এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকলে রাষ্ট্রের স্বাধীন কাঠামো থাকে না: নূর খান লিটন
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বর্তমানে আইন ও শালিস কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির সদস্য, হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির উপদেষ্টা এবং গুম-খুনের শিকার পরিবারগুলোর সংগঠন মায়ের ডাকের সঙ্গে যুক্ত। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির কারণে সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে তার পরিচিতি তৈরি হয়েছে। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, আইনের শাসন নিয়ে উচ্চ কণ্ঠ হওয়ায় নানা সময়ে সরকারের রোষানলেও পড়েন তিনি। দ্য মিরর এশিয়াকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি কথা বলেছেন দেশের গণতন্ত্র-গণমাধ্যম, নির্বাচন-মানবাধিকার, আইনের শাসনসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ।
দ্য মিরর এশিয়া: গণমাধ্যম মানবাধিকার সংরক্ষণে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে?
নূর খান লিটন: এটা খুবই স্পষ্ট। মানবাধিকার নিয়ে আমরা যে কাজ করি, তার সফলতা অনেকাংশে গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর নির্ভর করে। মানবাধিকার সংরক্ষণে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আজকে বাংলাদেশের যে সব ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়, আমরা জানতে পারলে সেগুলো নিয়ে কাজের চেষ্টা করি। গণমাধ্যম কর্মীরাও একই কাজ করেন। আমাদের গণমাধ্যমের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল থাকতে হয়। তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। তাদের মাধ্যমে আমরা জনগণের মধ্যে প্রচার করি। ফলে জনমত তৈরি হয়। একটি সোচ্চার ভূমিকা জনগণের মধ্যে তৈরি হয় এবং এই পুরো কাজে সমন্বয়ের প্রয়োজন হয়। শুধু মানবাধিকার কর্মীরা এ পুরো দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। এখানে গণমাধ্যম কর্মীদের সংযুক্ত করতে হয়, তাদের সহযোগিতা নিতে হয়। তাদের ভূমিকার মধ্য দিয়ে মূলত মানবাধিকার কর্মীরা সফল হন। এ ক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের (২০২৪) বিষয়টি একটি বড় উদাহরণ। আমরা মানবাধিকার কর্মীরা প্রতিটি ক্ষেত্রে সংবাদ কর্মীদের সহায়তা পেয়েছি। গণমাধ্যম যদি সে সময় পুরো বিষয়টিকে সামনে না নিয়ে আসতে তাহলে জনগণের মধ্যে প্রশ্ন উঠত না। জনগণ তীব্র চাপ প্রয়োগ করতে পারত না। বিষয়টি মানুষের সামনে উন্মোচিত হতো না। এমন বহু ঘটনা আছে। যে ঘটনাগুলোয় গণমাধ্যম সোচ্চার থাকে, সেগুলোর ব্যাপারে জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। যারা ক্ষমতায় থাকে তারা জনগণের চাপে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। সুফল পেতে হলে মানবাধিকার কর্মী ও সংবাদকর্মীদের এক ধরনের নিরলস প্রচেষ্টা থাকতে হয়। মানবাধিকার সংরক্ষণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে গণমাধ্যম।
টিএমএ: আপনার কি মনে হয় বাংলাদেশের গণমাধ্যম সেই ভূমিকা রাখতে পারছে, না পারলে সে ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা কোথায়?
নূর খান লিটন: গণমাধ্যম তখনই তার দায়িত্ব পালন করতে পারে যখন সে বাধাহীন থাকে। এমন কোনো আইন থাকে না যে আইনে তাকে আষ্টেপৃ্ষ্টে বেঁধে ফেলা হয়। এমন পরিবেশ থাকে না যখন গণমাধ্যম ভীতিকর পরিস্থিতি থাকে সংবাদ পরিবেশনায়। অথবা গণমাধ্যমের মালিক নানা চাপের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হন। তখন কিন্তু সে সঠিক সংবাদটি প্রকাশ করতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রকাশ করে। অথবা প্রকাশই করেন না। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতাধরদের প্রেসক্রিপশনে সংবাদ প্রকাশ করে। এ ক্ষেত্রে র্যাবের গুলিতে পা হারানো ঝালকাঠির কলেজছাত্র লিমনের ঘটনাটি উদাহরণ। সে সময় প্রথমে তার চরিত্র হননের চেষ্টা হয়। সেটি ব্যর্থ হলে তাকে সন্ত্রাসীদের সহযোগী হিসেবে কোনো কোনো গণমাধ্যমে উপস্থাপনের চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু বলিষ্ঠ সংবাদপত্র প্রতিনিয়ত সত্য ঘটনা সামনে আনার কারণে জনগণের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ তৈরি হলো। এবং একপর্যায়ে র্যাব তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। এমনও দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী লিমনের বিষয়টি নিয়ে বাসসে একটি সাক্ষাৎকারে কিছু নির্দেশনা দেন। আমরা দেখেছি, শক্তিধর মহলের চাপের কারণে বাসস ২ থেকে ৩ ঘণ্টার মধ্যে সেই সাক্ষাৎকার তুলে দেয়। সেই লিমন আজ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকত করছে। এটি সম্ভব হয়েছে কেবল গণমাধ্যমের সোচ্চার ভূমিকার কারণে।
টিএমএ: আপনি কি মনে করেন ক্ষমতার দীর্ঘমেয়াদী নিয়ন্ত্রণ মানবাধিকারের পথকে সংকুচিত করে দেয়?
নূর খান লিটন: ক্ষমতার অবৈধ নিয়ন্ত্রণ মানবাধিকারের পথকে সংকুচিত করে। গণতন্ত্র যখন সংকুচিত হয়, তখন জবাবদিহির বালাই থাকে না। স্বচ্ছতার বালাই থাকে না। তখন কিন্তু সংবাদপত্র বা মানবাধিকার কর্মীরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। তাদের কাজ করতে হয় অনেক প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়। জেলে যেতে হয়। এমন অবস্থা যেখানে থাকে তাকে গণতান্ত্রিক সমাজ বলা যায় না।
টিএমএ: সেক্ষেত্রে কি সাইবার সিকিউরিটি আইন একটি অস্ত্র? যা ব্যবহার করে সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে বলে আপনি মনে করেন?
নূর খান লিটন: সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট আমরা যদি এই আইনের পর্যালোচনা করি, তবে এই আইনের সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছেন সংবাদকর্মীরা। এই আইনের প্রয়োগ এমনভাবে হয়েছে যে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে ভীতিকর অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন পার করতে হয়। এমনও দেখেছি, গভীর রাতে সংবাদকর্মীদের ধরে আনা হয়েছে। আমরা দেখেছি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৪০-৫০ টি মামলা দেওয়া হয়েছে। জেলায় জেলায় মামলা হয়েছে। এটি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে ভুলুণ্ঠিত করে।
টিএমএ: আপনি নিজে এ আইন নিয়ে সরব। বিশ্বব্যাপী এর সমালোচনা রয়েছে। তারপরও সরকারের জন্য এ আইন অপরিহার্য কেন?
নূর খান লিটন: এটি একটি নিবর্তনমূলক আইন। ক্ষমতাকে দীর্ঘমেয়াদী করতে যা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইন নিয়ে আমার মতো যারা মানবাধিকারকর্মী তারা যেমন সরব, তেমনি এটি বিশ্বব্যাপী আলোচিত-সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু একটি বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ যে, যারা এ আইন প্রণয়ন করেছে তাদের উদ্দেশ্য। যখন দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন থাকে বা এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা থাকে তখন এ ধরণের নিরবর্তনমূলক আইনই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
টিএমএ: বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গণমাধ্যম কি তার সঠিক কাজটি করতে পারছে বলে মনে করেন?
নূর খান লিটন: বর্তমানে দেশে এমন একটি রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে যেখানে সংগঠিত হওয়াকে বাধা দেওয়া হয়। যেখানে কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। রাজনীতিকে নানা বিধিমালার মধ্যে বেঁধে ফেলা হয়। প্রতিনিয়ত মিথ্যা মামলা দিয়ে রাজনৈতিক কর্মীদের হয়রানি করা হয়, বিচার করা হয়। মানুষ যখন প্রশ্ন তোলা শুরু করে, যখন আন্দোলন-সংগ্রামের দিকে যায় তখন বিচারের গতি বেগ পায়। আবার নতুন নতুন মামলা তৈরি হয়। মামলার ধরন এমন যে ৫০ জন লোকের নাম উল্লেখ করে মামলা হচ্ছে আবার ২-৩ হাজার মানুষকে অজ্ঞাতনামা রাখা হয়। এই অজ্ঞাতনামা আসামি হিসাবে যাকে-তাকে ধরে নেওয়া যায়, হয়রানি করা যায়। এর মধ্য দিয়ে একটি ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়। আজকে বিরোধী দলের প্রায় সকল নেতাকর্মীর নামে এক বা একাধিক মামলা রয়েছে। যখন দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন থাকে, যখন এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়, তখন রাষ্ট্রের যে স্বাধীন কাঠামো থাকার কথা সেটি থাকে না।
একটা সুষ্ঠু নির্বাচন অর্থাৎ আমি আমার প্রতিনিধিকে স্বাধীনভাবে নির্বাচিত করব, আমি ভোট দেব এবং সেই ভোট স্বাধীনভাবে গণনা করা হবে, সেই গণনা প্রকাশ করা হবে; এ আস্থাটি যখন সমাজ থেকে হারিয়ে যায়, তখন গণতন্ত্র সুদূরপরাহত। সেই রকম একটি রাজনৈতিক সময় আমরা অতিক্রম করছি।
টিএমএ: রাজনীতি ও মানবাধিকার এই দুটি বিষয়কে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
নূর খান লিটন: রাজনীতিটা যদি মানুষের জন্য হয়, তবে সেখানে মানবাধিকার বিষয়টি থাকে। কিন্তু বর্তমানে যে নীতিহীন রাজনীতি চলছে এটি কেবলই ক্ষমতাকেন্দ্রিক। এর সঙ্গে মানবাধিকার সুরক্ষার কোনো বিষয় নেই বরং এই রাজনীতি মানবাধিকার লঙ্ঘন করেই তৃপ্তি পায়।
টিএমএ: দ্য মিরর এশিয়ার কাছে আপনার প্রত্যাশার কথা বলুন।
নূর খান লিটন: দ্য মিরর এশিয়ার কাছে আমার ব্যক্তিগত প্রত্যাশা থাকবে, যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো তারা নির্ভীক চিত্তে প্রকাশ করতে পারে এবং মানাবধিকার সংগঠন, অন্যায়–অবিচার, দুর্নীতি চিহ্নিত করে মানুষের সামনে নিয়ে আসতে পারে। এ কাজ যদি তারা করে, তাহলে তারা মানুষের মনে স্থান করে নিতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।