বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতির আমূল পরিবর্তন দরকার : আবুল কাশেম ফজলুল হক
প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক, লেখক, গবেষক, ইতিহাসবিদ, অনুবাদক, সমাজবিশ্লেষক, সাহিত্য সমালোচক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক রাষ্ট্রভাষা বাংলা রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। নিরপেক্ষ রাজনৈতিক চিন্তা ও তত্ত্বের জন্য তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। তিনি ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর রচনা স্বদেশ ভাবনা ও রাজনৈতিক চিন্তায় ঋদ্ধ। প্রগতিপ্রয়াসী মন নিয়ে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে মতপ্রকাশ করেন। আমরা দ্য মিরর এশিয়া'র পক্ষ থেকে তাঁর বাসভবনে মুখোমুখি হই।
দ্য মিরর এশিয়া : বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আপনার অভিমত জানতে চাই?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতির আমূল পরিবর্তন দরকার। মনুষ্যত্বের বিকাশমানতা, জীবিকা সংস্থান, সুনাগরিক হওয়া, রাষ্ট্র গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনা, সর্বজনীন গণতন্ত্র অবলম্বন করে ব্যক্তি, জাতি ও রাষ্ট্রকে বিকাশমান রাখা ইত্যাদি লক্ষ্য নিয়ে চলার যোগ্যতা অর্জন চলমান শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা দ্বারা সম্ভব হচ্ছে না—হবে না।
দ্য মিরর এশিয়া : মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ইতিহাস বিকৃতি চোখে পড়ার মতো। এ সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : ইতিহাস বিকৃতি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই চলে আসছে। এখন দেশে প্রকৃতপক্ষে ইতিহাস চর্চাই নেই। এর জন্য কেবল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেই দায়ী করা ঠিক নয়। আওয়ামী লীগের বাইরে যেসব দল আছে, সেগুলোও দায়ী। বুদ্ধিজীবী গ্রুপগুলোও দায়ী। বিবেকসম্মত, যুক্তিসঙ্গত চিন্তাভাবনাও কমই খুঁজে পাওয়া যায়। দুঃশীল রাজনীতিবিদদের এবং দুঃশীল বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা উন্নত অবস্থা সৃষ্টি হবে না। উন্নত অবস্থায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য দরকার এমন নেতৃত্ব —যা সদিচ্ছা নিয়ে, সততা অবলম্বন করে কাজ করবে। চলমান ধারায় যেমন চলছে তেমনই চলতে থাকবে। শিক্ষাব্যবস্থার সব পর্যায়েই মৌলিক পরিবর্তন দরকার। জনসাধারণ ঘুমন্ত, জনসাধারণকে জাগাতে হবে। জনসম্পৃত্তি ছাড়া কোনো সরকার, কোনো রাজনৈতিক দল, কোনো লেখক গোষ্ঠী তা পারবে না।
দ্য মিরর এশিয়া : বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কি উচ্চশিক্ষার অন্তরায়? প্রতিবছর প্রচুর মেধা পাচার হচ্ছে এ সম্পর্কে আপনার অভিমত বলুন।
আবুল কাসেম ফজলুল হক : মেধা পাচার গুরুতর সমস্যা। শিক্ষানীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন ধারায় বহু সমস্যা আছে। বাংলাদেশকে এদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার জন্য যা কিছু দরকার তার কোনোটিই নেই। বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমের কোনো কোনো রাষ্ট্রে গিয়ে নাগরিকত্ব লাভ করার জন্য কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্র-ছাত্রী উদগ্রীব। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার সবধারাই যেমন হওয়া উচিত—সেরকম নেই।
দ্য মিরর এশিয়া : বাংলাদেশের মিডিয়া স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারছে না, প্রতিবন্ধকতাগুলো কী?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : উন্নত প্রযুক্তির এইকালে প্রচারমাধ্যম অপরিসীম শক্তির অধিকারী। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সরকার নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা ও কাজের ধারা গড়ে ওঠেনি। আগে মনে করা হতো, একমাত্র সরকারই এর জন্য দায়ী। এখন দেখা যাচ্ছে, সমস্যা কেবল সরকার দ্বারা সৃষ্টি হচ্ছে না। এনজিও, সিএসও দ্বারাও মতপ্রকাশের ধারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল ইত্যাদির কর্তৃপক্ষও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করছে। সমস্যাটি নিয়ে বিচার বিবেচনা দরকার। সমস্যার সমাধানের জন্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতি দরকার। গণতন্ত্রের অভাবে অনেক ভালো সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলোর অন্ধ অনুসারী হয়ে চিন্তা ও কাজ চলছে, এবং তাতে সমস্যা জটিলতর হচ্ছে।
দ্য মিরর এশিয়া : সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট নিয়ে বলুন।
আবুল কাসেম ফজলুল হক : সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের সংস্কার দরকার। ভিন্ন মতপ্রকাশের সুযোগ যথাসম্ভব অবধারিত রাখতে হবে।
দ্য মিরর এশিয়া : সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ কেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : সরকার তো ব্যর্থতা স্বীকার করে না। ভোগবাদী, সুবিধাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলছে সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র। এরমধ্যে পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রেই ব্যবসায়ী বড় বণিকেরা রাষ্ট্রীয় শাসন ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ফেলেছে। এ-অবস্থায় সরকারকে বিচার বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সরকার তো ব্যবসায়ীদের অসন্তুষ্ট করতে চায় না। অবস্থা চাপে বাধ্য হয়ে সরকার মাঝে মাঝে কঠোর কর্মসূচি নিয়ে দ্রব্যমূল্য কম রাখার চেষ্টা করে। তাতে কিছু সুফল হয়। কিন্তু এই সুফল কম সময়ের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। ঋণগ্রস্ততার মধ্যে সরকারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়।
দ্য মিরর এশিয়া : স্বৈরশাসক ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে বলুন।
আবুল কাসেম ফজলুল হক : পক্ষপাত মুক্ত থেকে বলা যায়, চলমান ধারায় সরকার দুর্বল। দেশের রাজনীতি সাধারণভাবে দুর্গত। পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলো, সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে তাদের ওপর নির্ভরশীল রাখার জন্য নানাভাবে কাজ করে। চলমান ধারায় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উন্নতির সম্ভাবনা দেখা যায় না। উন্নতশীল অবস্থায় উত্তরণের জন্য পুরো ব্যাপারটিকেই বিচার বিবেচনা করে দেখতে হবে এবং নতুন কর্মসূচি নিয়ে কাজ করতে হবে। মুক্ত বাজার অর্থনীতি নিয়ে সরকারের পক্ষে বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। বিবেক এবং যুক্তি অবলম্বন করে চিন্তা ও কাজ করলে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সৃষ্টির উপায় পাওয়া যাবে। আর্থ-সামাজিক রাষ্ট্রিক বিষয়গুলোতে নৈতিক বিবেচনাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
দুনিয়াব্যাপী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থাকে উন্নত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে হবে।
দ্য মিরর এশিয়া : দ্য মিরর এশিয়া'র থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
আবুল কাসেম ফজলুল হক : আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।