গরু এবং খাসির মাংস কেনা অসম্ভব কমে গেছে: বিনায়ক সেন
রাষ্ট্রায়ত্ত গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক (ডিজি) বিনায়ক সেন একজন গবেষক ও অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। তিনি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), জাইকা, ইউএনএসকাপ, ডিএফআইডি ও ইউএনডিপির মতো সংস্থায় পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্প্রতি চলতি বছরের ঘোষিত বাজেট নিয়ে কথা বলেছেন দ্য মিরর এশিয়ার সঙ্গে।
দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণ কী?
বিনায়ক সেন: উচ্চ মূল্যস্ফীতি হচ্ছে মূলত খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে। মূল্যস্ফীতির ঝুলিতে এ খাদ্যের ওয়েটেড এভারেজ কিন্তু খুব বেশি না, মাত্র ৪৪ শতাংশ। ২০২২-২০২৩ থেকে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের নন-ফুড মূল্যস্ফীতির তথ্য পর্ষালোচনা করলে দেখা যায়, খাদ্য মূল্যস্ফীতি নন-ফুড মূল্যস্ফীতির চেয়ে অনেক বেশি হারে বেড়েছে। দেশে খাদ্যের দাম কেন বাড়ছে তার একটা সদুত্তর দরকার। সেটা কি বাজার কাঠামোর জন্য বাড়ছে? কারণ চট্রগ্রামের খাতুনগঞ্জে এখন একটা নতুন বাজার কাঠামো কাজ করছে, সেই কারণে? না কি সরকারের ট্রেডিং নীতির কোনো অসঙ্গতি রয়েছে? এমনিতে আমদানি করা নিত্যপণ্যের শুল্ক অনেক কমানো হয়েছে। ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বলতে গেলে সব ধরনের নিত্যপণ্যের সাপ্লিমেনন্টারি ডিউটি (এসডি) এবং রেগুলেটারি ডিউটি (আরডি) কমানো হয়েছে । আগামী অর্থবছরের বাজেটেও কিন্তু একটা লম্বা তালিকা আছে কোন কোন ক্ষেত্রে এসডি আর আরডি কমানো হয়েছে। এটা আমার কাছে এখন রহস্যময় মনে হয়, কেন দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ছে? এর মানে এই না, খাদ্য কেনার বা খাওয়ার পরিমাণ ব্যাপক হারে কমে গেছে।
জনগণ কি দামি প্রোটিন যেমন, গরু ও খাসির মাংস বা রুই-কাতল ও ইলিশ কেনা কি কমিয়ে দিয়েছে?
বিনায়ক সেন: ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের খাদ্যের ভোগের পরিমাণ যদি তুলনা করি, তা দেখাচ্ছে না যে খাদ্য কেনার পরিমাণ কমেছে। কম মূল্যস্ফীতি থেকে বেশি মূল্যস্ফীতির দিকে যাওয়ার পরও প্রথমত দেখা গেছে, দেশে জনগণের ডিম খাওয়ার পরিমাণ মোটামুটি স্থিতিশীল আছে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, মাছ খাওয়ার পরিমাণ কমলেও বিআইডিএস থেকে গবেষণায় আমরা অন্যান্য দামি মাছের চেয়ে তেলাপিয়া এবং পাঙ্গাস কেনার পার্থক্য তুলনা করে দেখছি, এ মাছগুলো খাওয়ার পরিমাণটা বেড়েছে। মানে হচ্ছে, উচ্চমূল্যের আমিষ খাওয়া কমিয়ে কম মূল্যের আমিষ খাচ্ছে মানুষ। যেমন, গরু এবং খাসির মাংস কেনা অসম্ভব কমে গেছে। মাছের মধ্যে রুই-কাতল কেনা কমেছে, কিন্তু কম দামের মাছ তেলাপিয়া এবং পাঙ্গাস খাওয়া কমেনি বরং বেড়েছে। আরেকটা হচ্ছে, চাল কেনা বেড়েছে।
আগামী বাজেটে অর্থনীতিতে কী ধরনের সংশোধনের কথা বলা হয়েছে?
বিনায়ক সেন: এ বাজেটের তিন ধরনের কারেকশন ম্যাজার্স নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ রকম ওভার ভ্যালুড এক্সচেঞ্জ রেট দেশে এতদিন থাকাটা উচিৎ ছিল না। দুই নম্বর হচ্ছে, দেশে ব্যাংকের সুদের ওপর নিয়ন্ত্রণটা বাংলাদেশ ব্যাংক উঠিয়ে নিয়েছে। ব্যাংকের আমানতকারিদের রেইট দেখেন ৯ থেকে ১০ শতাংশ হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেক ব্যাংক আমানতকারীদের সুদের হার সাড়ে দশ শতাংশ দিয়ে থাকে। তিন বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যেই ঘোরা-ফেরা করছে, বলতে গেলে এই রকম আছে। সুতরাং সত্যকার আমানতের সুদ নেগেটিভ। এখন কিন্তু আমানতকারীরা স্বস্তিতে নেই। সুদের ওপরে আরো নানা ধরনের ব্যাংকের ফি দিতে হয়। সুতরাং এ সংশোধনটাও দরকার ছিল। তৃতীয় সংশোধন হচ্ছে, আমাদের বাজেটের যে রাজস্ব সম্প্রসারণ নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। সেই রাশটা টেনে ধরার দরকার ছিল। তবে এ তিন পদক্ষেপ নতুন নয়। এ বাজেটে চাহিদা ব্যবস্থাপনায় অভ্যন্তরীণ উৎপাদনকে উৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে । সেটা কৃষি তো বটেই, নীতিগত ভাবে কৃষিতে আরো জোর দেওয়া দরকার ছিল। যদিও এটা আমরা সবাই স্বীকার করি, বাজেটে মধ্য আয়ের দেশ হিসাবে বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে আমরা পড়ে গেছি। তাই অভ্যন্তরীণ শিল্প উৎপাদন বাড়তে গেলে, আরো সচেতন হওয়া উচিৎ। এ বছরের বাজেটে আমরা জানলাম, গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এতগুলো নতুন শিল্প হচ্ছে। বিরাট এক শিল্প উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হচ্ছি আমরা। এটি শুধু কথার কথা নয়, আমি উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি। বাংলাদেশের ম্যনাুফেকচারারি জিডিপির অনুপাত হচ্ছে ২১ শতাংশ, ভিয়েতনামে ২৪ শতাংশ, আর চীনে সেটা ২৮ শতাংশ। সুতরাং আমরা সেই অর্থনৈতিক পথেই আছি, দেশের ম্যানুফেকচার সেক্টর সে পথেই আছে। সেই রুটে শুধু রপ্তানিভিত্তিক প্রবৃদ্ধি নয়, সেই রুটে অভ্যন্তরীণ যে চাহিদা আছে, ক্যাটারিং টু দেশের অভ্যান্তরীণ চাহিদা। এ বাজেটে শিল্পনীতির একটা ভূমিকা আছে। সেই ভূমিকাটা কতটি স্বার্থক? বেসরকারি খাতের লোকজনের সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়টা আরো যৌক্তিক করা যায়। সে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ। অভ্যান্তরীণ শিল্প নিয়ে আরো কাজ করার সুযোগ আছে।
আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘাটতির পারিমাণ কি ঠিক আছে?
বিনায়ক সেন: বাজেটের ঘাটতি জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ঘাটতিটা কমানো উচিৎ ছিল। বাজেটে আরো সংকোচন মূলক নীতি গ্রহণ করা উচিৎ ছিল। কারণ এ ৯ শতাংশের ওপরে মূল্যস্ফীতি আমাদের ভোগাবে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অবশ্যই আরো ঘাটতি কমানো উচিত। যারা মত রাখছেন ঘাটতি তিন শতাংশ করা উচিৎ, আসলে এটা ৪ শতাংশ করা উচিৎ ছিল। তা হলে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য আরো ভালো হতো। এ কারণে আমাদের এটা দরকার, সরকারি খাতের ঋণ কমিয়ে ফেলা উচিৎ ছিল। তা না হলে বেসরকারি খাতে ঋণের ধারা ধরে রাখা যাবে না ।
বাজেটে বিনিয়োগ হিসাব ঠিক আছে?
বিনায়ক সেন: ২০২২ সাল থেকে আমরা হিসাব করি নয় শতাংশ যদি জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়। তাহলে আমাদের মোট বিনিয়োগ দরকার ৪১ শতাংশ। এখন সেটা ৪৫ কাছাকাছি হতে হবে। এখনকার বিনিয়োগ ৩১ শতাংশ থেকে ৪১ শতাংশ। ফলে ২০২২ থেকে ২০৩১ গড়ে ৪১ শতাংশ বিনিয়োগ প্রয়োজন পড়বে। আমরা ইতিমধ্যে প্রবৃদ্ধির পথ থেকে ডেভিয়েট করে বিনিয়োগের পথে এসেছি। তার মানে হচ্ছে, আমাদের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে অর্থনীতিতে বড় ধরনের কাভার অপ করতে হবে। এ বিষয়টি আশা করি নীতি নির্ধারকরা যারা আছেন, বেসরকারি খাতের লোকজনও বিষয়টি স্বীকার করে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেবেন।
সার্বজনীন পেনশন স্কিম থেকে জনগণ কি বড় সুবিধা পাবে?
বিনায়ক সেন: সার্বজনীন পেনশন স্কিমটা তৈরি করতে আরো ভালো করে ওয়ার্ক আউট করা হয়েছে কি না? আমরা সম্প্রতি বিআইডিএস থেকে একটা গবেষণা হাতে নিয়েছি। আমরা যেটা মনে হয়েছে, দেশের এ স্কিমটা সাস্টেনেবল হবে কি না? অবসরে গেলে এক সঙ্গে অনেক টাকা পেত সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তারা, সেটা আর স্কিমে থাকছে না।
বাজেটে হেলথ কার্ডের বিষয়টা এসেছে?
বিনায়ক সেন: বাজেটে কিন্তু হেলথ কার্ডের কথা বলা হয়েছে। এ বাজেটে এটা একটা ভালো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খুব প্রয়োজনীয় কার্ড, সেটাকে আবার রিভাইজ করা হয়েছে। রিভাইজের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।