সরকারি ছত্রছায়ায় বিদেশ যাচ্ছেন দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা

বাঁ থেকে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও সাবেক ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া

আইনি ব্যবস্থা ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন খাতের দুর্নীতিগ্রস্ত ও অবৈধ সম্পদের অধিকারী ব্যক্তিদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার কয়েকটি ঘটনা সম্প্রতি ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ার কারণে বিভিন্ন সংস্থার সহাযোগিতায় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা সাবেক কর্মকর্তারা সহজে দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারছেন।

পাশাপাশি, এসব ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান- বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদুক), গোয়েন্দা সংস্থা এবং বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছে কি না তা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন রয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। এদেরকে বিদেশ থেকে ফেরত আনা হবে।  
দেশের নানা গণমাধ্যমে আসাদুজ্জামান মিয়ার বিপুল অর্থসম্পদ অর্জনের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি দেশ ছেড়েছেন বলে খবর এসেছে।

গত বুধবার ডিএমপির সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়াকে সিঙ্গাপুর থেকে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যাননি। আসাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ডাক্তারের পরামর্শে  হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য তিনি সস্ত্রীক সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেট হাসপাতালে এসেছেন। চিকিৎসা শেষে আগামী ২২ জুন দেশে ফিরবেন। অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য অসত্য, বানোয়াট, অতিরঞ্জিত, মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি  বলেন, যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি সকল তথ্য প্রমাণসহ উপস্থাপন করবেন। আসাদুজ্জামান মিয়া সাংবাদিকদের দেশি ও বিদেশি মিডিয়ায় এ সব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নিউজ প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেছেন।  

অন্যদিকে তুরস্কের নাগরিকত্ব নেওয়া মানবাধিকার লংঘনের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি টাকা তুলে সবার চোখের সামনে দিয়েই দেশ ছেড়েছেন। এখন বেনজিরের ফ্ল্যাট এবং রিসোর্ট সরকার বাজেয়াপ্ত করেছে। গোপালগঞ্জ, গাজীপুর ও রূপগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি দখলের প্রমাণ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশী-কানাডীয় নাগরিক প্রশান্ত কুমার হালদার বা পি কে হালদারকে দুদকের চার্জশিট হওয়ার কয়েকদিন আগে দেশের বাইরে  চলে যান। তিনি গোপনে সমুদয় অর্থ ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন। বাংলাদেশের চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি দশ বছরে প্রতারণা করে ১১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠার পর দুদক তার এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মোট ৩৪টি মামলা করে। এর আগে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু দুদকের গ্রেফতারি পরোয়ানা ঘোষণার ঠিক আগে দেশ ছেড়েছেন। অভিযোগ আছে, সম্প্রতি আট ব্যাংকের মালিকানায় থাকা এস আলম গ্রুপের মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার ভাই আজারবাইজানের নাগরিকত্ব নিয়েছেন।

নাগরিকরা প্রশ্ন তুলছেন, দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা লুট হয়ে নিরাপদে বাইরে চলে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইইউ ও দুদকের কাজটা কি?

অর্থ বিভাগের একটি সূত্র বলছে,  দেশ থেকে ঋণের টাকার পাচার ঠেকানোর জন্য বিএফআইউ আছে। অর্থ পাচার কমানো গেলে এমনিতেই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমে আসবে। কিন্তু কাজ দেখাতে পারছে না এই সংস্থাটি। কয়েক দিন আগে দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহও গণমাধ্যমকে বলেছেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে টাকা লুট হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।

অনেকেই প্রশ্ন করছেন, বিএফআইইউতে এতো কর্মকর্তা-কর্মচারি কী করছেন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দি মিরর এশিয়াকে বলেন, টিআইবির অনেক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশের সেবা খাতের দুর্নীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগ, সরকারি ও বেসরকারী ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অবৈধ সম্পদের অধিকারীরা খুবই সহজে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার যোগসাজশে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তুরস্কে থাকা সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ বা এখন সিঙ্গাপুরে থাকা সাবেক ডিএমপি কমিশনার আসাদুজামান মিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতি এবং অবৈধ অর্থ ও সম্পদ পাহাড় গড়ার অভিযোগ থাকলেও সরকার তাদের ধরতে পারছে না। এত বড় মাত্রার দুর্নীতি, মাত্রাতিরিক্ত অবৈধ সম্পদের মালিকানা কোনোভাবেই একার পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। সরকারের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা দুনীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় সহজে বিদেশ পালিয়ে যেতে পারে।
তিনি আরো বলেন, এভাবে  গোপনে পালিয়ে গেলে মনে করতেই হবে এরা অপরাধটা এক অর্থে স্বীকার করে নিয়েছেন। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া এ দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কেউ ধরতে পারবে না।