‘তুফান’ যত গর্জেছিল, বরষেছে তার বেশি
কোরবানি ঈদে মুক্তি পাওয়ার পর থেকে নির্মাতা রায়হান রাফির ‘তুফান’র তোড়ে অসংখ্য দর্শকের চোখের ঘুম হারিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত সিনেমা হলে টিকিটের লম্বা লাইন, অনেক মানুষের উচ্ছ্বাসে যেন রীতিমতো বিস্ময় তৈরি করছে ‘তুফান’। গতকাল (১ জুলাই) দেখে এলাম সিনেমাটি। একটি সিনেমা দেখার সময় প্রজেকশন, সাউন্ড, হলের দর্শকদের নিয়ে পরিবেশ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ; তা অনুধাবন করলাম। এতদিন অপেক্ষার পর ‘তুফান’ দেখে আমার এটাই মনে হয়েছে; শুধু মুগ্ধতা নয়, বাংলাদেশের পর্দায় এরকম একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বাংলা সিনেমা দেখব, দর্শক হিসেবে অনেকে ভাবতে পারেননি। এ রকম প্রিমিয়াম লুক অ্যান্ড ফিলের সিনেমা বাংলাদেশের মানুষের কাছে সত্যি কল্পনার ঊর্দ্ধে। তবে এটা বলতে হবে, ‘তুফান’র মাধ্যমে দেশের সিনেমায় এক বিপ্লব হলো হয়তো। সিনেমাটি দেখার পর বলতে বাধ্য হচ্ছি, ‘তুফান’ মুক্তির আগে যতটা গর্জেছিল, তার চেয়েও যেন অনেক বেশি বরষেছে।
‘তুফান’ নিয়ে কাছের-দূরের অনেকের নানা মন্তব্য শুনছি অনেকদিন ধরে। এ ছাড়া ‘তুফান’ সিনেমার অন্যতম আকর্ষণ মেগাস্টার শাকিব খানকে নিয়ে দেশের একশ্রেণির ‘বোদ্ধা গোষ্ঠী’ আছেন, যারা এখন পর্যন্ত একটা নাকসিটকানো মনোভাব পুষে রেখেছেন। তাদের সত্যি এবার থোতা মুখ ভোঁতা হবার জো হয়েছে এই তুফানের জন্য। ভারতের দক্ষিণী সিনেমার নামে যে দর্শকরা ভিমড়ি খায়, তারা এবার বুক ফুলিয়ে বলতে পারে যে আমাদের শাকিব খান কোন অংশে কম! আর তাই হয়তো, নাচে, গানে, এ্যকশনে ভরপুর ধামাকা সিনেমা ‘তুফান’র রিভিউ লিখতে আমার আত্মবিশ্বাস ও অহংকারে এতটুকু ঘাটতি বোধ হচ্ছে না।
‘তুফান’ দেখার আগ পর্যন্ত বলিউড ও দক্ষিণী সিনেমা নকলের অভিযোগের বিষয়টি মাথায় ছিল। অথচ ২ ঘণ্টা ২৫ মিনিটের ‘তুফান’ দেখে ‘নকল’ হিসেবে তীরবিদ্ধ করতে পারিনি। এ অভিযোগের সঙ্গে আমি একমত নই। কারণ বলিউড, টালিগঞ্জ, হলিউডসহ বিশ্বের অনেক কালজয়ী/জনপ্রিয় সিনেমাতেই নির্মাতারা তাদের প্রিয় সিনেমা/ প্রিয় পরিচালকের সিনেমার কিছু দৃশ্য/ লুক/ সংলাপ/ গানকে ট্রিবিউট বা সম্মান দেখানোর জন্য নিজের মতো ব্যবহার করেন। ‘তুফান’ দেখতে গিয়েও আমি কেজিএফ, অ্যানিমেল, ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন মুম্বাই, রাইসসহ অনেক সিনেমার নির্যাস পেয়েছি। এমনকি প্রয়াত নায়ক সোহেল চৌধুরীর হত্যাকাণ্ড, আজিজ মোহাম্মদ ভাই সংযোগসহ ’৯০ দশকে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রক ‘সেভেন স্টার’ গ্রুপের আসিফের অনেক বাস্তব ঘটনার সঙ্গেও মিল পেয়েছি। ১৯৯৭ সালে গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরামের নামানুসারে সিনেমাতেও আমরা সিআইডির নাম পাই ‘আকরাম’।
আসলে রায়হান রাফী সমাজের বাস্তব ও চলমান বা ঘটমান প্রেক্ষাপটকে মাথায় নিয়ে তুফানের মতো এমন একটি মালা গেঁথেছেন, যা দর্শক হৃদয়ে সুঘ্রাণ ছড়াতে বাধ্য। এ সিনেমার নায়ক অনেকে। মহানায়ক দুজন, পরিচালক রায়হান রাফী এবং অবশ্যই শাাকিব খান। চঞ্চল চৌধুরী ও অনেক প্রতিভাবান অভিনেতাদের নিয়ে বিশাল বাজেটে রায়হান রাফী অসীম সাহসিকতা নিয়ে এতবড় একটা তুফান সামলেছেন! ক্যারিয়ারের ৬ষ্ঠ সিনেমায় পরিচালক এতটাই ম্যাচুরিটির সঙ্গে সবকিছু সমন্বয় করেছেন, যার আসলে প্রশংসাই প্রাপ্য।
এদিকে ২৫ বছরের ক্যারিয়ারে ‘তুফান’ দিয়ে শাকিব যে নতুন রূপে দর্শকের সামনে হাজির হলেন তাতে মুগ্ধ হতেই হতো। শাকিব খানের সুদর্শন লুকটাকে রাফি যেন আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছেন। এতে তার ভক্তরা তো বটেই, কট্টর নিন্দুকেরাও চোখ ফেরাতে পারবে না। ‘তুফান’ চরিত্রে অনেক দৃশ্যে তার সংলাপবিহীন ‘সোয়াগ/ অ্যাটিটিউড’ দেখে যে কেউ বলতে বাধ্য হবেন: ‘ওএমজি’! জগতের সব সুদর্শন অভিনেতা সুঅভিনেতা হতে পারেন না। আবার সব সুঅভিনেতা সুদর্শন হতে পারেন না। এক্ষেত্রে শাকিব প্রমাণ করেছেন তিনি সুদর্শন এবং একজন সুঅভিনেতা।
সিনেমা অন্তঃপ্রাণ এক যুবক শান্ত। তার ধ্যান-জ্ঞান অভিনয় করা। সামান্য পর্দা উপস্থিতি বা এক দৃশ্যে অভিনয় করার কী চেষ্টা তার। সে তার অভিনয়ের গল্প বলে তার মহল্লার পরিচিতজনদের। শান্তকে সাহায্য করতে চায় এক কস্টিউম ডিজাইনার। শান্ত খুব গর্ব নিয়ে বলে সে একটা সিনেমায় অভিনয় করেছে, যার নাম ‘শেষ খেলা’। সবাইকে সে ছবি দেখতে নিয়ে যায়। হলে গিয়ে দর্শকরা দেখতে পায় সিনেমার কোথাও শান্ত নেই। তাকে সবাই ধিক্কার জানায়। মিথ্যাবাদী বলে। শান্ত আত্মহত্যা করতে চায়। পারে না। ছবির গল্প শুরু হয় এখান থেকে। কারও সঙ্গে কি শান্তর চেহারার মিল আছে?
শান্ত যখন কল্পনা করে একদিন নায়কের বেশে সুপারস্টার হয়ে ভক্তদের অটোগ্রাফ দেবে, সে দৃশ্যে বা ধোবিঘাটে অ্যাকশন দৃশ্যে শাকিব খানের লুক দেখে বা ডিল ফাইনাল করার আগে শান্ত’র হেঁটে আসা দেখে আমার আশপাশের অনেক দর্শকই সমস্বরে বলেছেন ‘ওয়াও!’ অবশ্য এরকম ‘ওয়াও’ মুহূর্ত সিনেমাতে ভুরি-ভুরি। সব মিলিয়ে ‘তুফান’কে বলা যেতে পারে শাকিব খানের শো-রিল।
বিশেষ কয়েকটি দৃশ্যের কথা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে; জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে সিনেমার নাচের সেট থেকে বের করার দৃশ্যে শান্ত’র এক্সপ্রেশন, অডিশনের দৃশ্য, ধোবিঘাটে অ্যাকশন দৃশ্য, মসজিদে গিয়ে পাড়ার পাবর্তী বৌদির জন্য রক্ত জোগাড়ের ঘোষণা, মহল্লার সবাইকে নিয়ে শান্ত’র ‘শেষ খেলা’ সিনেমা দেখার পর বাড়ি ফিরে ক্ষোভ প্রকাশ, তুফানের এন্ট্রি, কিশোর তুফানের গল্প, সংবিধান নিয়ে তুফানের মনোলোগ, শাহনেওয়াজের মাথা কেটে হত্যা, বাশিরের সঙ্গে কুস্তির দৃশ্য, সিআইডি আকরামের এন্ট্রি, আগুনের মাঝখানে বাথটাবে তুফানের আউটবার্স্ট, অ্যান্ড ক্রেডিটের পরের দৃশ্য-প্রতিটি মুহূর্তই ছিল ‘ফুল অন এন্টারটেইনমেন্ট’। ‘ওয়ান টেইক শট’ যতবার দেখেছি, অপলক দৃষ্টিতে তব্দাই খেয়েছি। শাকিব খানের রাজকীয় ভঙ্গিতে ওয়ান টেইক শট দেয়ার মুহূর্তটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ব্যক্তিগতভাবে তুফানের পিয়ানো বাজিয়ে নিজেকে খোঁজার মুহূর্তটি আমাকে আবেগাপ্লুত করেছে। বিশেষ করে জালালউদ্দিন গাজী’র গল্প শেষ হবার পর তুফানের এক্সপ্রেশন, পিয়ানো বাজানো এবং গোধূলি লগ্নে নিজেকে খোঁজা-অবিশ্বাস্য সুন্দর সবকিছু।
এ সিনেমার প্রায় প্রতিটি গানই নিজেদের জায়গায় সেরা। প্রীতম হাসানের ‘লাগে উরা ধুরা’ ঝড়ে উড়তে উড়তে যখন ‘দুষ্টু কোকিল’ এসে ডাকাডাকি শুরু করল, তখন যেন দুনিয়া আরও টালমাটাল। কনার সুরেলা কণ্ঠ এই গানকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। এ গানে মিমি তো বটেই, শাকিব খানের মৃদু স্টেপসগুলোতেও ছিল ‘ওয়াও’ ফ্যাক্টর। আর ‘তুফান’র শিরোনাম গানটিতেও রয়েছে একটা দারুণ এনার্জি । আরিফ রহমান জয় সত্যিই দুর্দান্ত। এদিকে হাবিব ওয়াহিদের রোমান্টিক গানটি এবং রেহান রাসূলের ‘আসবে আমার দিন’ও কানে বেশ মধু ঢেলছে।
শাকিব খানের পাশে ওপার বাংলার নায়িকা মিমি চক্রবর্তীকে ভীষণ ভালো লেগেছে। সত্যি বলতে, ‘বোঝে না সে বোঝে না’র সেই মিমি যেন আরেকবার মনে আসন গাড়লেন নতুন করে। ‘সূচনা’ চরিত্রে মিমির মোহনীয় এক্সপ্রেশন, কথা বলার ভঙ্গি, আত্মবিশ্বাস, সর্বোপরি স্ক্রিন প্রেজেন্স ছিল ম্যাজিকাল। চঞ্চল চৌধুরী তো নিজেই লিজেন্ড। যখন যে চরিত্র ধারণ করেন, আবিষ্ট করেন নিজ গুণে। শাকিব খান-চঞ্চলকে একসঙ্গে যে ক’টি দৃশ্যে দেখা গেছে, তাতে রীতিমতো পয়সা উসুল। আশা করি, ‘তুফান টু’ তে তুফানের পাশাপাশি সিআইডি আকরাম সমান্তরাল স্পেস পাবে।
৮ বছর পর বড় পর্দায় নাবিলার ফেরা ছিলো ফেরার মতোই। নাবিলাকে দেখতে বেশ স্নিগ্ধ লেগেছে, তবে নাবিলার চরিত্রটি চিত্রনাট্যে আরেকটু স্পেস পেতে পারত। ’৯০ দশকে ঢাকাই সিনেমায় একজন নারী কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে তাকে দেখানো হয়েছে। বিষয়টি কিছুটা অবাস্তব লেগেছে। এ ছাড়া এখানে ‘জুলি’ চরিত্রের কস্টিউম/ কথা বলার ভঙ্গি (করতেছো ক্যান? / তাকাইয়া আছো ক্যান / হাসতেছে আবার! / তোমাকে বের করে দিছে? / আমি আসলে বুঝতে পারি নাই / বুঝতে পারছি, হইছে কী) – এই সংলাপগুলো কেমন যেন আরোপিত মনে হয়েছে। জুলির ওপর শান্তর প্রেমানুভূতি একটু কম ছিল।
গাজী রাকায়েতকে ‘তুফান’ সিনেমায় কাস্ট করাটা ছিল পরিচালক রাফীর অন্যতম মাস্টারস্ট্রোক। তিনি ভীষণ বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন। মুগ্ধ করেছেন। মিশা সওদাগরকেও রায়হান রাফীর সিনেমায় দেখতে পারাটা ছিল বিশেষ পাওনা। মাত্র ৩-৪টি দৃশ্যে মিশা সওদাগর প্রমাণ করেছেন, তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
ফজলুর রহমান বাবু স্বভাবজাত ভালো অভিনয় করেছেন, তবে তার চরিত্রে ‘বিশেষ’ কিছু পাইনি। অতিথি চরিত্রে সালাহউদ্দিন লাভলু, শহীদুজ্জামান সেলিম, সুমন আনোয়ার, শাহরিয়ার ফেরদৌস সজীব বিশ্বাসযোগ্য ছিলেন।
আলফা আই এবং এসভিএফ, চরকির মতো বড় বড় তিনটি প্রযোজক প্রতিষ্ঠানের আস্থার জায়গা থেকে পরিচালক রায়হান রাফী 'তুফান' নির্মাণে মনোযোগ ও আন্তরিকতার কোন ঘাটতি রাখেননি একথা বললে সত্যিই ভুল হবে না।