অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে অগ্রণী ব্যাংকের প্রায় আড়াই কোটি ঋণ বিতরণ!

নেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব। তবুও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে অগ্রণী ব্যাংক প্রায় আড়াই কোটি ঋণ বিতরণ করেছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে।

এদিকে ১০ মাসের মধ্যে একটি শাখা থেকে বিতরণ করা ৭৬টি ঋণের মধ্যে নিয়ম বহির্ভূতভাবে দেওয়া ঋণের সংখ্যা অন্তত ৫০টি।

সব মিলিয়ে টাকার অংকটি সোয়া ২ কোটি! এমন ঘটনার নেপথ্যে রয়েছেন শরীয়তপুরের অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক বাবুল মুফতি।

স্বল্পমেয়াদি এসএমই ঋণ বিতরণে তার এমন অনিয়মের চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে অনুসন্ধানে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র এবং খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের ২৩ মে অগ্রণী ব্যাংকের শরীয়তপুর শাখার ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগদান করেন বাবুল। যোগদানের ৭ দিন পর থেকে মাত্র ১০ মাসের মধ্যে বেপরোয়াভাবে অস্তিত্ববিহীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ৭৬ জন ব্যক্তিকে ৩ লাখ টাকা করে প্রায় ২ কোটি ২৮ লাখ টাকা স্বল্পমেয়াদি এসএমই ঋণ দেন তিনি।

ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরেজমিনে যাচাই, আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে পরিদর্শক এবং শাখা প্রধানের যৌথ স্বাক্ষরিত প্রতিবেদন রাখার বাধ্যবাধকতা থাকলেও কোনোটাই মানেননি তিনি।

এছাড়া বর্ণিত খাতে মাসিক ৫টির বেশি ঋণ দেওয়া যাবে না, ব্যাংকের এমন সার্কুলার থাকলেও গত বছরের আগস্ট মাসে ৮টি, সেপ্টেম্বর মাসে ৮টি, অক্টোবর মাসে ১৪টি, নভেম্বর মাসে ৯টি এবং ডিসেম্বর মাসে ১৬টি ঋণ দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানবিহীন এমন ঋণ প্রদানে ঝুঁকি জেনেও বেপরোয়াভাবে এমন অনিয়ম করে গিয়েছেন তিনি।

সরেজমিনে তদন্ত এবং তথ্যসূত্রে জানা যায়, জেলা শহর থেকে অন্তত ১৫ কিলোমিটার দূরে ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর এলাকা। গত বছরের ২৩ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ২ এপ্রিলের মধ্যে মাত্র ৭ মাসেই এই এলাকাতেই ঋণ দেওয়া হয়েছে ৩২ জন গ্রাহককে। আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিদর্শন প্রতিবেদন ছাড়াই এলাকায় গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত ২৩ জনের নামে দেওয়া হয়েছে ৬৯ লাখ টাকা। আর চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত ২০ দিনের মধ্যে এলাকাটির ৫ জনের নামে ঋণ দেওয়া হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। বাকি ৪টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে মর্মে জানা গেছে।

এদিকে ঋণ দেওয়ার এমন অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত শুরু করে ব্যাংকটির অডিট অ্যান্ড ইন্সপেকশন ডিভিশন। পরিদর্শন শেষে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনিয়ম উঠে এলে এ বিষয়ে আঞ্চলিক কার্যালয় মাদারীপুর থেকে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়। পরে মাদারীপুর আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে গত মে মাসে আঞ্চলিক কার্যালয়ের এসপিও মোহাম্মদ আবুল হাসনাত, জাজিরা শাখার ব্যবস্থাপক ইসমাইল হোসেন ও শরীয়তপুর শাখার দায়ী ব্যবস্থাপক বাবুল মুফতিসহ ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত শেষে অনিয়ম উঠে এলে আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে তার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।
ঋণ প্রদানে অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিদর্শক ও অগ্রণী ব্যাংক মাদারীপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের এসপিও মোহাম্মদ আবুল হাসনাত বলেন, আমরা আঞ্চলিক অফিস থেকে পরিদর্শনকালে শরীয়তপুর শাখার ব্যবস্থাপক বাবুল মুফতির ঋণ বিতরণে প্রাথমিকভাবে অনিয়মের সত্যতা পেয়েছি। যেখানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই, তিনি সেখানেও ঋণ বিতরণ করেছেন। আমরা বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।

গত বছরের ১৯ নভেম্বর রামভদ্রপুরে জিয়াসমিন পোল্ট্রি ফার্ম নামে একটি প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ৩ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করেন জিয়াসমিন নামে এক নারী। এ বিষয়ে খোঁজ নিলে জানা যায় জিয়াসমিন নয়, মূলত ঋণটি নেন তার স্বামী জামাল মৃধা। তবে তার কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই।

জামাল মৃধাকে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বিপদে পড়ে আমার ব্যাংক থেকে লোন নিতে হয়েছে। কিন্তু আমার কোনো পোল্ট্রি ফার্ম নেই। সারা বাংলাদেশে এমন হচ্ছে। সবকিছু তো আর স্বচ্ছ হয় না।

ঋণ নেওয়া রেহেনা নামে এক নারী বলেন, আমার বাড়িতে একটি মুরগির ঘর ছিল। আমি যখন ঋণ নিয়েছি তখন এটি দেখিয়েছি। তবে আমার কোনো মুরগির ফার্ম নেই। আমি ঠিকঠাক ঋণ পরিশোধ করব।

এদিকে ঋণ বিতরণে কিছুটা ভুল হয়েছে স্বীকার করে শরীয়তপুর শাখার ব্যবস্থাপক বাবুল মুফতি বলেন, বিষয়টি নিয়ে অডিট হয়েছে এবং লোন আদায় হচ্ছে। কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে, আবার কিছু বন্ধ করে চলে গেছে। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আমার কিছু ভুল হয়েছে, তাই জোনাল অফিস থেকে ব্যাখ্যা তলব করেছে এবং পানিশমেন্ট দিচ্ছেন।

মাদারীপুরের তৎকালীন অগ্রণী ব্যাংকের আঞ্চলিক উপমহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আতিকুর রহমান খান বলেন, আমি চলে আসার আগে তাকে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা তলব করে এসেছিলাম। সময়সীমা দেড় মাস বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। পরে সময়সীমা শেষ হয়ে যাওয়ায় বর্তমান জোনাল ম্যানেজারকে অবগত করে ফলোআপ করার কথা জানিয়েছি। তিনি বিষয়টি দেখবেন।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বাবুল মুফতি মাদারীপুরের কালকিনি শাখায় ২০১৬ ও ২০১৭ সালে শাখা ব্যবস্থাপক থাকাকালীন দুই বছরে তার দ্বারা সংঘটিত নানা অনিয়মের জন্য তিন বার ব্যাখ্যা তলব করা হয়।

২০১৬ সালে ৪৫ লাখ ৬৬ হাজার টাকা প্রভিশন ঘাটতি রেখে ব্যয় কম দেখিয়ে লাভ বেশি দেখানো, ২০১৭ সালে বন্ধকি গ্রহণ ছাড়াই ফয়সাল ট্রেডার্স নামে এক প্রতিষ্ঠানকে ২০ লাখ টাকা সিসি ঋণ বিতরণ, তার দায়িত্বে অবহেলার কারণে এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ, মাদরাসার সরকারি হিসাব থেকে ১৯ লাখ ৫৭ হাজার টাকা অর্থ লোপাট হয়।

সেসব সরকারি অর্থ লোপাটের ঘটনায় আদালতে দুটি মামলা এখনো চলমান। তার বিরুদ্ধে এসব অনিয়মের অভিযোগ থাকা সত্তেও তাকে পুনরায় শরীয়তপুর প্রধান শাখার ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

সদ্য বদলি হওয়া অগ্রণী ব্যাংক পিএলসি মাদারীপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আতিকুর রহমান খানকে জিজ্ঞেস করা হলে বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, বাবুল কালকিনি শাখায় থাকা অবস্থায় কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী কিছু তহবিল তছরুপ করেছিল, তাদের পানিশমেন্ট হয়েছিল। তবে ম্যানেজার ওইসব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন।

নিয়ম বহির্ভুতভাবে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংক মাদারীপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক মনজুর হোসেন বলেন, এ ব্যাপারে তার কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে এবং বিষয়টি উনি কীভাবে সমাধান করবেন সে ব্যাপারে কার্যক্রম চলমান। আসলে তাকে কিছুদিন সময় দেওয়া হয়েছে সমাধান করার এবং ঋণগুলো আদায় করার জন্য।

অস্তিত্ববিহীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে স্বল্পমেয়াদি এসএমই ঋণ দেওয়ার অনিয়মের বিষয়ে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (বিডিবিএল) অবসরপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক ও অগ্রণী ব্যাংকের ডিজিএম সুস্মিতা মন্ডল বলেন, স্বল্পমেয়াদি এসএমই ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করতে হবে, যাতে ভুয়া ঋণ দেওয়ার সুযোগ না থাকে। যদি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া ঋণ দেওয়া হয়, এসব ঋণ খেলাপি হলে এর দ্বায়ভার শাখা ব্যবস্থাপকের। কেননা তার ওপর নির্ভর করে ঋণ সঠিক লোককে দেওয়া হচ্ছে কী না। ঋণগুলো খেলাপি হয়ে গেলে শাখা ব্যবস্থাপকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।