হাসিনার বড় বড় চক্রান্তে জড়িতদের মূল কাজ সব বেচে দেশের বাইরে চলে যাওয়া: হুম্মাম কাদের চৌধুরী

হুম্মাম কাদের চৌধুরী। ছবি: মঞ্জুর মোর্সেদ রিকি/দ্য মিরর এশিয়া

হুম্মাম কাদের চৌধুরী, তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং বিএনপির সাবেক মন্ত্রী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সন্তান। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাত মাস গুম ছিলেন হুম্মাম। পারিবারিকভাবে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হুম্মাম কাদের চৌধুরী সম্প্রতি দ্য মিরর এশিয়ার আসিফ শওকত কল্লোল ও মঞ্জুর মোর্সেদ রিকির সঙ্গে দেশের অর্থনীতি নিয়ে কথা বলেছেন।

দ্য মিরর এশিয়া: বসুন্ধরা, ওরিয়ন, সামিট এবং নগদসহ বড় সাতটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনাবেচা বন্ধ করতে বলেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সবগুলো প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণের ব্যবস্থা করা হতে পারে। এ বিষয়ে আপনার মত কী? অন্যদিকে তো সালমান এফ রহমান গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন- এস আলমের পাচার হওয়া টাকার অর্ধেকই শেখ রেহানা এবং সজিব ওয়াজেদ জয়ের কাছে আছে।

হুম্মাম কাদের চৌধুরী: অন্তর্বর্তী সরকারের এই উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাই। কারণ আমরা যতদূর বুঝতে পারছি, যতগুলো বড় কোম্পানির কথা লেখা আছে তার মধ্যে নগদ আছে। এগুলো আইনগতভাবে দেশে এদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আইনের মাধ্যমে এসব কোম্পানিকে গিলটি ঘোষণা করতে হবে। তখন আপনি বলতে পারবেন এরা দুর্নীতিতে জড়িত ছিল। এটা আমি মেনে নিলাম। ওরিয়নের মালিক ওবায়েদ করিমের ৪৮ বছর জেল হয়েছে। কিন্তু এটা বাংলাদেশ, এ জন্য তিনি সবাইকে ম্যানেজ করে জেলে না গিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এটা লিগ্যাল প্রসেসের মধ্যে না হলেও পাবলিক পারসেপশনের মাধ্যমে জনগণ এসব কোম্পানিকে দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে জানে। আমি ধন্যবাদ জানাব ইউনূস সরকারকে। সরকার পাবলিক পারসেপশনের ওপর কিছুটা ভরসা রেখে তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। হাসিনার বড় বড় চক্রান্তে যারা জড়িত তাদের মূল কাজ হচ্ছে, দেশের ব্যবসা থেকে বেরিয়ে এসে যত তাড়াতাড়ি কোম্পানিগুলো সম্ভব হলে সবকিছু বেচে ফেলা। পরবর্তীতে দেশের বাইরে চলে যাওয়া।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাউকে ম্যানেজ করে অথবা সামনে জামায়াত-বিএনপির কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে টাকা নিয়ে সেই ব্যবসায়ীরা দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠান সরকারের হস্তক্ষেপে পরিচালনার মাধ্যমে জনগণের কাছে টাকা ফিরিয়ে দিতে পারলে খুব ভালো হবে। নগদ একটা ফ্যান্টাস্টিক লুটপাটের ব্যবসা। আমাকে একজন বলল নগদের ৬০০ কোটি টাকা বাজারে আছে। এটা জনগণের টাকা। নগদ জনগণের টাকা লেনদেন করে এক টাকাও বাংলাদেশে রাখেনি। তারা শেয়ার মাকের্ট থেকে টাকা উঠিয়ে বিদেশে বাড়ি-ঘর বানিয়েছে। বিদেশে কোম্পানি বানিয়েছে। সব কিছু বিদেশে করেছে। বাংলাদেশে তাদের সম্পদের একটা কিছুও নাই। আমাদের সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে, যে টাকা কোম্পানিগুলো শেয়ার বাজার থেকে উঠিয়েছে, সেই টাকা পুনঃবিনিয়োগ করা হয়েছে কিনা তা যাচাই করে দেখা। একজন ব্যবসায়ীও সেই নিয়ম মেনে বাংলাদেশে টাকা বিনিয়োগ করেনি। এ কারণে সবগুলো ব্যবসার মালিকদের জেলে থাকা উচিৎ। বাকি অনিয়ম বাদই দিলাম। এ উদ্যোগ আওয়ামী লীগের ব্যবসায়ীরা কেউ নিল না। সাবেক ভূমিমন্ত্রী জাভেদ সাহেব তো পার পেয়ে যেত যদি আল জাজিরা এ রিপোর্ট না করত। আমাদের মধ্যে রাজনীতির বড় সমস্যা হলো, যতক্ষণ মিডিয়া না বলে ততক্ষণ কোনো অ্যাকশন নেওয়া হয় না। অন্যদিকে, জুলকারনাইন সায়ের এক অনুসন্ধানে দেখিয়েছেন, যুক্তরাজ্যে বসুন্ধরার প্রায় ১০০০ কোটি টাকা (৬০ মিলিয়ান পাউন্ড স্টার্লিং) মূল্যের ২৬টি সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া গেছে।

আমি অল্প বয়সে অনেক হিন্দি সিনেমা দেখেছি। অমরেশ পুরির যে হাসিটা ছিল, আল জাজিরার রিপোর্টে শেষে জাভেদ সাহেবের হাসিটা সে রকম ছিল। সেই হাসি দেখে মনে হলো, তার মধ্যে পাবলিকের অর্থ চুরির করার জন্য কোনো অনুশোচনা নেই। হাসতে হাসতে বলছেন ‘আমি বাড়ি থেকে বের হতে পেরেছি’। বুঝলাম, তুমি পালিয়েছো, তোমার চোদ্দগোষ্ঠী বাংলাদেশে আছে, তাদের তো জেল খাটতে হবে। সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের ব্যাংকে কী যে অবস্থা করেছে! অল্প টাকার চেক পাঠালে সেই ব্যাংক টাকাটা দিতে পারে না। আমি প্রমিনেন্ট পারসন, আমার টাকা না হয় ব্যাংক দিতে পেরেছে, বাকি মানুষ কী করবে, তাদের টাকা কে দেবে?

দ্য মিরর এশিয়া: পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত নিয়ে আসা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে।

হুম্মাম কাদের চৌধুরী: আমাদের ভুল বুঝানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার এতদিন ধরে ঢোল পিটিয়েছে বাইরের টাকা আমরা আনতে পারছি না। মনের মধ্যে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। ইউনূস সাহেব যাদের সাথে কথা বলেছে তারা তো বলেছে টাকা ফেরত দিতে পারবে।

দ্য মিরর এশিয়া: কীভাবে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা যাবে?

হুম্মাম কাদের চৌধুরী: যুক্তরাজ্যে জাভেদ সাহেবের ৩৬০টি বাড়ি নিলাম করতে হবে। খুবই দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। আর যুক্তরাজ্যে বসুন্ধরার প্রায় ১০০০ কোটি টাকা (৬০ মিলিয়ান পাউন্ড স্টার্লিং) মূল্যের ২৬টি সম্পত্তি এই নিলামের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। আমি যেটা প্রস্তাব করেছি, একটি সার্বভৌম সম্পদ তহবিল বা সভরেনট ফান্ড বানানো হবে। এসব পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ এ ফান্ডের মধ্যেই থাকবে। বাংলাদেশ সরকারকে ফান্ডের বিপরীতে ঋণ দেওয়া হবে। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করে। এলসি সেই ক্রেডিট লাইনের বিপরীতে হবে। সরকার আর দেশ থেকে ডলার পাঠাবে না। একটু ক্রিয়েটিভ চিন্তা করতে হবে। প্রতিটা দেশের একটা সভরেনট ফান্ড আছে। বাংলাদেশে সেটা নেই। আওয়ামী লীগ আমলে সভরেনট ফান্ড নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তখন বাংলাদেশের টাকা বিদেশে নিয়ে গিয়ে কীভাবে খেয়ে ফেলা যায় তার একটা ব্যবস্থা করতে চেয়েছিল। এমন দেশ আছে পাচার হয়ে যাওয়া টাকাটা ফেরত আনা খুবই সহজ। যেমন সুইস ব্যাংক থেকে টাকাটা ফেরত আনা খুব সহজ একটা ব্যাপার। আমাদের সুইজাল্যান্ডে কোনো বড় ব্যবসা নেই। কিন্তু যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রর সাথে আমাদের অনেক ব্যবসা। যেখানে যে নীতিটা ব্যবহার করা যায় তাই করা উচিৎ হবে। আউট অব দ্য বক্স চিন্তা করতে হবে। অনেক কিছুই সম্ভব; রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে।

দ্য মিরর এশিয়া: আপনাদের পারিবারিক ব্যবসার কী অবস্থা?

হুম্মাম কাদের চৌধুরী: বিজনেস, আমরা গত ১৬ বছরে এই শব্দটাই ভুলে গেছি। আমাদের পারিবারিক যে ব্যবসাগুলো রয়েছে, যেমন ধরেন শিপিং বিজনেস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলে এমন হয়েছে যে, আপনি যদি একটি ব্যাংকের কাছে গিয়ে বলেন আপনার শিল্পের জন্য ফান্ড লাগবে, ব্যাংক পারলে আপনাকে দৌড়ানি দেবে। ওরা বলবে এই অফিসে ঢুকছিস কেন? এই অবস্থা আমার পরিবারের জন্য বলব না, বেশিরভাগ বিএনপি ঘেঁষা মানুষের সাথে এটা হয়েছে।আমরা চেষ্টা করেছি। আল্লাহ চালিয়ে নিয়ে যাবে। মানুষজন অনেক সাহায্য করছে। যখন আমাদের দরকার পড়েছে তখনই সাহায্য করেছে।

দ্য মিরর এশিয়া: অনেকে তো আওয়ামী লীগকে ম্যানেজ করে ব্যবসা করেছেন।

হুম্মাম কাদের চেীধুরী: আওয়ামী লীগের সাথে হাত মিলিয়ে অনেকেই করেছে। আমরা এটা পারিনি। একে তো মন মানে না, দ্বিতীয়ত এই নোংরামির সাথে আমরা জড়াতে চাইনি। আওয়ামী লীগ যে দুর্নীতি করেছে এর ভাগিদার হতে চাইনি আমরা। আব্বা আমাদের জন্য কিছু রেখে যেতে পারেননি, কিন্তু মানুষের কাছে সম্মান এবং ভালোবাসা রেখে গেছেন। আমাদের শিপিং ব্যবসার সাথে ৪০ বছর একসাথে কাজ করেছে এক ভদ্রলোক। স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন আগে জুন মাসে তাকে সিআইডি তুলে নিয়ে যায়; যাতে আমরা ব্যবসা করতে না পারি।

দ্য মিরর এশিয়া: অন্তর্বর্তী সরকারের এই দুই মাসে বাংলাদেশের অর্থনীতি কেমন চলছে?

হুম্মাম কাদের চৌধুরী: এই অন্তর্বর্তী সরকার খুবই কষ্টে দেশ চালাচ্ছে। এখন আমরা গাড়ি উদারহণ হিসেবে টানতে পারি। ইঞ্জিনটা অনেক দিন বন্ধ ছিল। গাড়ি চালু করতে অনেক সময় লাগবে। গত দুই মাসের মধ্যে মোর অর লেস সবকিছু বন্ধ ছিল।  স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের যে মিথ্যা কথা বলে যেত- আরে রিজার্ভে এত টাকা আছে, ব্যাংক সব ভালো আছে, এ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। কিন্তু যখন ব্যাংকগুলোর করুণ বাস্তবতাটা চোখের সামনে চলে আসে, তখন আমরা তো একটু ভয় পেয়ে যাই। তার ওপর অন্তর্বর্তী সরকার আমলে ব্যাংকগুলো বলা শুরু করল, আসলে তাদের হাতে কোনো টাকা নাই।  আমরা এতদিন জোর-জবরদস্তি করে ৩০ শতাংশ মার্জিনের মধ্যে এলসি খুলছি। ব্যবসায়ীরা এখন অবস্থাটা বুঝতে পেরেছে। এখন যদি দরকার পড়ে ব্যবসায়ীরা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মার্জিনে এলসি খুলব। দেশের মানুষের প্রতি আমার একটা বিশ্বাস আছে। হ্যাঁ, এখন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য কষ্ট পাচ্ছে, কিন্তু জনগণ মাইন্ড করছে না। নিত্যপণ্যের একটু বেশি খরচা করতে  হচ্ছে জনগণকে, কিন্তু সেটা তারা মেনে নিচ্ছে। যেহেতু স্বাধীনতার জন্য ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছে, ঠিক আছে আমি এখন আমরা ব্যবসা থেকে বড় লাভ নিলাম না, কষ্ট মেনে নিলাম। এখন রেমিট্যান্স যে হারে বাড়ছে, দেশের প্রবাসী মানুষের ধারণা হয়েছে শেখের বেটি শেখ হাসিনাকে কোনো টাকা দেবে না তারা। কিন্তু ইউনূসের সরকারকে দিতে রাজি আছে। আমাকে একজন বলছেন, এই সরকারের আমলে বড় বড় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম কে বন্ধ করে দিচ্ছে সেসব প্রতিষ্ঠান? কোনো উত্তর নেই।