ঋদ্ধি: সৃজনশীল ও মননশীল মানুষদের কেন্দ্রস্থল
পূরবী ভিলা, বাসা-০২, সড়ক- ০৯, ব্লক –ডি, সেকশন-১১, মিরপুর, ঢাকা ১২১৬। এই দৃষ্টিনন্দন বাড়িটি দেখলে যেকোনো শিল্পপিপাসুর মন থমকে যেতে বাধ্য। কবিতার আবহ। শিল্পীর কলাবিদ্যা তুলির টান স্পষ্ট। দার্শনিক চোখ দর্শন শাস্ত্রের জগতে নিয়ে যাবে। কিছুটা অস্থিরতা ভুলিয়ে স্বস্তির সৌকর্য ভুবনে একান্ত আলাপচারিতায় মগ্ন রবে।
হ্যাঁ, বলছিলাম ‘ঋদ্ধি প্রকাশন’ নিয়ে। ঋদ্ধি প্রকাশন ভবনের বাহিরের অংশটা এরকমই সাজানো। মিরপুর-১১ মেট্রো স্টেশন থেকে দুই মিনিটের পথ, পুরোনো ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের ঠিক পেছনের ভবন।
ঋদ্ধি প্রকাশনের স্বপ্নদ্রষ্টা মাহবুবুল হাসান ফয়সাল। সবেমাত্র এইচএসসির পাশের পর ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তি সাল ১৯৯৫। প্রথম বর্ষে পড়ার মাঝামাঝি সময়ে তার মামাতো ভাই তাকে নিজের পোশাক কারখানায় কাজ করতে বলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস সেরে প্রতিদিন চলে আসতেন কারখানায়। গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতেন। সকাল হলে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যেতেন। কারখানাটি ছিল মিরপুর-১ এ। ফলে যাতায়াতে তেমন কষ্ট ছিল না। কারখানার মার্চেন্ডাইজারের সঙ্গে তার ছিল সদ্ভাব।
স্নাতক পাস হওয়ার আগেই ফয়সাল মার্চেন্ডাইজিংয়ের সবকিছু আয়ত্ত করে ফেলেন। চাকরি আর পড়াশোনার মধ্যেও পুরোনো বই, পত্র-পত্রিকা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নিয়মিত নীলক্ষেতে যেতেন। সদস্য হয়েছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচিরও। একসময় সংগ্রহ যখন বড় হয়ে গেল, একটি খাতা কিনে বইগুলোর তালিকা করতে থাকলেন। পরিবারের সদস্যদের ডায়েরি, বাবা-মায়ের বিয়ের কার্ড, বাবার স্কুলের খাতা, দাদার বাজারের হিসাব ইত্যাদিও ছিল তার সংগ্রহে।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য হওয়ার সুবাদে পড়ুয়া বন্ধু পেলেন কয়েকজন। তাদের সঙ্গে বই আদান-প্রদান করতেন। লাইব্রেরি থেকেও বই নিয়ে পড়তে পারতেন। মৃদুল নামের এক বন্ধু একদিন নিয়ে গেলেন মো. রাজীব উল্লাহ’র বাসায়। আলাপে আলাপে ফয়সাল জানতে পারলেন, পুরোনো বই সংগ্রহ রাজীবের নেশা। পরিচিত হয়ে তাই খুশি হলেন।
এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার সফল সমাপ্তি টানেন তিনি। মন দিলেন নিজের একটি পোশাক কারখানা গড়ার দিকে। একুশ বছর আগে এই ভবনটির ছাদ ভাড়া নিয়ে ম্যাট্রিক্স নামের গার্মেন্টস প্রিন্টিং ফ্যাক্টরি শুরু করেছিলেন মাহবুবুল হাসান ফয়সাল। বিনিয়োগ করেছিলেন পৌনে দুই লাখ টাকা। সেলাই মেশিন কিনে নিলেন বেশ কিছু। টি শার্ট, পোলো শার্ট, পায়জামা তৈরির কাজে হাত দিলেন। পরিবারের কয়েকজন গার্মেন্টস ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে কাজ পেতে অসুবিধা হচ্ছিল না; তবে খাটুনির মাত্রা ছিল বেশি। কারণ গুণগতমান ১০০ ভাগ নিশ্চিত করতে না পারলে স্বস্তি পেতেন না ফয়সাল। ক্রমে ছয় তলা ভবনটির সবটাই ভাড়া নিয়ে নিলেন।
ব্যবসা বড় হওয়ার সাথে সাথে ব্যস্ততাও বাড়ছিল তার। কিন্তু বই ছাড়েননি। বই সূত্র ধরে রাজীবের সঙ্গেও সম্পর্ক দিনে দিনে গভীর হচ্ছিল। একসঙ্গে ২০০৬ সালে রাজীবকে সঙ্গে নিয়ে ফয়সাল গেলেন কলকাতা বইমেলায়। তারপর থেকে প্রতিবছর মেলা উপলক্ষে কলকাতা যাওয়া বহাল ছিল তাদের। মেলা ছাড়াও রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেও দুষ্প্রাপ্য সব বই সংগ্রহ করতে থাকেন।
২০১৫ সাল নাগাদ ফয়সাল একজন সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হয়ে উঠলেন। ২০১৭ সালে রাজীবকে বললেন, ‘এবার একটি প্রকাশনা সংস্থা করার সময় এসেছে, একটি বুক শপ এবং একটি আর্কাইভও করব। আপনি প্রস্তুতি নিন।’
এরপর ২০২১ সালের শেষদিকে পূরবী ভিলার প্রথম তিনটি ফ্লোর নিয়ে নিলেন তিনি। জান্নাত জুই নামের এক স্থপতিকে ডেকে আনলেন। দ্বিতীয় তলায় নিয়ে গিয়ে দেখালেন। বললেন, এখানে ২,৬৫০ বর্গফুট জায়গা আছে। একটি বুকশপ, একটি কিডস কর্নার, দুটি আর্কাইভ রুম, একটি স্যুভেনির শপ কাম রিসেপশনের ডিজাইন করে দিন। পুরোনো দরজা-জানালা যতটা সম্ভব রেখে দেওয়ার আগ্রহের কথাও জানালেন।
ঘর প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার পর দেওয়াল জোড়া তাক বানানো হলো। সবগুলো তাক বই দিয়ে ভর্তি করা হলো। সবরকমের পাঠকের কথা বিবেচনায় নিয়ে বই বাছাই করেন ফয়সাল। মেঝের একটা জায়গা একটু উঁচু করে দেওয়া হলো, বেঞ্চিও পেতে দেওয়া হলো কয়েকটি। ফলে শপটা কেবল দোকান নয়, পড়ার ঘরও হয়ে উঠল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলামের জন্য আলাদা দুটি কর্নার রাখা হলো। এর নাম দেয়া হলো ঋদ্ধি বুক ক্যাফে।
নিচ তলায় ঢুকতেই চোখে পড়বে এই ক্যাফেটেরিয়া। এখানে যে কেউ সারাদিন বই পড়তে পারবেন। পাশাপাশি খেতে পারবেন চা, কফি ও বেকারী সামগ্রী, পেস্ট্রি, বাটার ব্রেডসহ হরেক রকমের সস্ ও আচারের সমাহার। আছে লাঞ্চ এবং ডিনারের সেট মেনুসহ মুখরোচক নানান খাবারের আয়োজন। তা ছাড়া সপ্তাহে দুই দিন মাটির চুলায় লাকড়ি দিয়ে রান্না করা সিরাজগঞ্জের হাঁড়ার মাংস, গুঁড়া মাশকালাইয়ের ডালের সাথে লাঞ্চ-ডিনারের আয়োজনও রয়েছে।
ঋদ্ধি লাইব্রেরি মূলত দ্বিতীয় তলায়। ঋদ্ধি প্রকাশন এবং লাইব্রেরি পাশাপাশি। লাইব্রেরিতে পড়ার জন্য রয়েছে ১৫ হাজার বই। বাচ্চাদের জন্য রয়েছে একটি কিডস কর্নার। গবেষণার জন্য একটি আর্কাইভও আছে। আর্কাইভে ১০ হাজার দুর্লভ বই রয়েছে। যে কেউ চাইলেই আর্কাইভের বই পড়তে পারবেন না। কেবলমাত্র যারা গবেষণাকর্মের সাথে জড়িত তারা আবেদনপত্রের মাধ্যমে এই আর্কাইভের বই পড়তে পারবেন।
ঋদ্ধি বুকশপে বই বিপণনের ব্যবস্থাও রয়েছে। বই বিক্রির জন্য রয়েছে ১০ হাজার বই। দেশ-বিদেশের লেখক-প্রকাশকদের মানসম্মত বই। আর ঋদ্ধি প্রকাশন থেকে এ যাবৎ বই বেরিয়েছে ১৫টি। ঋদ্ধি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লাইব্রেরিতে বই ও কম্পিউটার দিয়ে সাহায্যও করে থাকেন। এছাড়াও রয়েছে বিবিধ স্টেশনারি সামগ্রী এবং স্ট্যাম্প কর্নার।
ঋদ্ধি গ্যালারি তৃতীয় তলায় অবস্থিত। নানা রকম প্রদর্শনীর জন্য সুসজ্জিত এই গ্যালারি। যে কোনো ধরনের আলোচনা সভা, যেমন স্মৃতিচারণ সভা, মোড়ক উন্মোচন, নাচ-গান-আবৃত্তি ও নাট্যানুষ্ঠানের সুব্যবস্থা রয়েছে। গ্যালারির পাশে প্রস্তুত করা হচ্ছে একটি ২৫ আসন বিশিষ্ট সিনে ক্লাব। বড় পর্দায় দর্শনার্থীরা এখানে সিনেমা দেখতে পারবেন। একটি মাঝারি আকারের আর্ট স্টুডিও রয়েছে, শিল্পীরা ছবি আঁকার বা ভাস্কর্য গড়ার কাজে ব্যবহার করতে পারবেন। এদিক থেকে দেখলে একে একটি মাল্টি পারপাস হল বলা যাবে। উন্মাদের কার্টুন প্রদর্শনী দিয়ে গ্যালারিটির যাত্রা শুরু হয়েছে। আট দিনব্যাপী ওই প্রদর্শনীতে অনেক দর্শক এসেছিলেন।
আনুষ্ঠানিকভাবে ঋদ্ধির শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হয় ২০২০ সালের ১৩ মার্চ। উদ্বোধনী দিনে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, শিল্পী রফিকুন নবী, শিল্পী মনিরুল ইসলাম, নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশিদ, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে মামুনুর রশিদ ঋদ্ধির উপদেষ্টা। তিনি ঋদ্ধির জন্য পুরোনো ও দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহ করতে সাহায্য করেন।
ঋদ্ধির সমন্বয়কারী মো. রাজীব উল্লাহ বলেন, ঋদ্ধির স্বপ্নদ্রষ্টা আসলে মাহবুবুল হাসান ফয়সাল। তিনিই ঋদ্ধির স্বত্বাধিকারী। তিনি একজন পড়ুয়া মানুষ। প্রচুর বই পড়েন। বই পড়া ও দুর্লভ বই সংগ্রহ করা তার নেশা। তিনি আরো বলেন, মিরপুরে এই ধরনের প্রতিষ্ঠান নেই। আমরাই প্রথম শুরু করেছি। ঋদ্ধি সৃজনশীল কর্মপ্রক্রিয়ার নানা উদ্যোগের সাথে কাজ করে থাকে। ঋদ্ধি টোটালি কালচারাল হাফ তৈরির জন্য একটা জগৎ নির্মাণ করবে, যা সৃজনশীল ও মননশীল মানুষদের কেন্দ্রস্থল হবে।