রেমিট্যান্সের প্রভাবে বেড়েছে রিজার্ভ

রেমিট্যান্সের প্রভাবে বেড়েছে রিজার্ভ

দেশে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়েছে। প্রবাসীরা এখন গত কয়েক মাসের তুলনায় বেশি পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। প্রবাসী আয় বাড়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ছে। তবে নেট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (এনআইআর বা ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ) এখনো ১৫ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করতে পারেনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টে সর্বোচ্চ উঠেছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার (৪৮ বিলিয়ন)। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি সেপ্টেম্বর মাসের ২৫ তারিখ পর্যন্ত গ্রস রিজার্ভ ২ হাজার ৪৬৭ কোটি মার্কিন ডলার বা ২৪ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ এখন এক হাজার ৯৫৬ কোটি ডলার ( ১৯ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন)। গত সপ্তাহে অর্থাৎ ১৮ সেপ্টেম্বর গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৫২ ‍বিলিয়ন এবং বিপিএম-৬ ছিল ১৯ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন। সেই হিসাবে রিজার্ভ সামান্য বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা জানান, গত জুলাই থেকে আগস্ট মাসে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়েছে। প্রবাসীরা বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি বাড়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বেড়েছে। শুধু তাই নয়, রিজার্ভের পতন থামানো গেছে। এখন বাড়ছে।

গ্রস রিজার্ভ ও বিপিএম-৬ এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেওয়া হয়। প্রকাশ করে না। চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (এনআইআর) বা ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ আছে এক হাজার ৪৪৫ কোটি মার্কিন ডলার (১৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার)। প্রতি মাসে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার হিসেবে এ রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে না। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম ৩ মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। একটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম সূচক হলো বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পক্ষ থেকে সেপ্টেম্বরের জন্য বেঁধে দেওয়া ব্যয়যোগ্য রিজার্ভের লক্ষ্য ১৪ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার।

দেশে চলমান সংকট কাটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি না করার ঘোষণা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু চাহিদা ঠিক রাখতে গিয়ে প্রতিশ্রুতি উপেক্ষা করে চলতি সেপ্টেম্বরেও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্য দিয়ে চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে।  

গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রির করেছিল ১২ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। তার আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিক্রি করে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২১-২২ অর্থবছরের ছিল ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।

আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নজিরবিহীন অর্থপাচার, বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা কারণে কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বড় ধরনের চাপের মুখে পড়ে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন (রিজার্ভ)। বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ে ক্রমাগত চলতি হিসাবের ঘাটতিও বেড়েছিল বাংলাদেশের। ডলারের বিপরীতে টাকা দর অবনমন হতে থাকলে প্রভাব পড়ে জ্বালানির দর ও আমদানিতে।

তখন দ্রুত ক্ষয় হতে থাকা রিজার্ভ বাড়াতে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার সহায়তা নিতে আইএমএফ এর কাছে ৪৭০ কোটি ডলারের এই ঋণ চেয়ে আবেদন করে ২০২২ সালের জুলাইতে। বিভিন্ন ধাপের আলোচনার পর ওই ওই বছরের নভেম্বরে ঋণ চুক্তি অনুমোদন দেয় সংস্থাটি। প‌রে ২০২৩ সা‌লের ৩০ জানুয়ারি আইএমএফের সঙ্গে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি করে বাংলাদেশ। এর তিন দিন পর প্রথম কিস্তিতে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার  ছাড় করে সংস্থাটি। এর পর গত ১৬ ডিসেম্বর দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার এবং জুনে তৃতীয় কিস্তির ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড় করা হয়। সব মিলিয়ে তিন কিস্তিতে প্রায় ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী, ২০২৬ সাল পর্যন্ত মোট সাতটি কিস্তিতে ঋণের পুরো অর্থ ছাড় করার কথা রয়েছে। ঋণচুক্তির চতুর্থ কিস্তি ছাড় হওয়ার কথা চলতি বছরের ডিসেম্বরে।

বাংলাদেশকে দেওয়া ঋণের অন্যতম শর্ত একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রিজার্ভ সংরক্ষণ রাখতে হবে। সেই হিসেবে আইএমএফ এর পক্ষ থেকে সেপ্টেম্বরের জন্য বেঁধে দেওয়া ব্যয়যোগ্য রিজার্ভের লক্ষ্য ১৪ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার।

এদিকে ব্যাংক খাত সংস্কার, অর্থ পাচার প্রতিরোধ, কর ব্যবস্থাপনা, আয়কর ও ভ্যাট সংস্কারে নতুন করে আরও তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা চেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বাংলাদেশকে নতুন করে ঋণ দেওয়ার বিষয় ইতিবাচক রয়েছে আইএমএফ—বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ২১ দিনে দেশে বৈধ পথে ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৬৩ কোটি ৪২ লাখ (১ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ১৯ হাজার ৬১১ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে)। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি সেপ্টেম্বরে দৈনিক গড়ে রেমিট্যান্স এসেছে ৭ কোটি ৭৮ লাখ ২০ হাজার ডলার। এই হারে রেমিট্যান্স আসতে থাকলে মাস শেষে প্রাবাসী আয় ২৩৩ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলছে খাত সংশ্লিষ্টরা।

গত আগস্ট মাসে দেশে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এসেছে ২২২ কোটি মার্কিন ডলার (২ দশমিক ২২ বিলিয়ন)। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ২৬ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। তার আগের মাস জুলাইয়ে এসেছিল ১৯০ কোটি মার্কিন ডলার।