ব্যাংকিং খাতে বড় দুর্যোগ নেমে আসছে
দেশে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট চেয়ারম্যান আবুল কাসেম হায়দার। ইয়ুথ গ্রুপের চেয়ারম্যানও তিনি। সম্প্রতি দেশের অর্থনীতি, বাকস্বাধীনতা ও সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে দ্য মিরর এশিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
দ্য মিরর এশিয়া: সুশাসন ছাড়া বাংলাদেশ কিভাবে উন্নত দেশে পরিণত হবে?
আবুল কাসেম হায়দার: দেশে সুশাসন না আনতে পারলে ২০৪২ সালে বাংলাদেশের উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখা বাদ দিতে হবে। আমরা যে শ্লোগান দিই- স্মার্ট বাংলাদেশ, সেই স্মার্ট বাংলাদেশ করতে হলে অবশ্যই সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ করতে হলে দেশের প্রতিটা সেক্টরে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি একেবারে বন্ধ করতে হবে।
দ্য মিরর এশিয়া: মালয়েশিয়া দুর্নীতির জন্য মিডল ইনকাম ট্রাপের মধ্যেই পড়ে গেছে। বাংলাদেশ কি সেই অবস্থার সম্মুখীন হবে?
আবুল কাসেম হায়দার: আমরা তো প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছি দেশ থেকে দুর্নীতি আর টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে। কে শোনে কার কথা। এখনো দেশের সম্পদ আর অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক ব্যবসায়ী লন্ডন, আমেরিকা আর কানাডায় বাড়ি করেছে। অর্থও পাচার করে যাচ্ছে তারা।
দ্য মিরর এশিয়া: দেশে তিন বছর ধরে ডাবল ডিজিট মূল্যস্ফীতি ব্যাপারে কী বলবেন?
আবুল কাসেম হায়দার: এ বিষয়ে আমার বড় অভিজ্ঞতা নেই। এ বিষয়ে বলায় শরিক হতে চাই না। তবে দেশে বিরাজমান উচ্চমূল্যস্ফীতি বিভিন্ন কারণে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক একটা অর্থনৈতিক চাপ তো আছে। দেখেন পুরো ইউরোপে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এমনকি আমেরিকার অর্থনীতি কোনোভাবেই ভালো অবস্থায় নেই। উন্নত দেশগুলো এক ধরনের চাপে আছে, সেই অর্থনৈতিক চাপ আমাদের এখানেও পড়েছে। আরেকটা হলো আমাদের মুদ্রানীতিতে নানান ধরনের রাইট-রং আছে। কিছুদিন আগে আপনি দেখছেন কতগুলো ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সেই সব ব্যাংক সাহায্য করে যাচ্ছে। এভাবে ক্যাশ ফ্লো ঠিক রেখে কতদিন ব্যাংকগুলো বেঁচে থাকবে? এমনকি গত সপ্তাহে আইসিবি ইসলামি ব্যাংকে সেই ক্যাশ সহায়তা বন্ধ করাতে ব্যাংকটি গ্রাহকদের এক হাজার টাকা ফেরত দিতে পারছে না। অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে এভাবে ক্যাশ টাকা দেওয়াটা কতটা নৈতিক হবে। এগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক অন্যায়ভাবে করেছে। কারণ ব্যাংকিং ক্ষেত্রে কোনো সুশাসন নেই।
দ্য মিরর এশিয়া: আপনি তো অনেক পুরনো ব্যবসায়ী। এখন ব্যবসার পরিস্থিতি কেমন?
আবুল কাসেম হায়দার: সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে এখন ব্যবসাটা খুবই চ্যালেঞ্জিং। ব্যবসায়ীদের যে নিয়মনীতিতে ব্যবসা করা উচিৎ তা তারা করতে পারছে না। আরেকটা হলো ব্যবসা এবং আর্থিক খাতে সুশাসনের অভাব। ব্যাংকিং এবং কোম্পানি আইনে অনেক ভুলত্রুটি আছে। সরকারের উচিৎ এই ব্যাংক কোম্পানি আইন অতি দ্রুত সংশোধন করা। তা হলে ব্যাংকিং খাতের এ অবস্থায় পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই এই আইনগুলো সংশোধন প্রয়োজন। চারটি বড় বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে। আইনের শাসন কায়েম করতে হবে। যে কোনো অন্যায়ের বিচার করতে হবে এবং তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অর্থ পাচারটা বন্ধ করতে হবে। মার্কিন ডলার এবং টাকা। চতুর্থ, দেশে ন্যায় বিচারের বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশ কেন শ্রীলংকার মতো ঘুরে দাঁড়াতে পারে না। চারটা বিষয় ঠিক ছিল বলে শ্রীলংকা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া শ্রীলংকার সরকারের পরিসংখ্যানটা ঠিক ছিল।
দ্য মিরর এশিয়া: ব্যাংক কোম্পানি আইন সংস্কার কেন জরুরি?
আবুল কাসেম হায়দার: ব্যাংকের বোর্ডের এক পরিবারের চারজন পরিচালক থাকবে কেন? সে তো ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করবে। এজন্য ব্যাংকিং খাতে বড় দুর্যোগ নেমে আসছে। যুগ যুগ ধরে এক পরিবারের চারজন ব্যাংকের পরিচালক থাকতে পারে না। বিএনপির সময়ে ব্যাংক বোর্ডের এক পরিবারের এক-তৃতীয়াংশ অবসরে যেত। পরিচিতিদের মধ্যে অনেকেই বিশ বছর ধরে ব্যাংকের চেয়ারম্যান।
দ্য মিরর এশিয়া: আইএমএফের শর্তগুলো ব্যবসাবান্ধব?
আবুল কাসেম হায়দার: আইএমএফের শর্তে সব ধরনের ভর্তুকি যেমন গ্যাস, বিদুৎ এবং আর্থিক প্রণোদনা উঠিয়ে দেয়। উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যাবে। ১৫ টাকার গ্যাস যখন ৩০ টাকা হয়। বিদ্যুতের দাম প্রতি মাসেই বাড়াচ্ছেন। এভাবে সরকার ডবল বিল চাপিয়ে দিলে একজন ব্যবসায়ী কিভাবে নতুন ব্যবসার জন্য পরিকল্পনা করবে? কারণ একটা ব্যবসা করতে গেলে সাত থেকে দশ বছরের পরিকল্পনা লাগে। তাই আইএমএফের সব শর্ত মানার দরকার নাই।
দ্য মিরর এশিয়া: এ সরকার বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে পারবে?
আবুল কাসেম হায়দার: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করেছেন। চট্টগ্রামে টানেল করেছেন। অবশ্যই তিনি দেশের ২০ কোটি নাগরিকের জন্য ব্যাংকের সুশাসন ফিরিয়ে আনতে পারবে। এজন্য দরকার রাজনৈতিক স্ব ইচ্ছা।
দ্য মিরর এশিয়া: বাংলাদেশের ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সর্ম্পকে কিভাবে দেখেন?
আবুল কাসেম হায়দার: বাংলাদেশের গভর্নর ব্যক্তিগতভাবে ভালো মানুষ। অনেক অনুষ্ঠানে তার সাথে আমার দেখা হয়েছে। কিন্তু তিনি প্রফেশনালি দেশের ব্যাংকিং সেক্টরকে হ্যান্ডেল করতে পারছেন না। সরকারি প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাংক প্রফেশনালি কার্যক্রম পরিচালন করতে পারছে না। এই গভর্নরের সিদ্বান্তের স্থিরতা নেই। এক সময় ব্যাংকের সুদের ৬ এবং ৯ করা হয়েছিল। এখন সুদের হার থেকে সব ধরনের ক্যাপ উঠিয়ে দিয়েছে। দেশের ব্যাংকগুলোর সুদের হার ১২, ১৩ এবং ১৪ শতাংশ। বর্তমানে ব্যাংকের সুদের হার ১৪ শতাংশে উঠে গেছে। ব্যাংকের ১৪ শতাংশ সুদে কিভাবে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবে। ডলারের রেইটটা এতদিন ধরে রেখেছিল কেন? এখন ডলারের দাম টাকার বিপরীতে হঠাৎ করে সাত টাকা বাড়ানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবসায়ীদের পলিসিগত সাপোর্ট দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।