বাংলাদেশের কারখানার পানিতে বিষাক্ত রাসায়নিক ‘পিফাস’: গবেষণা
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর আশপাশের জলাশয়ে প্রতিনিয়ত মিশছে বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ। নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা ও এর আশেপাশের পোশাক শিল্প, নদ-নদী ও খাবার পানিতে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ পিফাসের (পার-পলিফ্লুরোঅ্যালকিল) উপস্থিতি পাওয়া গেছে যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি।
তৈরি পোশাক কারখানার যেসব এলাকায় সেখানকার নদী, লেক এবং ট্যাপের পানি পরীক্ষা করে এসব কথা জানিয়েছে এনজিও বিষয়ক নেটওয়ার্ক আইপেন, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো)। তারাই প্রথম এ ধরনের গবেষণা করেছে। এসডো এবং আইপেন যৌথভাবে গবেষণাটি পরিচালনা করেছে। গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর লালমাটিয়ায় এসডো কার্যালয়ে এই গবেষণাটি উপস্থাপন করা হয়।
এ গবেষণার জন্য সংস্থাটি রাজধানী ঢাকায় বস্ত্রশিল্প বিষয়ক কারখানাগুলোর কাছাকাছি বিভিন্ন উৎস থেকে পানির ২৭ রকম নমুনা সংগ্রহ করে। তারপর পরীক্ষা করে তাতে উদ্বেগজনকভাবে ‘পার-অ্যান্ড পলিফ্লোরোঅ্যালকাইল সাবসট্যান্সেস’ (ডিএফএএস) পাওয়া যায়। এই রাসায়নিক পদার্থ ‘ফরএভার কেমিক্যাল’ বা কখনো নষ্ট হয় না এমন রাসায়নিক পদার্থ হিসেবে পরিচিত।
লন্ডন ভিত্তিক পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান এক রিপোর্টে জানায়, ওইসব নমুনা সংগ্রহ করা হয় ২০১৯ এবং ২০২২ সালে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, পোশাক কারখানার আশপাশ এলাকার পানির নমুনায় উচ্চমাত্রার ক্ষতিকর পিফাস নামক রাসায়নিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। অনেক নমুনায় পিফাসের পরিমাণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং নেদারল্যান্ডসের নির্ধারিত মাত্রার ওপরে। বাংলাদেশে পিফাস নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। যে কারণে এই গবেষণার ফলাফল ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নেদারল্যান্ডস এবং যুক্তরাষ্ট্রের মানদণ্ডের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
এসডো জানিয়েছে, অনেক নমুনায় পিফাসের পরিমাণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং নেদারল্যান্ডসের নির্ধারিত মাত্রার অনেক উপরে ছিল। এর মধ্যে কিছু নমুনায় নিষিদ্ধ পিফাসের উপস্থিতিও পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের প্রভাব থেকে সুরক্ষিত রাখতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের প্রয়োজন। জনগণের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ সুরক্ষার জন্য পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত নিয়ন্ত্রণ সংস্থাসমূহকে পিফাস দূষণ নির্মূল ও হ্রাসের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
পিফাস কী?
পিফাস বা পার-পলিফ্লুরোঅ্যালকিল হল মানুষের তৈরি এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ যা এর স্থায়িত্ব এবং পানি, তেল, ও তাপ প্রতিরোধের জন্য পরিচিত। সুনির্দিষ্ট ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রকম মারাত্মক অসুস্থতার সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে।
শিল্প উৎপাদনে এবং নিত্যদিনের ভোক্তাপণ্যের সঙ্গে সেই ১৯৫০-এর দশক থেকে পিফাস ব্যবহার করা হচ্ছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, এগুলোকে ‘ফরএভার কেমিক্যাল’ বলার কারণ হলো- বিজ্ঞানীরা বলেন, এসব রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের পর ফেলে দেয়া হয়। তারপর তা নষ্ট হতে কয়েক শত বছর লাগে। এমনও আছে হাজার হাজার বছরেও তা নষ্ট হয় না। যদি পানিতে এই পিএফএএস ছাড়া হয়, তাহলে তা ওই পানিতে শতাব্দীর পর শতাব্দী অক্ষত অবস্থায় থাকতে পারে।
বৈশ্বিকভাবে যে পরিমাণ পিফাস ব্যবহার করা হয় তার শতকরা ৫০ ভাগ ব্যবহার হয় বস্ত্রশিল্পে।
বাংলাদেশে এসডো’র নির্বাহী পরিচালক সিদ্দিকা সুলতানা বলেন, আন্তর্জাতিক বস্ত্র উৎপাদনের প্রাণকেন্দ্র হলো বাংলাদেশ। এ খাত থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক যেসব পদার্থ নির্গত হচ্ছে তা আমাদের বাসিন্দাদের উচ্চ ঝুঁকিতে ফেলছে। পিফাস ব্যবহার করে আমাদের নদী, লেক ও ট্যাপগুলোকে দূষিত করে দেয়ার জন্য ফ্যাশন রফতানিকারক শিল্পকে ফ্রি পাস দেয়া উচিত নয়।
উল্লেখ্য, স্টকহোম কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী বাংলাদেশ। এই কনভেনশনের অধীনে বৈশ্বিকভাবে সুনির্দিষ্ট পিফাস নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্গানিক দূষণের ক্ষতি থেকে মানব স্বাস্থ্য ও পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখার জন্য করা হয়েছে বৈশ্বিক চুক্তি।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি
পিফাস পরিবেশে সহজে ভাঙে না এবং প্রাণীর শরীরে স্থায়ীভাবে জমা হতে পারে, এর ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। পিফাসের বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে, যার মধ্যে প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, ভ্রূণের বৃদ্ধি এবং থাইরয়েড হরমোন কার্যকারিতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দীর্ঘমেয়াদী পিফাসের সংস্পর্শে থাকার ফলে উচ্চ রক্তচাপ, ভারসাম্যহীনতা, কম ওজনে জন্ম এবং টিকার কার্যকারিতার ওপর প্রভাব ফেলে। এছাড়া, পিফাস লিভারের ক্ষতি করে ও বিভিন্ন ক্যান্সারজনিত রোগ সৃষ্টি করে।
যা পাওয়া ফেল গবেষণায়
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, যে ২৭টি নমুনায় পিফাস পাওয়া গেছে, তার মধ্যে শতকরা ৬৭ ভাগ বৈশ্বিকভাবে নিষিদ্ধ। যেসব নমুনা বস্ত্র বিষয়ক কারখানার কাছাকাছি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, তাতে এর মাত্রা উচ্চ। এতে এমনটা মনে করা যেতে পারে যে, এই শিল্প পানি দূষণের বড় একটি উৎস।
২০২২ সালে বড় কারখানাগুলোর ভাটি থেকে দুটি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এরপর উজান থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তাতে দেখা যায়, উজানের চেয়ে ভাটির পানিতে পিফাস-এর মাত্রা অনেক বেশি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন প্রস্তাবিত লিমিটের চেয়ে কমপক্ষে ৩০০ গুণ বেশি পিফাস পাওয়া গেছে একটি নদীর পানিতে। দুটি নিষিদ্ধ পিফাস-এর সর্বোচ্চ মাত্রা পাওয়া গেছে এতে।
পারফ্লোরোঅকটানোইক এসিডের যে মাত্রা ডাচ্ এডভাইসরি লিমিট অনুমোদন করেছে তার চেয়ে এই মাত্রা কমপক্ষে ১৭০০ গুণ বেশি। অন্যদিকে পারফ্লোরোঅকটেন সালফোনেটের নির্দিষ্ট সীমার চেয়ে তা কমপক্ষে ৫৪ হাজার গুণ বেশি।
করণীয় কী?
গবেষণার শীর্ষ লেখক শাহরিয়ার হোসেন বলেন, বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি ছোট্ট দেশ বাংলাদেশ। সেচ, কৃষি, শিল্প উন্নয়ন ও পানীয় পানির বড় উৎস হলো জলাধারগুলো। আমরা দেখতে পেয়েছি পানিতে উচ্চ মাত্রায় বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশে আছে। এটা একটা বড় সমস্যা। এর সমাধান প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, যদি স্টকহোম কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী হয়ে থাকে বাংলাদেশ তাহলে পিফাসের মাত্রা নির্ধারণে তার বাধ্যবাধকতা আছে।
পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থার (এসডো) নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা বলেন, আন্তর্জাতিক পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ অন্যতম। কিন্তু এই খাত থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক নির্গমন জনগণকে উচ্চ ঝুঁকিতে ফেলছে। আমাদের নদী-নালা ও কলের পানিতে পিফাস দূষণ ঘটছে। এ কারণে রফতানি শিল্প কারখানাগুলোকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। তাদের বাজার বিশ্বব্যাপী হতে পারে, কিন্তু দূষণ স্থানীয় পর্যায়ে বেশি হচ্ছে। স্টকহোম কনভেনশনের সদস্য হিসেবে, বাংলাদেশকে পিফাস নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক মান বাস্তবায়ন করা জরুরি।