মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ‘প্রবর্তনা’
উবিনীগ একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। উন্নয়ন বিকল্পের নীতি-নির্ধারণী গবেষণা সংক্ষেপে বলা হয় উবিনীগ। আশির দশকের শেষপ্রান্তে এসে দেশে তাঁতশিল্পের দুরাবস্থা খতিয়ে দেখার জন্য উবিনীগ সরেজমিনে একটি গবেষণা চালায়। এরই অংশ হিসেবে টাঙ্গাইলে গিয়ে তাঁতিদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। চিহ্নিত করেন তাদের সমস্যা। সেই সময় তাঁতিরা তাদের প্রধান সমস্যা হিসেবে প্রচার-প্রচারণার অভাব এবং তাদের পণ্য বাজারজাত করার অসুবিধাকে দায়ী করেন। তারা উবিনীগের কাছে ‘মার্কেটিং’-এর জন্য সাহায্য চান।
সেসময় তাঁতশিল্পের হারিয়ে যাওয়া গৌরব ও তাঁতিদের কর্মসংস্থান উদ্ধার করার লক্ষ্যে ফরহাদ মজহার ও তার সহকর্মীরা গড়ে তুলেছিলেন ‘তাঁত প্রবর্তনা সমিতি’। যা পরবর্তীকালে শুধু ‘প্রবর্তনা’ নামে দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। বেগম রোকেয়া দিবসকে সামনে রেখে ১৯৮৯ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকার শ্যামলীতে ছোট আকারে প্রথম শোরুম উদ্বোধন করা হয়। সম্পর্ক রচনা করা হয় তাঁতি এবং তাঁত পণ্যের ক্রেতাদের সাথে। আর এই ৩৫ বছরের দীর্ঘ পথ চলায় অনেক কিছু বদলে গেলেও প্রবর্তনা তার অঙ্গীকার থেকে বিন্দুমাত্র সরে আসেনি। দেশীয় ঐতিহ্য ও তাঁতশিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য ক্লান্তিহীন কাজ করে যাচ্ছেন। দেখা যায়, ঢাকার শিক্ষিত রুচিশীল মধ্যবিত্তের দেশীয় শাড়ির জোগানদাতায় প্রবর্তনার ভূমিকা অদ্বিতীয়।
প্রথম দিকে প্রবর্তনা টাঙ্গাইলের পাথরাইলের তাঁতিদের কাছ থেকে তাঁত শাড়ি নিয়ে আসতেন। বুটি শাড়ি, জ্যাকার্ড শাড়ি, হাফ সিল্ক শাড়ি, সিল্ক শাড়ি, সফট শাড়ি। টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পীরা এই শাড়িগুলো বেশি করে থাকে। টাঙ্গাইলের নকশী বুটি শাড়ি এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। দেশীয় এই শাড়ি অন্য আর কোথাও পাওয়া যায় না। তাঁতিরা চোখের সামনে যা দেখেন তাই নিয়ে তাঁতের শাড়িতে মনের মাধুরী মিশিয়ে নকশা বুনতে থাকেন। এই বুটির সুন্দর সুন্দর নামও আছে। কৃষকরা যেমন ধানের নাম রাখেন তেমনি তাঁতিরাও নকশী বুটির নাম রাখেন। কাঁকড়া বুটি, লতাপাতা পদ্ম বুটি, আঁচল পাতা বুটি, জোড়া তীর বুটি, কল্কা মাছি বুটি, জ্যামেতিক বুটি, আমপাতা কল্কা বুটি, বেলিফুল পাতা বুটি, শাপলা পদ্ম বুটি, নতুন কুঁড়ি পদ্মপাতা বুটি—এসবই তাদের বাড়ির চারপাশ থেকে নেয়া। একটি শাড়ির সারা গায়ের জমিনে একটি বুটি ব্যবহার করা হয়। শুধু আঁচলে বড় করে একটু ভিন্ন নকশা দেওয়া হয়।
এই নকশা করা একটি শাড়ির কাজ শেষ করতে একজন তাঁতশিল্পীর প্রায় ৭-৮ দিন লাগে। এর সাথে জড়িয়ে আছে তাদের আবেগ, বংশপরম্পরার ঐতিহ্য। অথচ মেশিনে একদিনে এমন শাড়ি করা যায় কয়েকটি। কিন্তু তাতে প্রাণ থাকে না, থাকে না হাতের স্পর্শ, কোমলতা। যারা নিয়মিত শাড়ি পরেন তারা ভালো করে জানেন, হাতে বোনা তাঁতের শাড়ি ও মেশিনে বোনা তাঁতের শাড়ির পার্থক্য। তাইতো নারীদের কাছে তাঁতশিল্পীর হাতে বোনা শাড়ির কদর অনেক বেশি।
শাড়ি ছাড়াও প্রবর্তনায় আছে নিজস্ব কারখানায় তৈরি বুটি গজ কাপড়, ন্যাচারাল ডাইং গজ কাপড়, ন্যাচারাল ডাইংয়ের ওড়না, বুটি ওড়না, ২০% জুট কটন ও ৮০% কটন মিলে মিক্সড কটন, নকশী ম্যাট, নকশী রানার, নকশী কাঁথা, শীতলপাটি, প্রাকৃতিক হোমমেড সাবান, ধুন্দুলের জালি, কাপড়ের মাস্ক, নোট বুক, শাল, পাঞ্জাবী, ফতুয়া, কোটি ওয়ানপিস,সেলাই ছাড়া থ্রিপিস, কাপড়ের ব্যাগ, হাতপাখা প্রভৃতি দেশের নানা স্থানের ঐতিহ্যবাহী জিনিসপত্র পাওয়া যায়। প্রবর্তনার এইসব জিনিসপত্র ক্রেতাদের কাছে বিপুল জনপ্রিয় সামগ্রী। প্রতি ঈদে প্রবর্তনার পাঞ্জাবী কেনাটা অনেকেই রেওয়াজ হিসেবে পালন করেন। প্রবর্তনার গজ কাপড় থেকে পছন্দ করে নিজের চাহিদামতো ডিজাইনে পাঞ্জাবী কাস্টমাইজ করে নেওয়ারও সুবিধা আছে ।
প্রবর্তনায় তাঁতের শাড়ি দিয়ে যাত্রা হলেও ক্রমান্বয়ে যোগ হয়েছে দেশীয় ঐতিহ্যবাহী অন্যান্য শাড়িও। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি, সিলেটি মণিপুরী শাড়ি আর ঢাকাই জামদানী শাড়ি। এই শাড়ির বিশেষত্ব হলো শাড়িতে প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহার করা হয়। প্রাকৃতিক রঙের উৎসের মধ্যে আছে হরিতকি, বহেরা, খয়ের, সুপারি, পেঁয়াজের খোসা, রসুনের খোসা ইত্যাদি। প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহার করে বানানো শাড়িগুলো বেশ নরম হয়। দেখতে যেমন আভিজাত্যপূর্ণ, পরতেও তেমন আরামদায়ক। গাজীপুরের কোনাবাড়িতে নিজস্ব কারখানায় বানানো ভেজিটেবল ডাই, টাই-ডাইয়ের শাড়ি। শাড়ির ধরণ যা-ই হোক, কাপড়ের কাঁচামালে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক সুতা না থাকলে তা প্রবর্তনায় ঠাঁই পায় না। সুতি হলে তা পুরোপুরি সুতি আর সিল্ক হলে তা পুরোপুরি প্রাকৃতিক রেশমের সুতা হতে হবে।
প্রবর্তনায় তাঁতের বুটি শাড়ি ৩৫০০-৫১০০ টাকা, জ্যাকার্ড শাড়ি ১০৫০-১৩৯৫ টাকা, হাফ সিল্ক ২৩০০-৩২০০ টাকা, ন্যাচারাল ভেজিটেবল ডাইয়ের শাড়ি ২৩০০-২৬০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। মণিপুরী শাড়ির ২৫৯৫-৩৩০০ টাকা আর জামদানী শাড়ি ৬০০০ টাকা থেকে ৯০০০ টাকার মধ্যে। প্রবর্তনার নিজস্ব ডিজাইনে তৈরি পাঞ্জাবী ৬৯০ টাকা থেকে ১৯৫০ টাকা পর্যন্ত দামের হয়। নিজস্ব কারখানায় তৈরি গজ প্রতি কাপড় ৩৪০ টাকা থেকে ৪৯০ টাকা।
প্রবর্তনার শুরু থেকেই লক্ষ্য ছিল তাঁতশিল্প ও দেশের অর্থনীতিতে ভোক্তাদের অবদান সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে গড়ে তোলা। প্রবর্তনার প্রতিষ্ঠাতারা বিশ্বাস করেন, ‘ক্রেতা ও ভোক্তা হিসেবে যে নাগরিক দেশে উৎপাদিত দ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধিতে সক্রিয় সহায়তা করে না, দেশের সার্বভৌমত্ব ও অর্থনীতিকে বিদেশের পদানত করার দায় দায়িত্ব সেই নাগরিকের ওপরেও বর্তায়।’ তাদের বিশ্বাস, ‘খাদ্য যেমন নিরাপদ হওয়া গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কাপড়ও নিরাপদ হওয়া দরকার। সিনথেটিক কাপড় কিন্তু নিরাপদ নয়। তাই সিনথেটিক কোনো সুতার কাপড় প্রবর্তনায় থাকে না। সুতি বা হাতে বোনা কাপড়ের কথা আসলে প্রথমেই প্রবর্তনার নাম আসবে’।
শুরুর দিকে প্রবর্তনায় ক্রেতা হিসেবে মধ্যবয়সী মানুষজন আসলেও বর্তমানে তরুণদের আগ্রহ তুলনামূলক বেশি বলে জানান সেখানকার কর্মরত আবদুল আলীম। দেশের শিক্ষিত রুচিশীল ক্রেতারা এখন অনেকটাই সচেতন।
আলীম বলেন, ‘এক ধরনের বিদেশী কাপড়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ সবসময় সমান থাকে না। কোনো একটা ডিজাইন খুব জনপ্রিয় হলেও কিছুদিন পর এর আবেদন কমে যায়। কিন্তু তাঁতের আবেদন বছরের পর বছর একইভাবে টিকে থাকে।’
প্রর্বতনার ম্যানেজার শাহনাজ পারভীনকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, তাঁতশিল্পীদের জীবন মহাজনী প্রথার মধ্যে আটকে গিয়েছিল। তাদের নিজস্ব কোনো বাজার ছিল না। তারা যেসব মহাজনদের কাছ থেকে লজিস্টিক সাপোর্ট পেতো তারাই কাপড়ের মূল্য নির্ধারণ করে নিয়ে যেতো। অন্য কারো কাছে বিক্রির স্বাধীনতা তাঁতশিল্পীদের ছিল না। তাদের মূল্য নির্ধারণ করতো মহাজন। মহাজনী প্রথা থেকে বের হওয়ার জন্যই তাঁতশিল্পীদের ন্যায্য মূল্য দিয়ে ওপেন বাজারে নিয়ে আসে প্রবর্তনা।
দেশের ঐতিহ্য আর তাঁতশিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখার অব্যাহত চেষ্টার নাম প্রবর্তনা। দেশীয় পণ্য নিয়ে উদ্যোগ যত বাড়বে ততই প্রবর্তনার শাড়ি মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। মানুষের আকুল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠুক এই প্রবর্তনা।