কোকাকোলার বিজ্ঞাপন বিপর্যয় 

বাংলায় ‌‘পয়সা উসুল’ বলে একটা কথা আছে। কোনো সিনেমা বা যাত্রা ভালো লাগলে মানুষ এ কথাটা বলে থাকে। তেমনি আছে ‘পয়সা ফেরত’ বলার প্রচলন। কোনো কিছু ব্যবহার করার পর তা খারাপ লাগলে মানুষজন মজা করে বলে যাও পয়সা ফেরত নিয়ে আসো।  বাংলাদেশে কোকাকোলা কোম্পানির উচিত তাদের সর্বসাম্প্রতিক বিজ্ঞাপন যারা বানিয়েছে তাদের কাছ থেকে পয়সা ফেরত চাওয়া। 

গণযোগাযোগের ক্ষেত্রে যা যা করা উচিত নয়, তার সবই বিজ্ঞাপনটি করেছে। এটা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণসংযোগ বিভাগের পাঠ্য হওয়ার যোগ্য। বিজ্ঞাপনটির উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার। তারা চেয়েছে, চলমান ‘কোক বয়কট’ আন্দোলন ব্যর্থ করে দিতে। মানুষকে আবার কোক পানে উদ্বুদ্ধ করতে। কিন্তু বিজ্ঞাপনটি যে এ কাজ করতে সাফল্যের সঙ্গে ব্যর্থ হয়েছে, তা কোনো সংশয় ছাড়াই বলা যায়। মজার ব্যপার হচ্ছে, বিজ্ঞাপনটি দেখলে মনে হবে এটি বরং কোক বয়কট আন্দোলনকে উৎসাহিত করার জন্য বানানো। 

পুরো বিজ্ঞাপনের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন এজন দাড়িওয়ালা দোকান মালিক, যিনি কোক বিক্রি করতে চান। কিন্তু ওনার ক্রেতারা পানীয়টি কিনতে অস্বীকার করছেন, কারণ কোক বানানো হয় ‘ওই দেশে’। ওই দেশ কোন দেশ তা আমরা নিজেরাই বিজ্ঞাপনটি থেকে বুঝে নিতে পারি। 

এদিকে দোকান মালিক এ তথ্যের উৎস সন্ধান করতে করতে খুঁজে পান এমন একজনকে যিনি ‘আকাশ-কুসুম’ নামের সামাজিক মাধ্যমের একটি পেজ থেকে এ খবর পেয়েছেন। বিজ্ঞাপনটি তীর্যকভাবে সাধারণ মানুষের খবর জানার উৎসকগুলোকে ব্যাঙ্গ করে। শুধু তা না, এটি দেখলে মনে হবে, কোক যারা বয়কট করছেন তারা সবাই বোকা।  বিজ্ঞাপনটি সবার শেষে আমাদের আহ্বান জানায় ইন্টারনেটে সার্চ করতে। কিন্তু ইন্টারনেট তো কোকের সাথে ‘ওই দেশের’ দহরম-মহরমের খবরে ভর্তি। 

এ বিশ্বায়নের যুগে ক্রেতাদের বুদ্ধিমত্তাকে প্রশ্ন করা একটা বড় ধরণের বেওকুফি। দেশের কোন এক নামজাদা বিজ্ঞাপনী সংস্হা কোকের সম্ভাব্য ক্রেতাদের কেন নির্বোধ ভাবলেন সেটা বেধগম্য নয়। কোক কোথায় বানানো হয় বা এর মালিক কারা, সেটা জনপরিসরে সবাই জানে। এটা নিয়ে লুকাছাপা করতে যাওয়াটা এক ধরনের নির্বুদ্ধিতা। 

বিজ্ঞাপনটি প্রচারে আসার পর সামাজিক মাধ্যম সমালোচনার জোয়ারে ভেসে যায়। ক্ষোভে ফেটে পড়ে মানুষজন। বিজ্ঞাপনটি পরিণত হয় সবার মজা করার একটি বিষয়ে। কোক এ বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার করেছে। এ রকম একটা কিছুর আয়ু বা হায়াত যে কম হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোকাকোলার ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে একটি কথা না বললেই নয়— এ দেশে যারা বিজ্ঞাপনী বা গণসংযোগ প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক, তারা সবাই দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের রথি-মহারথি। কিন্তু এসব আপতভাবে উদারনৈতিক চেতনার ব্যক্তিদের বানানো বিজ্ঞাপনে আমরা নারীর প্রতি অবমাননা থেকে শুরু করে বডি শেইমিংয়ের মতো জঘন্য জিনিসও দেখতে পাই। 

কালো হওয়ার কারণে চাকরি হচ্ছে না এবং একটি বিশেষ প্রসাধন মাখার পর জব ইন্টারভিউতে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে চাকরি দিয়ে দিচ্ছে— এসব আমাদের গিলতে হচ্ছে এ একবিংশ শতকে এসেও। নারী যে তার মেধায় আগে বাড়তে পারে, এটা মনে হয় এসব বিজ্ঞাপনীসংস্হার লোকজন আমাদের বিশ্বাস করতে দিতে চান না। 

বলাই বাহুল্য, কোকের বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার করা ক্রেতা-শক্তির একটা বড়সড় বহিঃপ্রকাশ। বয়কট বা সামাজিক গণমাধ্যমে সমালোচনার অস্ত্র সাধারণ মানুষ ইদানিং বেশ ব্যবহার করছেন। এটা আমাদের দম বন্ধ হওয়া জনপরিসরে যেন খোলা হাওয়ার শীতল পরশ।