যুক্তরাষ্ট্র একটা স্লো গেইম খেলছে: নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক আলোচিত উপাচার্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। তিনি জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের (জানিপপ) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। ড. কলিমউল্লাহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৭ সালে অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক এবং ২০১১ সালে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট-এর লেজিসলেটিভ ফেলোশিপ অর্জন করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দ্য মিরর এশিয়ার মুখোমুখি হন নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমাদের ঢাকা প্রতিনিধি
দ্য মিরর এশিয়া: আপনি বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে নানা সময়ে বিভিন্ন মতামত দিয়ে আসছেন। যার কিছু কিছু বাস্তবে ঘটলেও, বেশিরভাগই ভুল প্রমাণিত হয়েছে...।
নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: যেটা ট্রেন্ড, সেটা হচ্ছে যতক্ষণ পর্যন্ত এই- ‘'ফার্স্ট পাসড দি পোস্ট’ সিস্টেমে পরিবর্তন না আসছে, ততক্ষণ পর্যন্ত পার্সেন্টেজ অব টার্নআউট (ভোটের শতকরা হার) ম্যাটার করছে না। এটার কোন রেলেভেন্স (গ্রহণযোগ্যতা) নেই। আইনত এটি নিয়ে কথা বলার সুযোগও ওই অর্থে নেই। ইন ফ্যাক্ট, যারা নির্বাচিত হচ্ছে, ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ার জন্য নির্বাচিত হচ্ছেন এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা মাইনরিটি (কম মানুষকে) প্রতিনিধিত্ব করেন, মেজরিটিকে প্রতিনিধিত্ব করেন না। সিস্টেমটা কাজ করছে না। বিশ্বের ৮০ টিরও বেশি দেশে ‘গ্রোপর্শনাল রিপ্রেজেনটেশন’ চালু আছে; যাকে বাংলায় সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা বলে থাকি। অনেক দেশে সেকেন্ড রাউন্ডের ব্যবস্থা আছে। অর্থাৎ ফিফটি পার্সেন্ট ভোট কাস্ট না হওয়া পর্যন্ত দ্বিতীয় ধাপ, তৃতীয় ধাপের ভোট চলতে থাকে। সেরকম নির্বাচনী পরিবেশ বা পরিস্থিতি আমাদের দেশে তৈরি হয়নি। এ কারণে এক প্রকার ভোটার ফ্যটিগ (অবসাদ) দেখা দিয়েছে আমাদের দেশে। নিম্নমুখী হচ্ছে ভোট প্রদানের হার।
দ্য মিরর এশিয়া: আপনি বলেছিলেন ভোটের পর যুক্তরাষ্ট্র নানা পদক্ষেপ নেবে; কিন্তু বাস্তবে কিছুই করল না তারা।
নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: এটা একটা বিরাট ক্যানভাসের খেলা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে পুরো বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো, এখন আর পারছে না। ক্রমে বিশ্বরাজনীতি একটা মাল্টি পোলারাইজেশনের (বহুমাত্রিক শক্তির) দিকে যাচ্ছে। ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে যে পরিস্থিতি তৈরি করেছেন; এর ফলে অনেক বিবেচনা নতুন করে ভাবতে হচ্ছে, করতে হচ্ছে। আর চীন অর্থনৈতিকভাবে সম্প্রসারণশীল। তার যে ব্যাকইয়ার্ড এশিয়া মহাদেশে, সেটা তার মতো করে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। ইন্ডিয়া আঞ্চলিক পাওয়ার হিসেবে একটা অবস্থানে চলে গেছে। একটা সময় বিশ্ব ছিল ইউরোপ কেন্দ্রিক। তারপরে এটা হয়েছে উত্তর আটলান্টিক কেন্দ্রিক। একবিংশ শতাব্দীতে এশিয়া হচ্ছে বিশ্বের ভবিষ্যৎ। এশিয়ার একদিকে ইসরায়েল, আরেক মাথায় ফারইস্টে জাপান, কেউ কারো চাইতে কম না। বেশ কয়েকটি দেশ নিউক্লিয়ার ক্লাবে যোগ দিয়ে বসে আছে। ইসরায়েল, নর্থ কোরিয়ার মতো দেশও নিউক্লিয়ার ক্লাবে। ইরান তো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। আর ১৯৯৮ থেকে পাকিস্তান ও ভারত ওই ক্লাবে ঢুকে বসে আছে। সব মিলিয়ে এশিয়া মহাদেশ একটা শক্তির ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে কোনো সিদ্ধান্তে যেতে চাইলেও পারবে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বৈশ্বিক মানচিত্র একটা গঠন পেয়েছিল, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিবর্তিত হয়। তখন ভার্সাই চুক্তি ও ইয়াল্টার কনফারেন্সে ওয়ার্ল্ড ম্যাপ তার মতো করে একটা অবয়ব পেয়েছিল। নব্বইয়ে পূর্ব ইউরোপের পতনের পর নতুন একটা কাঠামো পায় বিশ্ব। নতুন নতুন রাষ্ট্র বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নিচ্ছে এবং ২০২৫ এর পরে এই প্রক্রিয়াটা আরো দ্রুত হবে।
দ্য মিরর এশিয়া: আপনি কি বলতে চাইছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে যে মার্কিন নীতি আছে, সেটা অকার্যকর?
নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: সেটা আমি বলছি না। খেয়াল করে দেখেন, ৭ জানুয়ারি ইলেকশন হলো, ৮ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র একটা ছোট স্টেটমেন্ট দিয়ে বলল ‘এই নির্বাচনটি ফ্রি ফেয়ার হয়নি’। তারা ফ্লাগ আউট করে রাখল বিষয়টা। তারা বলতে শুরু করল, আমরা সম্পর্ক পুনঃনির্ণয় করতে চাই। তার মানে এই নয় যে নির্বাচনের স্বীকৃতি দিয়ে দিচ্ছে। তারা যে লালকার্ড দেখিয়ে রেখেছে, সেটা তারা বাদ দিচ্ছে না। তারই অংশ হিসেবে তারা জেনারেল আজিজের ক্ষেত্রে স্যাংশনটা (নিষেধাজ্ঞা) করেছে, জানান দিয়ে করেছে। সাবেক যে ভিসানীতি, সেক্রেটারি অব স্টেট যেটা করেছিলেন, সেখানে বিরাট একটা প্রাইভেসি বিরাজমান ছিল। জেনারেল আজিজের বিষয়টি পাবলিক করে দেয়া হয়েছে । র্যাবের সাবেক ও বর্তমান ছয়জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্যাংশন এল। সেরকমই এল, ভিন্নভাবে। এবং এটা থেমে থাকবে না। দেখবেন ঈদুল আজহার (কোরবানি) পরে আরো কিছু পদক্ষেপ আসবে। তখন অঙ্কটা মেলাতে পারবেন।
দ্য মিরর এশিয়া: নির্বাচনের আগে ও পরে বলা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ছাড় দেবে না। যুক্তরাষ্ট্র কি আরো স্যাংশন দেবে?
নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: তারা আমাদের প্রেক্ষাপটে দেবে না। তারা যখন অ্যাপ্রোপিয়েট মনে করবে, তখন (স্যাংশন) দেবে। যখন তারা মনে করবে রাইট, তখন তারা সেটা করবে। তারা একটা স্লো গেইম খেলছে। আজিজের ইস্যুটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিষয়টাকে একটা পার্সপেক্টিভে ভাবি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের একটা অংশ নিয়ে একটা রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। এটার কোনো ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছেন ডোনাল্ড লু। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা আছে। একেবারেই কিছু হচ্ছে না, এমনটা নয়। যা রটে, তার কিছুটা ঘটেও। পাহাড়ে চলমান অস্থিরতায় আমাদের প্রচুর সেনা সদস্য কিন্তু মারা যাচ্ছে, তার পুরোটা কিন্তু সামনে আসছে না। আমরা প্রকাশ করছি না। একটা পর্যায়ে গিয়ে এটা ইফেক্ট করবে।
দ্য মিরর এশিয়া: পাহাড়ে যে অস্থিরতা চলছে, তার সাথে নতুন রাষ্ট্র গঠনের যে সন্দেহ করা হচ্ছে, এ দুই প্রক্রিয়ার কোনো মিল আছে বলে মনে করেন?
নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: এ প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে দুই হাজার ৭০০ বছর আগে। আমি যেটা বারবার বলার চেষ্টা করেছি, বনী মানেসারা এখানে এসে সেটেল করেছে। এবং এই যে গাজায় যুদ্ধ চলছে, সেখানে হাজারখানেক বনি মানেসা মানুষ গেছে যুদ্ধ করতে। সে জন্য বিষয়টি এখনও প্রাসঙ্গিক। ইসরায়েলের যা আছে, এর সিকিও নেই আমাদের। আমরা তো তথ্যহীন। আগামী ২০২৫ এর পরে বিষয়টা আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে। আফগানিস্তান থেকে শুরু করে বাংলাদেশ পুরো টেরিটরি নিয়ে কাজ চলছে। ইন্ডিয়ান রিউনিফিকেশন অ্যাসোসিয়েশন পুরোদমে কাজ শুরু করেছে দিল্লিতে অফিস নিয়ে।
দ্য মিরর এশিয়া: আমরা দেখেছি আপনার অনেক তথ্যই সঠিক হয়নি।
নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: হবে না তো। আমি তো ফোর টেলার না। আমি তো অ্যানালাইসিস করে বলি। আর সময়ের একটা ব্যাপার আছে। আমাদের বিষয়টি তো প্রাথমিক ব্যাখ্যা।
দ্য মিরর এশিয়া: সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ: দ্য মিরর এশিয়াকেও ধন্যবাদ।