আটক হওয়ার আগে নাহিদের সাক্ষাতকার

আটক হওয়ার কিছুক্ষন আগেই শুক্রবার ঢাকার একজন সাংবাদিককে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের বেডে শুয়ে সাক্ষাতকার প্রদান করেন বৈষম্য নিরসন ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। এরপরই নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদকে ধরে নিয়ে যায় গোয়েন্দারা। প্রথমে স্বীকার না করলেও পরবর্তীতে  ঢাকার গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশিদ জানান নিরাপত্তাজনিত কারণে তাদের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। এর আগে নাহিদসহ কয়েকজন সমন্বয়ককে গুম করা হয়েছিল। 

তবে গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, সরকারর সঙ্গে আপস করতে রাজি না হওয়ায় নাহিদ ইসলামসহ অন্যান্য সমন্বয়ক, গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুরসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে সরকার পতন ষড়যন্ত্রের মামলার পরিকল্পনা করছে সরকার। এ উদ্দেশ্যেই নাহিদসহ কয়েকজনকে ফের আটক করা হয়েছে। 

আটক হাওয়ার আগে নাহিদ ইসলামের দেওয়া সাক্ষাতকারটি দ্য মিরর এশিয়ার পাঠকদের জন্য এখানে দেওয়া হলো:

আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা তো কোটা সংস্কারের জন্যই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে করেছি আন্দোলনটা। কোটা সংস্কার একটা অরাজনৈতিক আন্দোলন এবং শিক্ষার্থীদের স্বার্থের দাবি। আমরা শুরু থেকেই এই আন্দোলন এতদূর নিয়ে আসতে হবে, সেটা চাইনি। আমরা বরাবরই চাইছিলাম সরকার এখানে হস্তক্ষেপ করুক। প্রথমদিকে অন্তত একটা আশ্বাস দিক। বা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করুক যাতে আমরা আন্দোলন থেকে সরে যেতে পারি।

কিন্তু সরকার প্রথম থেকেই দায়িত্বহীন আচরণ করেছে। আমাদেরকে বারবার আদালত দেখিয়েছে। আদালতকে ব্যবহার করে কালক্ষেপন করার চেষ্টা করেছে। ফলে আমাদেরকেও আন্দোলনে থেকে যেতে হয়েছে। এক পর্যায়ে আন্দোলনে দমনে প্রথমে প্রেরণ করে ছাত্রলীগ।এরপরে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাণ্ডব শুরু করে। এরপরই আন্দোলনের স্ফূরণ ঘটে। 

তিনি বলেন, আমরা তো আন্দোলন করার জন্য রাস্তায় নামি নাই। আমরা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি দেখেই পড়ার টেবিল ছেড়ে রাজপথে নেমেছি। 

বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিয়ে তিনি বলেন, পুরো আন্দোলনটাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুরু হয়েছে। শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন শুরু করেছিল। পরবর্তীতে আমরা সমন্বয় করেছি। যখন আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের উপর ছাত্রলীগ, যুবলীগ হামলা করে, এর পরেই সারা দেশের ছাত্ররা নেমে গেল। রংপুরে আবু সাঈদ নিজের বুক পেতে দিল গুলির সামনে। এবং যখন আমাদের হল গুলো বন্ধ করে দেওয়া হলো জোর করে। এবং আমাদের বের করে দেয়া হলো পুলিশ বিজিবি গুলির সামনে। যখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কারো কাছে নিরাপত্তা পাচ্ছিলাম না। তখন আমরা অভিভাবকসহ সর্বস্তরের নাগরিকদেরকে আহ্বান জানিয়েছিলাম। আপনার সন্তান যৌক্তিক দাবিতে রাজপথে আছে, নিরাপত্তাহীনতায় আছে ,তার বুকে গুলি চালানো হচ্ছে। তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে আপনারা সবাই নেমে আসুন। আমাদের সেই আহানে সারাদেশের মানুষ সাড়া দিয়ে রাজপথে নেমে এসেছে শিক্ষার্থীদের পাশে রাজপথে দাঁড়িয়েছে। ফলে কোটা সংস্কার আন্দোলন একটি গণ আন্দোলনের রূপ নিয়েছে।

প্রথম দফায় গুম করা প্রসঙ্গে নাহিদ ইসলাম জানান, আমাকে তুলে নেয়া হয়েছিল যাতে আমি এই আন্দোলনে নেতৃত্ব বা নির্দেশনা দিতে না পারি। ওই সময়টায় তখন সারাদেশে শাট ডাউন চলছিল। আমাদের আহবানে সবাই নেমে এসেছিল তাই আমাদের মুখ  রোধ করে দেওয়ার জন্য ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমরা সরকারের সাথে আলোচনা প্রত্যাখ্যান করেছি আপোষ করি নাই। এ কারণে আমাকে নির্যাতন করা হয়েছিল। এ আন্দোলন থেকে সরে আসার জন্য। ভয়-ভীতি দেখানো হয়েছে। পরবর্তীতে নাগরিক সমাজসহ নানামুখী চাপে আমাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। 

আদালতের রায় সম্পর্কে তিনি জানান, আমরা কোটা সংস্কারের জন্য নেমেছিলাম। কোটা সংস্কারের বিষয়টা সরকারের জায়গা থেকে এক ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই পদক্ষেপে আমরা সন্তুষ্ট নই। আমরা ২০১৮ সালেও দেখেছিলাম সরকার আন্দোলনের মুখে তড়িঘড়ি করে একটা পরিপত্র দিয়েছিল। পরবর্তীতে পরিপত্র নিয়ে আদালতসহ নানা জায়গা থেকে প্রশ্ন উঠেছিল। আমরা এবার প্রথম থেকেই বলেছিলাম এবার যেন চূড়ান্ত সমাধান হয়। যাতে কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে না হয়। সেই জায়াগা থেকে আমরা বলেছিলাম শিক্ষার্থীসহ সব অংশীজনের সংলাপের ভিত্তিতে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। আমরা একটা স্বাধীন কমিশন গঠনের কথা বলেছিলাম যাতে সরকার চাইলেই পরবর্তীতে কোটা পরিবর্তন করতে না পারে। পরিবর্তন করতে হলে কমিশন ও অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে করতে হবে। আমরা অনগ্রসর গোষ্ঠীর কথা বলেছিলাম। এখানে নারী কোটা বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারীদের বিষয়টি আরো পরিস্কার হওয়ার প্রয়োজন ছিল। আমরা আমাদের নীতি পরিকল্পনা সংলাপের মাধ্যমে সরকারে কাছে তুলে ধরতে চাই। এজন্য যথাযথ পরিবেশ লাগবে। তাই সরকারি প্রজ্ঞাপন চূড়ান্ত হিসাবে গ্রহণ করছি না বা সমাধান বলে মনে করছি না। 

আন্দোলনের ভবিষ্যত নিয়ে নাহিদ জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলন এখন কোটাতে সীমাবদ্ধ নেই। এটা এখন গণআন্দোলনে পরিনত হয়েছে। সারাদেশের মানুষ আমাদের সঙ্গে নেমে গেছে। তারা হতাহতসহ নানা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। পরিবার পরিজন তাদের সন্তান হারিয়েছে। প্রত্যেকটি পরিবারেই হতাহত দেখতে পাচ্ছি। অনেকের সন্ধান পাচ্ছি না। বাবা মর্গে মর্গে তার সন্তানের লাশ খোঁজে বেড়াচ্ছে। 
আমরা এই মুক্তিকামী জনতার সঙ্গে আছি। যারা হত্যা করলো, যারা হত্যার নির্দেশনা দিয়েছে আমরা তাদের বিচার চাই। এ দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। আমরা নিজেরাও জীবন নিয়ে শংকায় আছি।। অন্যান্য সমন্বয়কদের পাওয়া যাচ্ছে না। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। 

তিনি বলেন, স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসুকে সেটা আমরাও চাই। তাই ইন্টারনেট খুলে দিলে, সকল বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিলে সব প্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষের মতামতের ভিত্তিতে পরবর্তী কর্ম পরিকল্পনা ও বক্তব্য জাতির সামনে পেশ করবো।