লীনাস আচার : বাংলার খাদ্য সংস্কৃতি ও লোকজ সংস্কৃতি তুলে ধরা

লুৎফর নাহার লীনা তখনও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী। পড়াশুনা আর সৃজনশীল কর্মের মধ্যদিয়ে পার করছেন দিবসযামী। অধ্যায়ন অবস্থায় আয়ের উৎস হিসাবে সংবাদপত্রে বিজনেস রিপোর্টারের কাজ পেয়ে গেলেন। ব্যবসায়ীদের সাফল্য অর্জনের গল্প লেখা দিয়ে তার অভিষেক যাত্রা। তাদের গল্প লিখতে লিখতে মনের অজান্তেই বাসা বাঁধে ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন। ২০০০-২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত চারটি কোম্পানিতে চাকরির পাশাপাশি একটি উদ্যোগ নিই দেশীয় ফেব্রিক্স নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা এবং গ্রাহকদের জানানো। কিন্তু ২০১১ তে থেমে যেতে হয়। কিছুটা ছন্দপতন। আবার ২০১৩-২০১৫ তেও চাকুরী করলেন একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে। তবুও তার নিজ উদ্যোগে কিছু করার প্রয়াস ছিল অব্যাহতভাবে। তিনি বলেন, ‘শুরু করি আবার প্রতিকূলতায় থেমে যাই। কিন্তু স্বপ্ন দেখা বন্ধ হলো না। আবার উদ্যোগে উদ্যমী হই এবং উদ্যোগের প্রধান অবলম্বন হিসাবে অনলাইনকে বেছে নিই। শুধু তাই নয় আমার তৈরি দ্রব্যের স্বতন্ত্রতাও নির্ধারণ করলাম। শুরু হলো আচার তৈরি। মৌসুমী আচার তৈরি। নাম হলো ‘লীনাস আচার’। লীনাস আচারের যাত্রাকাল ২০১৬, অনলাইনে।  
 
আচার হলো কোনো কিছুকে দীর্ঘদিন সংক্ষরণ করার পন্থা বা পদ্ধতি। লীনার ৬০% আচার তৈরি হয় রোদের তাপে  প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াতে এবং আদি রেসিপিতে। আর ৪০% চুলার তাপে। ১০০% নন প্রিজারভেটিভ অর্থাৎ কেমিক্যালমুক্ত। ফল বা সবজির আচার তৈরির ক্ষেত্রে তেল বা ভিনেগারের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ল্যাকটিক, সাইট্রিক ও অ্যাসেটিক তৈরি করে। এই তিন অ্যাসিডই স্বাস্থ্যের জন্য স্বাস্থ্যকর। এই উপাদানগুলো স্বাস্থ্যের উপকারী মাইক্রোবসদের সক্রিয় ও শক্তিশালী করে তুলতে সাহায্য করে। ফলে আচার খেলে বাড়ে হজমশক্তি। সেইসঙ্গে নিয়ন্ত্রণে থাকে কোলেস্টেরলের মাত্রাও বলে মন্তব্য করেন লীনার আচারের স্বত্বাধিকারিণী।
 
আচার উৎপত্তির কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ২০৩০ সালে মেসোপোটেমিয়ানরা শসার আচার তৈরি করেছিল। ইতিহাসে পাওয়া যায়, ক্রিস্টোফার কলম্বাস আচার উৎপত্তি করেছেন। ১৪৯২ সালের আমেরিকা অভিযানে কলম্বাস তাঁর নাবিকদের এই আচার খেতে দিতেন। যাতে তারা ভিটামিন সির অভাবে স্কার্ভি রোগে অসুস্থ হয়ে না পড়েন। সেসব আচারের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আচার ছিল সবজির তৈরি। আমেরিকা-ইউরোপ আচারের কনসেপ্ট বলতে শসাকে তারা বুঝতো। শুধু শসা নয়, গাজর, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, বেগুন, টমেটো, বরবটি ইত্যাদি দৃশ্যমান প্রায় সব ধরনের সবজি দিয়েই আচার তৈরি করা যায়। প্রথম কলম্বাস ভারতীয় উপমহাদেশে আচার নিয়ে আসছেন ইতিহাসবিদরা দাবি করেন। তারপর মুঘল সময়ে আচার ছিল সমৃদ্ধ। আচার কেন? মুঘলরা খাদ্যেই ছিল বেশ সমৃদ্ধ। এরপর সুলতানী আমল থেকে বাংলাদেশে আচার প্রবেশ করে। আমিও আচার নিয়ে কাজ করছি। গবেষণা করে যাচ্ছি। দেখি বাংলাদেশকে কতটুকু দিতে পারি! বর্তমানে মার্কেটে লীনার ১০৪ ধরনের আচার পাওয়া যাবে। বাংলাদেশে লীনাস আচার-ই জনপ্রিয়। আমার প্রতিষ্ঠান থেকেই বিভিন্ন কোম্পানি আচার নিয়ে বিক্রি করছেন।
 
আপনাকে একটা উদাহরণ দিই, আম দিয়েই বহুরকম আচার ও রেসিপি তৈরি করা যায়। আমখোসা আচার, আম টুকরো আচার, আমফলি, আমশাহী, আমবোম্বাই চাটনি, আম কাশ্মীরি, আমচুর আচার, আমসত্বের আচার, আমরসা, আম মধুবতী, আম পদ্মাবতী, আমের মোরব্বা, আমরসুন, আমের ক্যান্ডি, আমঝুড়ি ইত্যাদি। আমকে দীর্ঘদিন সংরক্ষণের তাগিদে আদি পদ্ধতিকে অবলম্বন করে এইসব আচার তৈরি করা হয়। আমের দিন চলে যাবার পরেও যখন আমের টক স্বাদ নিতে কারো ইচ্ছে হয় তখন তারা আমের আচার সংগ্রহ করে আমের তৃষ্ণা মেটাতে পারেন। কাঁচা আমের ক্যানডি ৫০০ গ্রাম ৩৫০ টাকা, কাঁচা আমের ফলি ৫০০ গ্রাম ৩০০টাকা, কাঁচা আমের ঝুড়ি ৪০০ গ্রাম ৩৮০ টাকা।
 
রবই নিয়েও রয়েছে নানামাত্রিক আচার। বরই রসগোল্লা, বরই সত্ব, বরই চাটনি, বরই মুঠো, কাঁচাপাতায় বরই আচার, কাচাপাকা বরই আচার, বরই তেঁতুল আচার, বরই মসলা, বরই জারক। বরই আচারে রয়েছে বিভিন্ন খনিজ দ্রব্য এবং ভিটামিন-এ ও ভিটামিন-সি। তাছাড়া খনিজ পদার্থ, শর্করা, খাদ্য শক্তি, ফসফরাসও রয়েছে।
 
তেঁতুলেরও রয়েছে রকমফের আচার। কাঁচা তেঁতুলের আচার, পাকা তেঁতুলের আচার, তেঁতুল মুঠো বা গোল্লা, তেঁতুল ক্যান্ডি, কাঁচা তেঁতুলের ক্যান্ডি, পাকা তেঁতুলের ক্যান্ডি, তেঁতুল চাটনি। তেঁতুলের আচার ওজন কমাতে সাহায্য করে। ফলে হৃদরোগ, কিডনি, লিভারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। শরীরের ভাল কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, খারাপ কোলেস্টেরল কমে যায়। 
 
এছাড়াও রয়েছে করমচার আচার, করমচার চাটনি, করমচা মুঠো, করমচা কাশ্মীরি আচার, করমচা জারক, জলপাই আচার, জলপাই ম্যাশড, জলপাই ফালি, জলপাই মুঠো, জলপাই ঝুড়ি, জলপাই জারক, জলপাই সত্ব, জলপাই কাশ্মীরি আচার, ডেউয়ার আচার, ডেউয়ার চাটনি, অরবরই আচার, অরবরই চাটনি, ঘৃত কুমারীর আচার, ঘৃত কুমারীর চাটনি, ডুমুরের আচার, ডুমুরের চাটনি, কেওড়ার আচার, কেওড়ার চাটনি, কেওড়ার মুঠো, কাঁঠালের আচার, কাঁঠাল সত্ব, আনারসের আচার, আনারসের সত্ব, আনারসের কাশ্মীরি আচার, আনারসের মুঠো, কামরাঙার আচার, কামরাঙার রসা, শুকনো কামরাঙার আচার, কামরাঙার চাটনি, বিলুম্বি আচার, বিলুম্বি চুর, বিলুম্বি চাটনি, বিলুম্বি সত্ব, আপেল আচার, আপেল সত্ব, লটকনের আচার, আমড়ার আচার, আমড়ার ফালি, আমড়ার ঝুড়ি, আমড়ার মোরব্বা, চাম্পক ফলের আচার, বঁইচি ফলের আচার, খেঁজুরের আচার, আলুবোখারার আচার, আলুবোখারার চাটনি, কদবেলের আচার, কদবেলের মুঠো, বেলের আচার, বেলের রসা, বেলের মুঠো বা সত্ব, চালতার 
আচার, থানকুনি পাতার চাটনি, আমলকি আচার, আমলকি ক্যান্ডি, আমলকি মোলাসেস বল, আমলকি ম্যাশড আচার, কালোজিরার আচার, কালোজিরার মুঠো, ধনেপাতা আচার, ধনেপাতা চাটনি, কাঁচামরিচের আচার, কাঁচামরিচের চাটনি, কাঁচামরিচের কুচি, কাঁচামরিচের জারক, রসুনের আচার, রসুনের জারক, মধুতে রসুন, আদায় রসুন, গাজরের আচার, ফুলকপির আচার, বীটগাজরের আচার, আদার আচার, কাঁচা হলুদের আচার, শুকনো মরিচের আচার, বোম্বাই মরিচের আচার, লেবুর আচার, লেবুর জারক, লেবু মাসালা, গুড়ে লেবুর আচার, লেবুর চোকলার আচার, সাতকরার আচার, সাতকরার জারক, জারা লেবুর আচার, জাবালেবুর জারক, গোলাপজাম মোরব্বা, পেঁয়াজের আচার, পেঁয়াজের জারক, কাঁচাপেঁয়াজের আচার, পেঁয়াজবেরেস্তার আচার,বাঁশফুলের আচার, ক্যাপ্সিক্যামের আচার, বেগুনের আচার, করলার আচার, করলার চাটনি, মুলার আচার, মুলার জারক, শসার জারক, কাঁচা পেঁপের কাশ্মীরি আচার, কাঁচা পেঁপের মোরব্বা ইত্যাদি। এই আচারগুলোর পাশাপাশি দেশীয় সরিষার তেল, ঘিও পাওয়া যায়।
 
লীনাস আচার মানেই বাহারি উদ্ভাবনী দৃষ্টিনন্দন পসরা। চোখে ধাঁধা লাগার মতোই অবস্থা। দেখলে মনে হয় এ কোন্ জগতে এলাম। যেদিকে দৃষ্টি ফিরাই সেদিকেই আচারের মনোহর জিজ্ঞাসা। লীনাস আচারের স্বত্বাধিকারিণীর একটাই চাওয়া— ঝুড়ি আচারের মাধ্যমে বাংলার খাদ্য সংস্কৃতি ও লোকজ সংস্কৃতি তুলে ধরা। এর ভবিষ্যৎ এখনো অজানা আমার কাছে কিন্তু আমি বিশ্বাস করি সামনে এক মিষ্টি রোদের সোনালী আলোর দেখা মিলবেই। 
 
লীনাস আচারের মূল আউটলেট উত্তরা হলেও বর্তমানে মিরপুরে একটি আউটলেট রয়েছে। লুৎফর নাহার লীনা গর্ববোধ করেন কিছু মানুষের কর্মসংস্থান করতে পেরে। কর্মপ্রচেষ্টা, কর্মমুখরতা যে বিফলে যায় না, তা আরো একবার প্রমাণ করলেন এই নারী উদ্যোক্তা।