পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ: রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নাকি অর্থনৈতিক চাপ?

পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ: রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নাকি অর্থনৈতিক চাপ?

দেশের রফতানি আয়ের অন্যতম প্রধান খাত গার্মেন্ট শিল্প বর্তমানে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে চরম সংকটে পড়েছে। এর পেছনে একাধিক কারণকে দায়ী করা হচ্ছে। বিশেষ করে—রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং শিল্পের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর সমন্বয়ে এই অস্থিরতা তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মালিকপক্ষের অভিযোগ— কিছু শ্রমিক সংগঠন এবং রাজনৈতিক শক্তি এই খাতকে অস্থিতিশীল করার জন্য পরিকল্পিতভাবে কাজ করছে, অন্যদিকে শ্রমিকরা বকেয়া বেতন না পেয়ে বিক্ষোভে উত্তেজিত হচ্ছেন।

গার্মেন্ট খাতে শ্রমিকদের বেতন নিয়ে সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে চললেও এবার তা তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে, অক্টোবর মাসের বকেয়া বেতন না পাওয়ায় সাভার, গাজীপুর, আশুলিয়া, টঙ্গী এবং মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ ও রাস্তায় অবরোধ করার ঘটনা বেড়ে গেছে। মালিকপক্ষের মতে, কিছু কারখানার মালিকের অবহেলা এবং ব্যাংক খাতের সংকটের কারণে শ্রমিকদের বেতন সময়মতো দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে, তাদের অভিযোগ—এই পরিস্থিতিকে ব্যবহারের জন্য কিছু রাজনৈতিক শক্তি এবং শ্রমিক নেতারা সংকটকে আরও তীব্র করতে চাচ্ছে।

গার্মেন্ট শিল্পের মালিকরা বলছেন— ব্যাংক খাতে তারল্য সংকটের কারণে কারখানাগুলো শ্রমিকদের বেতন পরিশোধে সমস্যা অনুভব করছে। অনেক মালিকই আভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করতে পারছেন না। এ প্রসঙ্গে এক কারখানার মালিক জানান, আগের সরকারের সময় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করা হয়েছিল, যার কারণে বর্তমানে শিল্প খাত সংকটে পড়েছে। ব্যাংক সাপোর্টের অভাবে বর্তমানে এলসি খুলতেও সমস্যা হচ্ছে, যা পণ্য রফতানি এবং মজুরি পরিশোধের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে।

বেশ কিছু শ্রমিক, বিশেষত রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা, শ্রমিকদের সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য তাদের আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করছে। শ্রমিকদের অধিকাংশই নিরীহ এবং তারা সাধারণত কাজের মধ্যে থাকেন। তবে, কিছু শ্রমিক নেতার প্ররোচনায় তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন। এ ক্ষেত্রে, সরকারের উচিত শক্ত হাতে আইন প্রয়োগ করা এবং এ ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম

রাজনৈতিক তৎপরতা ও শ্রমিক আন্দোলন
খাত-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন— শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে রাজনৈতিক তৎপরতা ও শ্রমিক আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, যা শিল্পের মালিকেরা গভীরভাবে অনুভব করছেন। মালিকদের মতে, বেশ কিছু রাজনৈতিক দল এবং শ্রমিক সংগঠনের নেতারা পরিকল্পিতভাবে শ্রমিকদের আন্দোলনে উসকানি দিচ্ছেন। তাদের অভিযোগ, এই নেতাদের প্ররোচনায় সাধারণ শ্রমিকরা অবৈধ প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন, যা মূলত শিল্পে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পরিচালিত। মালিকরা দাবি করছেন, শ্রমিকরা সাধারণত শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করতে চান, কিন্তু কিছু নেতার উসকানির কারণে তারা আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছেন।

এটি একটি চক্রবূহ্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, যেখানে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন কিংবা অন্যান্য সমাধানযোগ্য ইস্যুগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে উত্থাপন করা হচ্ছে। মালিকদের ভাষ্যমতে, কিছু সমস্যা ছিল যা অভ্যন্তরীণভাবে সমাধান সম্ভব ছিল, তবে রাজনৈতিক এবং শ্রমিক নেতারা ইচ্ছাকৃতভাবে সেগুলোকে বৃহত্তর ইস্যুতে পরিণত করছেন। ফলে, শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধসহ বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করতে বাধ্য হচ্ছেন, যা সাধারণ জনগণের জন্য চরম দুর্ভোগের সৃষ্টি করছে।

এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, শ্রমিকদের অধিকাংশই আন্দোলনে না গিয়ে তাদের পাওনা প্রাপ্তির জন্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং শ্রমিক সংগঠনের কিছু নেতার নেতৃত্বে, প্রতিবাদ এখন বিক্ষোভে পরিণত হচ্ছে। এই আন্দোলনগুলো সাধারণভাবে শিল্পের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠছে, কারণ এটি বিদেশি বিনিয়োগকে প্রভাবিত করতে পারে এবং দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটাতে পারে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, বিগত সরকারের আমলে সুবিধা পাওয়াদের একটি পক্ষ পরিকল্পিতভাবে এই খাতকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে যেকোনো একটি বা দুটি কারখানায় সমস্যা দেখা দিলেই শ্রমিকদের মহাসড়কে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সমস্যা নেই এমন কারখানার শ্রমিকরাও তাদের সঙ্গে অবরোধে শামিল হচ্ছেন।

একাধিক কারখানার মালিক ব্যাংক সংকট ও অন্যান্য আর্থিক কারণে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। তবে, কোনো একটি বা দুটি কারখানার সমস্যা যাতে পুরো শিল্পের উপর প্রভাব না ফেলতে পারে, সেজন্য সক্রিয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল

এছাড়া গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে ব্যাপক বিভাজন রয়েছে। একজন কারখানা মালিক জানালেন, গার্মেন্ট খাতে অন্তত ১০০টি শ্রমিক সংগঠন রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে অনেকেই রাজনৈতিক দল বা এনজিও’র দ্বারা পরিচালিত। এই বিভাজন ও নেতৃত্বের অভাবে শ্রমিকদের মাঝে ঐক্য গড়ে উঠছে না, যার ফলে অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শ্রমিক অসন্তোষ সমাধানে সরকারের উদ্যোগ
শ্রমিক অসন্তোষ মোকাবেলায় সরকার ইতোমধ্যে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যা সংকট সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারের প্রথম পদক্ষেপ হলো মালিকদের প্রতি বকেয়া বেতন পরিশোধের জন্য চাপ সৃষ্টি করা। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে, তারা মালিকদের উপর নজরদারি বাড়াবে এবং শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধে বাধ্য করবে। এর মাধ্যমে সরকার শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে, যাতে আন্দোলন আর বৃদ্ধি না পায় এবং সংকটের পরিস্থিতি আরও জটিল না হয়।

এছাড়া, মন্ত্রণালয় শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যাতে তারা অহেতুক আন্দোলন না করে, বরং শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসে। সরকারের এ উদ্যোগ শ্রমিকদের মধ্যকার নেতিবাচক মনোভাব পরিবর্তন এবং কাজের পরিবেশ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা হিসেবে দেখা যাচ্ছে। এর মাধ্যমে, শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে সমঝোতা তৈরি করার লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে হস্তক্ষেপ শুরু করেছে, যাতে অহেতুক উত্তেজনা না বাড়ে।

তবে, সরকারের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হলো— পোশাক শিল্পের প্রধান এলাকা গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া এবং অন্যান্য শিল্প এলাকায় "ক্লাস্টার ভিত্তিক কমিটি" গঠন। এই কমিটি প্রতিটি এলাকায় শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের বিষয়টি মনিটরিং করবে এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণ অনুসন্ধান করে তা সমাধানের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেবে। ক্লাস্টার ভিত্তিক কমিটি গঠন করলে শ্রমিক অসন্তোষের মূল কারণগুলো সহজে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে, এবং তা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থানীয় স্তরে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

এই পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে সরকার কাজের পরিবেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। তবে, সফলতার জন্য মালিকদের সহযোগিতা এবং শ্রমিকদের বিশ্বাস অর্জন গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে— সরকারের সক্রিয় উদ্যোগের মাধ্যমে যদি শ্রমিকদের বেতন এবং অধিকার সঠিকভাবে নিশ্চিত করা যায়, তবে এটি অস্থিতিশীলতা হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা ও মালিকপক্ষের আহ্বান
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, বেশ কিছু শ্রমিক, বিশেষত রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা, শ্রমিকদের সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য তাদের আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করছে। তিনি বলেন, শ্রমিকদের অধিকাংশই নিরীহ এবং তারা সাধারণত কাজের মধ্যে থাকেন। তবে, কিছু শ্রমিক নেতার প্ররোচনায় তারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন। এ ক্ষেত্রে, সরকারের উচিত শক্ত হাতে আইন প্রয়োগ করা এবং এ ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

অন্যদিকে, বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল দাবি করেন, একাধিক কারখানার মালিক ব্যাংক সংকট ও অন্যান্য আর্থিক কারণে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। তবে, তিনি মনে করেন, কোনো একটি বা দুটি কারখানার সমস্যা যাতে পুরো শিল্পের উপর প্রভাব না ফেলতে পারে, সেজন্য সক্রিয় ব্যবস্থা নিতে হবে।