আমরা ভালো খেলতে পারি এবং ভালো খেলতে পারব

সাবিনা খাতুন। ফাইল ছবি

সাফ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের শুরুটা ছিল হতাশার। শিরোপা ধরে রাখার অভিযানে অপ্রত্যাশিত ড্র করে বসে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। একে তো হতাশায় শুরু, এর ওপর দলের ভেতরে নানামুখী কোন্দলের খবর সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে গ্রুপের দ্বিতীয় ম্যাচে ভারতকে গুঁড়িয়ে সব সমালোচনা দূরে সরিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। এমন এক জয়ের পর দ্য মিরর এশিয়াকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। ভারতের বিপক্ষে জয়ের গল্প তো বলেনই, জবাব দিয়েছেন তাদের নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনারও।

দ্য মিরর এশিয়া: ক্যাপ্টেন, অনেক অভিনন্দন আপনাকে ও আপনার দলকে। ভারতকে রীতিমতো গুঁড়িয়ে দিলেন আপনারা। অনেক চাপের মধ্যে থেকেও কীভাবে সম্ভব হলো এটা?

সাবিনা খাতুন: প্রথমেই ধন্যবাদ আপনাকে। সব কৃতিত্ব আমি মেয়েদের দেব। সবাই অসাধারণ খেলেছে। আর রহস্য যদি জানতে চান, তাহলে সেটা কোনো জাদু-মন্ত্র ছিল না। আমরা ভালো খেলতে পারি এবং ভালো খেলতে পারব, এই বিশ্বাসটা ছিল। সেই সঙ্গে দলের সবার একে অপরের বিশ্বাসটা ছিল মুখ্য। এসব কারণেই এমন পারফরম্যান্স সম্ভব হয়েছে। মেয়েরা নিজেদের জন্য খেলেছে, দেশের জন্য খেলেছে, দেশের সম্মান রক্ষার্থে খেলেছে।

দ্য মিরর এশিয়া: নানা কারণে অনেক কিছু এলোমেলো ছিল। ওই অবস্থা থেকে দলকে কীভাবে এক ছাতার নিচে নিয়ে এলেন?

সাবিনা খাতুন: আমি প্রত্যেকটা ম্যাচের আগে ট্রাই করি ছোটন স্যারের (নারী দলের সাবেক কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন) সঙ্গে একটু কথা বলার। কারণ ১৪ বছরের সম্পর্ক ওনার সঙ্গে। আমার কাছে মনে হয় যে আমার থেকে ভালো উনি আমাকে চেনেন। শুধু আমাকে না, প্রত্যেকটা খেলোয়াড়দেরই। স্যার বলেছিলেন, তোমরা যদি হারো, তোমরা সেমিতে যাবা। তোমরা যদি জিতো, তোমরা সেমিতে যাবা, তোমরা যদি ড্র করো তাও সেমিতে যারা। তবে ফাইনাল খেলার একটা সুবর্ণ সুযোগ থাকবে যদি তোমরা জান-প্রাণ দিয়ে খেলে ভারত ম্যাচ জেত। সবাইকে আমি শুধু এই মেসেজটা ফরোয়ার্ড করেছিলাম। তবে বলিনি যে, স্যার এটা বলেছেন। যেহেতু অনেক বিতর্ক হচ্ছে। আমার মনে হয়েছে, এই বার্তাটা আমার থেকেই যাক।

দ্য মিরর এশিয়া: মাঠে আপনাদের উদযাপনেই ফুটে উঠেছে এই জয় দলটার মধ্যে কতটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। ভারত ম্যাচ শেষে হোটেল ফেরার পর জয় উদযাপনটা কেমন হলো?

সাবিনা খাতুন: কোনো উদযাপন হয়নি। এখন মেয়েদের সবার দৃষ্টি সেমিফাইনালে। আর পাকিস্তান ম্যাচ বলেন বা ভারত ম্যাচ, এখন পর্যন্ত যা হয়েছে, সবকিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ।

দ্য মিরর এশিয়া: কিন্তু পাকিস্তান ম্যাচের পর তো অনেক সমালোচনা চলছিল। মনিকা চাকমা বলেছিলেন প্রধান কোচ পিটার বাটলার সিনিয়রদের পছন্দ করেন না। একাদশে রাখতে চান না। এরপর ভারত ম্যাচে সিনিয়রদের প্রধান্য দেওয়া হলো। আসলে সব মিলিয়ে পরিস্থিতি কতটা জটিল ছিল আপনাদের জন্য?

সাবিনা খাতুন: সত্যি বলতে এটার জন্য অনেক ফাইট করতে হয়েছে। এক প্রকার বলা যায় এটা আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ, যখন এরকম একটা বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তখন কোচও খুশি হয়নি। দেখুন, মারিয়া, মনিকা, ঋতুপর্ণা- ওরা ক’দিন আগে ভুটানে সম্প্রতি এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলে এসেছে। ওখানে ৯০ মিনিট ওরা আধিপত্য করে খেলেছে। আমার কাছে মারিয়া-মনিকা মিডফিল্ডে বেস্ট জুটি। ওই জায়গাতে আমার মনে হয় না বিকল্প কেউ এখনও তৈরি হয়েছে। আর মাসুরা যদি ডিফেন্সে দাঁড়িয়ে যায় তাহলে আমাদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় না। ওরা দলের জন্য অপরিহার্য। পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের সঙ্গে ম্যাচের পর হোটেলে দেখা। ওরাই যেমন বলল- মারিয়া, মাসুরা, সানজিদা, কৃষ্ণাদের একাদশে না দেখে ওরা অবাক ছিল।

দ্য মিরর এশিয়া: সিনিয়র খেলোয়াড়দের সঙ্গে জুনিয়র খেলোয়াড়দের কোন্দল চলছে বলে গুটি কয়েক সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে। এনিয়ে কি বলবেন?

সাবিনা খাতুন: এই বিষয়টা খুবই দুঃখজনক। আমি খুবই বিস্মিত যে এই বিতর্কটা আপনাদের মিডিয়া থেকে তৈরি করা হয়েছে। আমার দলে জুনিয়ারদের সঙ্গে সিনিয়ররা যেভাবে মিশে, এখানে বিতর্কের বিষয়টা তো আসাই উচিত না। সিন্ডিকেটের কথাও এসেছে। ভেতরে কি হচ্ছে সেটা খেলোয়াড় জানে, আমরা কি সাফার করে আসছি সেটা আমরা জানি। দীর্ঘদিন আমরা সবাই একসঙ্গে। এখন আপনি চাইলেই তো আর একটা বক্তব্য দিয়ে দিতে পারেন না। কারণ এটা হচ্ছে বাংলাদেশ। এখানে ইতিবাচক বিষয়ের চেয়ে নেতিবাচক বিষয় দ্রুত ছড়ায়। এখানে যদি এমন একটা মন্তব্য ছড়ানো হয়, তাহলে এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক। আপনারাই জুনিয়র খেলোয়াড়দের এ নিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আমাদের খেলোয়াড়দের মধ্যে কোনো ধরনের সমস্যা ছিল না। যারা এই কমেন্টগুলো করে খেলোয়াড়মের মেন্টালি ডাউন্ড করছে, তাদের এসব করা থেকে বিরত থাকা ভালো।

দ্য মিরর এশিয়া: কিন্তু এটাও তো ঠিক যে ২০২২ সালের সাফে আপনারা যেমন খেলেছেন, শেষ কয়েক মাস আপনারা সেভাবে খেলতে পারছেন না। তাহলে সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে?

সাবিনা খাতুন: খুব ভালো একটি পয়েন্টে এসেছেন। এই যে সিনিয়র-জুনিয়র বিতর্ক ছড়ানো হচ্ছে, এসব না করে আমার মনে হয় আমাদের মেয়েরা দুই বছর আগের মতো কেন পারফর্ম করতে পারছে না, এটা ভাবা উচিত। মেয়েরা কেন এতো ডিমোটিভেটেট হয়ে গেছে, এটা ভাবা উচিত। সেই সঙ্গে এর জন্য তাদের ফাইট করা উচিত। এটার জন্য ফাইট করা উচিত না যে মেয়েরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা টিকটকে অ্যাকটিভ। শুধু বাংলাদেশের মেয়েরা না, এখন সারা দুনিয়ার মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অ্যাকটিভ। আর ক্যাম্পে আমাদের মেয়েরা সারাদিন কঠোর অনুশীলনে থাকে, তাতে তাদেরও তো কিছু সময়ের জন্য হলেও বিনোদনের দরকার আছে। এখন মেয়েদের গড় বয়স ২১-২২। ওরা এখন একটু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটিভ হবেই।

দ্য মিরর এশিয়া: আপনি বললেন, মেয়েরা কেন ডিমোটিভেটেড হচ্ছে, এটা খুঁজে বের করা উচিত। আপনার মুখ থেকেই বিষয়টা জানতে চাই?

সাবিনা খাতুন: সবশেষ সাফে মেয়েরা যা করেছে, এরপর আপনারা কতখানি মেয়েদের জন্য করতে পেরেছেন, এই প্রশ্নটা নিজেদের করলেই সব উত্তর মিলে যাবে। আপনারা বলছেন দুই বছর আগের মতো পারফরম্যান্স নেই। কিন্তু এই সময়ে আপনারা মেয়েদের জন্য কয়টা ম্যাচ আয়োজন করতে পেরেছেন? সারা বছর ট্রেনিংয়ে থেকে যদি মেয়েরা উন্নতি করতে পারত, তাহলে বিশ্বের সেরা দল হতো বাংলাদেশ। কারণ তারা সারা বছর ট্রেনিংয়ে থাকে। কিন্তু সারা বছর ট্রেনিং থেকে ম্যাচ খেলার সুযোগ না পেলে উন্নতি কীভাবে দেখতে পাবেন? মেয়েদের যখন যথেস্ট সুযোগ-সুবিধা দিতে পারবেন, তখন খারাপ করলে মেয়েদের নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার সবার থাকবে। কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা না নিয়ে উন্নতির প্রশ্নগুলো তোলা উচিত না। আর যেউ যদি বলে মেয়েরা খেলার মধ্যে নেই, তহালে সেটার প্রমাণ মেয়েরা ভারত ম্যাচেই দিয়ে দিয়েছে।

দ্য মিরর এশিয়া: আরেকটি প্রশ্ন না করেই পারছি না। আলোচনা আছে আপনারা সিনিয়র খেলোয়াড়রা বিভিন্ন বিষয়ে সাবেক কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। একটু আগে আপনি নিজেও বললেন ভারত ম্যাচের আগে তার সঙ্গে কথা বলেছেন। তাহলে বর্তমান কোচ কি আপনাদের যথেষ্ট মোটিভেটেড করতে পারছে না?

সাবিনা খাতুন: দেখুন এটা মোটিভেটের ব্যাপার না। উনি (পিটার বাটলার) আসলে খুব অল্প সময় ধরে কাজ করছেন। প্রত্যেকটা কোচের ফিলোসফি হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন। তবে আমি ১৪ বছরের সম্পর্কের সঙ্গে ৬ মাসের সম্পর্ক কখনোই এক করতে চাই না। ছোটন স্যারের সঙ্গে দীর্ঘ ১৪ বছর আমি কাজ করেছি। আমার কাছে মনে হয় আমি নিজেকে যতটা না চিনি, তার চেয়েও তিনি (ছোটন) আমাকে বেশি চেনন। তাই তার কাছে বিভিন্ন বিষয়ে সরণাপন্ন হতেই পারি। এটা গুরু-শিষ্যের ব্যপার। আর বর্তমান কোচের প্রতিও আমার যথেষ্ট সম্মান আছে। এনিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।