর্থের সংকট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। অনেকে বর্তমান সংকটের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের নীতিকে দায়ী করছেন।
এই খাতকে মুনাফাভিত্তিক শিল্পে রূপান্তরের সমালোচনা করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, “এতে নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠী লাভবান হচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতে অসম প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টির মূলে রয়েছে ‘বিদ্যুৎ ও শক্তির দ্রুত সরবরাহ (বিশেষ) আইন ২০১০’।”
বিদ্যুৎ খাতের আর্থিক দুর্দশা নতুন কিছু নয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ক্রমবর্ধমান বকেয়া বিল ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যার মধ্যে ৪ বিলিয়ন ডলার শুধু বিদ্যুৎ খাতেরই।
ভারত থেকে ২,৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদকদের (আইপিপি) কাছ থেকে ডলারে বিদ্যুৎ কেনার বাধ্যবাধকতা থাকায় বিপিডিবির আর্থিক চাপ আরও বেড়েছে। ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের ১,৫০০ মেগাওয়াটই আসে আদানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা মেটাতে প্রতিদিন আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে কমপক্ষে ৪০ মিলিয়ন ডলার (৪ কোটি ডলার) প্রয়োজন হয়, কিন্তু আমরা প্রতিদিন পাচ্ছি মাত্র ৫-৭ মিলিয়ন ডলার।’
এসএস পাওয়ার, পায়রা, রামপাল এবং আদানির মতো বড় বিদ্যুৎ উৎপাদকদের বৈদেশিক মুদ্রায় অর্থ প্রদানের বাধ্যবাধকতা থাকায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে গেছে। বাকিদের স্থানীয় মুদ্রায় অর্থ প্রদান করা গেলেও তাদের সঙ্গে চুক্তিতেও নির্ধারিত বৈদেশিক মুদ্রায় এই অর্থ রূপান্তর করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
তবে এই সংকট শুধু বিদ্যুত খাতে নয়, এর বাইরেও বিস্তৃত। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৬২ হাজার ১৩২ কোটি ৬১ লাখ টাকা) ব্যয়ে প্রায় ৬৮ লাখ ৬০ হাজার টন পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য আমদানি করা হয়েছে, যা জ্বালানি খাতের আর্থিক চাপে আরও একটি ধাপ যুক্ত করেছে।