‘দেখেন তো নিউজটা ফেসবুকে দিছে কি না’

আমীন আল রশীদ।

ট্রেনে সিলেট যাচ্ছি। সামনের সিটে দুজন যাত্রী কোনো একটা ঘটনা নিয়ে কথা বলছেন। একজন বললেন, ‘দেখেন তো নিউজটা ফেসবুকে দিছে কি না’…।

এই ধরনের আলাপচারিতা এখন জনপরিসরে খুব অস্বাভাবিক নয়। ফেসবুকের মতো একটি সোশ্যাল মিডিয়া কী করে নিউজের সোর্স বা সংবাদমাধ্যম অথবা সংবাদমাধ্যমের বিকল্প হয়ে উঠলো—সেটি বিরাট তর্কের বিষয়। কিন্তু অস্বীকার করার সুযোগ নেই, সোশ্যাল মিডিয়াই এখন গণমাধ্যমের প্রধান প্রতিপক্ষ। ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী।

গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া উভয়ই তথ্য প্রদান ও জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু তাদের কার্যপ্রণালী, নীতিমালা ও প্রভাবের দিক দিয়ে বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। যার ফলে অনেক সময় তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। বিশেষত ব্যবসায়িক কারণে। অর্থাৎ ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের কারণে প্রান্তিক ও স্বল্প আয়ের মানুষেরাও এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় বলে মূলধারার গণমাধ্যম যেমন টেলিভিশন দেখার প্রতি তাদের আগ্রহ কমেছে। তারা তথ্য ও বিনোদনের সবকিছু এখন হাতের মুঠোয় পাচ্ছে। অতএব ভোক্তা যেখানে বেশি, পণ্য সেখানেই যাবে। আর যেখানে পণ্য সেখানেই বিজ্ঞাপন। যে কারণে মূলধারার গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপনের বিরাট অংশই চলে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সোশ্যাল মিডিয়া মূলধারার গণমাধ্যমের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিপক্ষ না হলেও সে এখন গণমাধ্যমের ব্যবসায় যেহেতু ভাগ বসাচ্ছে এবং কখনো তার বিজ্ঞাপনের অংশ গণমাধ্যমের চেয়েও বেশি হয়ে যাচ্ছে—অতএব এই ব্যবসায়িক কারণে মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা দ্বান্দ্বিক অবস্থা তৈরি হয়ে গেছে।

ঐতিহ্যবাহী গণমাধ্যম, যেমন সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সম্পাদকীয় নীতি অনুসরণ এবং যাচাই-বাছাই করতে হয়। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যাচাই করার সুযোগ কম থাকে বলে ভুয়া খবর ও অপপ্রচার ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। যার ফলে এখন গণমাধ্যমকে শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই টিকে থাকতে হচ্ছে না, বরং তাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ও ছড়িয়ে দেয়া অপতথ্য ও বিভ্রান্তির বিরুদ্ধেও সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের দায়িত্বও নিতে হয়—যা বিরাট চ্যালেঞ্জ এবং সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য গণমাধ্যমের যে আর্থিক সঙ্গতি প্রয়োজন—সেখানেই ভাগ বসিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া।

টিআরপির শাঁখের করাত

টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন রেট নির্ধারিত হয় টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট বা টিআরপির ওপর। যে পদ্ধতিতে এই টিআরপি নির্ধারণ করা হয়, সেটি নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু তারপরও কোন টেলিভিশনের দর্শকপ্রিয়তা কেমন, সেটি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য বাংলাদেশে যেহেতু আর কোনো উত্তম বিকল্প এখনও চালু করা যায়নি, ফলে বিজ্ঞাপনদাতারা এই বিতর্কিত এবং অর্ধসত্য তথ্যের ওপরেই নির্ভর করেন।

দীর্ঘদিন টিআরপি বন্ধ ছিল। কিন্তু হালে সেটি নতুন করে চালু হয়েছে। এ মুহূর্তে রাজধানী ঢাকাসহ ৮টি বিভাগে ৫০০ মিটার আছে—যেখানে ১৭৫০ জন দর্শক আছেন বলে একটা আনুমানিক হিসাব করা হয়। অর্থাৎ এই ৫০০ মিটার এবং ১৭৫০ জন দর্শকের রুচি, আগ্রহ, পছন্দ দিয়ে ১৭ কোটি লোকের দেশের টেলিভিশনের দর্শকপ্রিয়তা যাচাই করা হয়। এত কম সংখ্যক লোক দিয়ে এত বিরাট জনগোষ্ঠীর রুচি ও আগ্রহ যাচাই কতটা বিজ্ঞানভিত্তিক ও যৌক্তিক—সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরও এটিই এখন একমাত্র মানদণ্ড। তাছাড়া কোন ৫০০ বাসায়, অফিসে বা দোকানে মিটারগুলো আছে; সেখানে যারা টিভি দেখেন তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এবং তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কী; তাদের গড়পড়তা রুচি ও সাংস্কৃতিক মান কেমন—সেটিও বিরাট প্রশ্ন। কিন্তু তারপরও এটিকেই আমলে নেন বিজ্ঞাপনদাতারা।

প্রতি সপ্তাহে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কাছে টিআরপির যে হিসাব পাঠানো হয়, সেখানে এমন সব তথ্য উঠে আসে, যা দেখে অনেকেরই চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে। যে টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদ ও অনুষ্ঠানের মান নিয়ে সাধারণভাবেই নানা প্রশ্ন আছে, সেরকম টেলিভিশন চ্যানেলও দেখা যায় যে তুলনামূলকভাবে মানসম্পন্ন টিভির চেয়ে এগিয়ে আছে। যেসব টেলিভিশন দিনের একটি বড় সময় বাংলা সিনেমা দেখায়, সেগুলো টিআরপিতে এগিয়ে থাকে। তার মানে যেসব জায়গায় টিআরপি নির্ধারণী মিটারগুলো দেয়া হয়েছে, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ টেলিভিশনে সিনেমা দেখেন? সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের দর্শকদের রুচি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মানে কি এটা বিশ্বাসযোগ্য যে, দেশের অধিকাংশ মানুষ টেলিভিশনে সারাক্ষণ বা বিরাট সময় শাকিব খান-ডিপজলের (প্রতীকী অর্থে) সিনেমা দেখেন? এই তর্কের সুরাহা করা কঠিন।

সোশ্যাল মিডিয়া দিয়ে কি টেলিভিশনের জনপ্রিয়তা যাচাই করা সম্ভব?

টেলিভিশনের দর্শকপ্রিয়তা যাচাইয়ের আরেকটি মাধ্যম হলো টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ফেসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেল। কিন্তু এখানে মূল তর্কটা হলো, যারা বাসায় বসে টেলিভিশন সেটে অনুষ্ঠান দেখেন তাদের বিরাট অংশই সোশ্যাল মিডিয়ায় টিভি দেখেন না। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষেরা। অন্যদিকে যারা মোবাইল ফোনে টিভি দেখেন, তাদের বিরাট অংশ বাসায় বসে টেলিভিশন সেটে টিভির অনুষ্ঠান দেখেন না। বিশেষ করে তরুণরা। সুতরাং টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলগুলোয় কোন কনটেন্ট কী পরিমাণ ভিউ হলো বা দর্শক দেখলো—সেটি দিয়েও সামগ্রিকভাবে টেলিভিশনের দর্শকপ্রিয়তা যাচাই করা কঠিন। কেননা সোশ্যাল মিডিয়ায় চটকদার শিরোনাম, চাঞ্চল্যকর খবর, বিভ্রান্তিকর ও অর্ধসত্য সংবাদ, রাজনৈতিক বিষোদ্গার, বিনোদন জগতের কন্ট্রোভার্সি ইত্যাদি কনটেন্টের ভিউ বেশি। এইসব কনটেন্ট কারা বেশি দেখেন? তারা কি ১৭ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন?

অর্থাৎ যে দুই উপায়ে টেলিভিশনের দর্শকপ্রিয়তা যাচাই করা হয়, তার দুটি পদ্ধতি নিয়েই হাজারো প্রশ্ন আছে। কিন্তু সেইসব প্রশ্ন ছাপিয়ে এখন যে বাস্তবতাটি স্বীকার করে নিতে হচ্ছে তা হলো, টেলিভিশনের জন্য বরাদ্দ বিজ্ঞাপনের একটি বিরাট অংশই এখন চলে যাচ্ছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলে। ফলে যেসব টেলিভিশন যত বেশি ভাইরাল হওয়ার মতো কনটেন্ট দিচ্ছে, তাদের আয় তত বেশি। আর এই বাড়তি আয়ের নেশায় অনেক টেলিভিশন চ্যানেল সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতাও যে কখনো সখনো বিসর্জন দিচ্ছে—সেটিও নির্মম সত্য। আর এ কারণে এখন ‘ভাইরাল জার্নালিজম’ বলেও একটা টার্ম চালু হয়ে গেছে।

দায়িত্বশীল সংবাদমাধ্যম হিসেবে পরিচিত টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ঢাকা অফিসে কর্মরত রিপোর্টার তো বটেই, ঢাকার বাইরের প্রতিনিধিদের ওপরও এখন ‘ভাইরাল নিউজ’ করার ব্যাপারে চাপ দেয়া হয়। কিন্তু একজন রিপোর্টারের পক্ষে মাসে কয়টি ভাইরাল হওয়ার মতো বা মিলিয়ন ভিউ হবে এমন সংবাদ তৈরি করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয় তাহলে তিনি কী করবেন? বাধ্য হয়ে তিনি তখন ছোট খাটো ঘটনাকেও রঙচঙ মাখিয়ে; চটকদার শিরোনাম দিয়ে; সত্যের সঙ্গে কিছু অর্ধসত্য ও ধারণা মিশিয়ে এমনভাবে সংবাদ তৈরি করেন, যা আর সংবাদ থাকে না। হয়ে যায় সংবাদ ও গল্পের মাঝামাঝি একটা অদ্ভুত ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট।

বাংলাদেশের গণমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যে এরকম একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেলো, তার জন্য প্রধানত দায়ী গণমাধ্যমের পেশাদারির সংকট এবং ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের সহজলভ্যতার কারণে দ্রুততম সময়ে বিকশিত সোশ্যাল মিডিয়া।

সোশ্যাল মিডিয়া যেভাবে চাপ তৈরি করে

সোশ্যাল মিডিয়া এখন আর মানুষের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ নেই। সে এখন সংবাদেরও বিরাট উৎস। কখনো সখনো সে সংবাদমাধ্যমের বিকল্প। কেননা সংবাদপত্র বা টেলিভিশন যে সংবাদটি গোপন করেছে কিংবা আরেকটু সময় নিয়ে নিশ্চিত হয়ে প্রকাশ ও প্রচার করতে চেয়েছিল—সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্য কোনো ব্যক্তি হয়তো সেই তথ্যটি তথ্য হয়ে ওঠার আগেই অর্ধতথ্য এবং অর্ধসত্য থাকা অবস্থাতেই প্রকাশ করে দিয়েছেন এবং তারপর ওই অর্ধসত্য তথ্যটি নিয়েই দেশ গরম হয়ে যায়। যখন কোনো একটি অর্ধসত্য তথ্য নিয়েও সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় শুরু হয়ে যায়, তখন মূলধারার সংবাদমাধ্যমের ওপর বিরাট চাপ তৈরি হয়। সাধারণ মানুষের মনে তখন এই বিশ্বাস বা ধারণা তৈরি হয়, সংবাদমাধ্যম হয়তো ঘটনাটি আড়াল করছে। তখন সংবাদমাধ্যমের ওপর দায়িত্ব হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত ওই তথ্যটি আদৌ সত্য কি না বা কতটুকু সত্য—সেটি যাচাই করা। আবার কখনো অনেক তথ্য গণমাধ্যমের আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় চলে আসে। অনেক চাঞ্চল্যকর ছবি বা ভিডিও অথবা অডিও রেকর্ড বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দিলে গণমাধ্যম নতুন করে চাপে পড়ে।

গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় তার রাজনৈতিক বিশ্বাস, নিয়ন্ত্রণ (সেন্সরশিপ) ও স্বনিয়ন্ত্রণ (সেলফ সেন্সরশিপ), ভীতি, ব্যবসায়িক তথা করপোরেট স্বার্থ, ধর্মীয় ইস্যুতে তার সংবেদনশীলতা ও সতর্কতার কারণে অনেক তথ্য হয় গোপন করে কিংবা সেই তথ্যটি প্রকাশ ও প্রচারের ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি কিংবা অন্য গণমাধ্যম কী করছে সেটি দেখার জন্য অপেক্ষা করে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ওই তথ্যটি হয়তো পুরোপুরি না হলেও আংশিক প্রকাশিত হয়ে যায়। তাতে করে গণমাধ্যমের ওপর মানুষের আস্থা কমে যায়। তখন তার ভরসা বাড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কেননা মানুষের স্বভাবজাত ধর্মই হলো সে যা বিশ্বাস করে, টেলিভিশনের পর্দায় সেটি দেখতে চায়। কিন্তু যখন সে এটি দেখতে ব্যর্থ হয়, তখন তার নির্ভরতা বাড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিন্তু ‘দেখেন তো নিউজটা ফেসবুকে দিছে কি না’ জাতীয় সংবাদ অনেক সময়ই ভুয়া, মিথ্যা, প্রোপাগান্ডা হিসেবেও প্রমাণিত হয়।

সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের নির্ভরতা এতটাই বেড়েছে যে, সে এখন এই প্লাটফর্মে যা কিছু দেখে, সবই বিশ্বাস করতে চায়। একজন রাজনৈতিক নেতা ২০ মিনিটের বক্তৃতায় অনেক কিছুই বলেন। কিন্তু ওই পুরো বক্তব্যের ভেতর থেকে বিশেষ কিছু বাক্য ও শব্দ কেটে জোড়া দিয়ে এমন সব বিভ্রান্তিকর ভিডিও বানিয়েও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেয়া হয়, যা আদৌ ওই ব্যক্তিটি বলেননি বা যেভাবে বলেছেন তা ওই ভিডিও দেখে বোঝার উপায় নেই। এটি সম্ভব হচ্ছে কারণ সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো গেটকিপার বা সম্পাদনা পরিষদ নেই। কিন্তু একজন সাংবাদিক বা একজন গণমাধ্যমকর্মী চাইলেই যা খুশি তার পত্রিকা বা টেলিভিশনে প্রকাশ ও প্রচার করে দিতে পারেন না। একটি নির্দিষ্ট পথ অতিক্রম করে তাকে আসতে হয়। সংবাদমাধ্যমকে তার সম্পাদকীয় নীতি, তার রাজনৈতিক অবস্থান, রাষ্ট্রীয়-সামাজিক ও ধর্মীয় ইস্যুতে তার নিরপেক্ষতা ও সংবেদনশীলতা বিবেচনায় রাখতে হয়। যে বিবেচনাবোধটি সোশ্যাল মিডিয়ায় অনুপস্থিত। অর্থাৎ সংবাদমাধ্যমকে পেশাদারির বিষয়ে সতর্ক থাকতে হলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই সতর্কতা অনুপস্থিত। এমনকি সংবাদমাধ্যমের সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মেও সেই পেশাদারির ঘাটতি লক্ষ্যণীয়। অর্থাৎ মূলধারার গণমাধ্যমকে এখন এমন একটি প্লাটফর্মের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে, যে লড়াইটা কার্যত অসম।

নতুন মডেল অনুসন্ধান জরুরি?

গণমাধ্যম এখন আর সোশ্যাল মিডিয়াকে বাদ দিয়ে নিজের মতো করে চলতে পারবে না। চলতে পারবে কিন্তু ব্যবসায়িকভাবে সে টিকবে না। আবার সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে ঝগড়া করেও সে বেশি দূর যেতে পারবে না। তার মানে একটা মিথস্ক্রিয়া লাগবে। গণমাধ্যমের সংবাদ ও অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় নতুনত্ব লাগবে। একদিকে পেশাদারি বজায় রাখা, অন্যদিকে ব্যবসা সফল হওয়া। একটা গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠান যত ভালো কনটেন্টই তৈরি করুক না কেন, সেটি যদি দর্শক না খায় (না দেখে) তাহলে ওই ভালো অনুষ্ঠান নিরর্থক।

মুশকিল হচ্ছে, ওই ভালো অনুষ্ঠানটি কতজন লোক দেখছে সেটি জানার যে তরিকা, যে টিআরপি—সেটি বরাবরই একটি বিতর্কের জায়গা। মাত্র ৫০০ মিটার আর ১৭৫০ জন দর্শকের সিদ্ধান্তের ওপর ১৭ কোটি মানুষের দেশের টেলিভিশন দর্শকের আগ্রহ ও রুচি নির্ধারণ করাটাই অযৌক্তিক। আবার গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানগুলোর সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে কোন কনটেন্ট কত লাখ বা কত মিলিয়ন ভিউ হলো—সেটি দিয়েও যে সামগ্রিক চিত্র বোঝা যায়, ব্যাপারটা এমনও নয়। এটি একটি শাঁখের করাত।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এই শাঁখের করাতের মধ্যে থাকতে হবে আরও অনেক দিন—যতদিন পর্যন্ত না টেলিভিশনের দর্শকপ্রিয়তা যাচাইয়ের জন্য সত্যিই একটি কার্যকর, বিশ্বাসযোগ্য এবং সর্বজনগ্রাহ্য পদ্ধতি চালু হচ্ছে।

বাস্তবতা হলো মানুষ এখন দ্রুত এবং সংক্ষেপে অনেক কিছু জানতে চায়। ছবি ও ভিডিও চায়। যে কারণে শর্ট ভিডিওর চাহিদা এখন সবচেয়ে বেশি। যে কারণে গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারকদের এখন প্রতিনিয়তই টেলিভিশনের কনটেন্ট নিয়ে ভাবতে হচ্ছে, যেখানে কয়েকটি প্রশ্ন সামনে আসছে:

১. সংবাদের ভাষা ও বিশ্লেষণে কি পরিবর্তন আনতে হবে?

২. মানুষ যা চায়, সেই ধরনের কনটেন্ট দিতে হবে? মানুষ বলতে এখানে কোন শ্রেণির দর্শককে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিবেচনায় নেবে?

৩. টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কি ইউটিউব ও ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কনটেন্ট বানাবে? সেটি কি গণমাধ্যমের কাজ?

৪. যদি সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্র বা অনলাইন পোর্টালগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে যায়, তাহলে সে আর্থিক সংকটে পড়বে কি না?

৫. সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে গণমাধ্যম তার দর্শন, নীতিনৈতিকতা ও আদর্শিক জায়গা থেকে বিচ্যুত হয়ে গেলে দীর্ঘমেয়াদে তার প্রভাব কী হবে?

৬. সোশ্যাল মিডিয়ার চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য মাথায় রেখে যদি গণমাধ্যমকে তার সংবাদ, বিশ্লেষণ ও অন্যান্য কনটেন্ট তৈরি করতে হয়, তাহলে সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে তার পার্থক্য থাকবে কোথায়?

অতএব এরকম একটি কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে গণমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কী করে টিকে থাকবে, সেটি বিরাট প্রশ্ন এবং এই টিকে থাকার মন্ত্র আবিষ্কার করাই এখন গণমাধ্যমকর্মীদের প্রধান কাজ।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও গবেষক।