মিয়াজাকি বা সূর্যডিম আম কেন এত দামি
একটির দাম প্রায় ৩০ হাজার টাকা। আর প্রতি কেজির প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে এমনি অদ্ভূত দাম মিয়াজাকি বা সূর্যডিম আমের। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপক হারে চাষ হয়েছে বিশ্বের সব থেকে দামি এই আমের। আমের অন্যান্য জাত থেকে ব্যতিক্রমী ফলন হওয়ায় ফলচাষীসহ ফলপ্রেমীদের মাঝে দারুণ সাড়া ফেলেছে বিদেশি আমটি। বিশেষ পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই আম রঙ, স্বাদ ও আকারে অন্য সব আম থেকে একদমি আলাদা। মিয়াজাকি বা সূর্যডিম আমের এমন অদ্ভূত নাম হলো কীভাবে, আর আকাশচুম্বি দামের পেছনে আসল কারণটাই বা কী, চলুন জেনে নেওয়া যাক।
আমের নাম মিয়াজাকি বা সূর্যডিম কেন
উৎপত্তিস্থল জাপানের কিউশু রাজ্যের মিয়াজাকি নামক শহরে হওয়ায় শহরের নামটি যুক্ত হয়ে গেছে আমের নামের সঙ্গে। তবে জাপানি ভাষায় আমগুলো পরিচিত ‘তাইয়ো-নো-তামাগো’ নামে, যার বাংলা অর্থ ‘সূর্যের ডিম’। তাই বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চলে ‘সূর্যডিম’ নামেই আমটি অধিক পরিচিতি পেয়েছে।
অবশ্য আমের রঙ অনেকটা গাঢ় লাল হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে ‘রেড ম্যাংগো’ বা ‘লাল আম’ নামটিই অধিক প্রসিদ্ধ।
জাপানে মিয়াজাকি আমের প্রথম চাষের সময়কাল ১৮৬৮ থেকে ১৯১২ সাল হলেও ফলটি সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পায় ১৯৭০ দশক থেকে।
মিয়াজাকি আম দেখতে কেমন
তাইয়ো নো তামাগো আম দেখতে অনেকটাই মুরগির ডিমের মতো। আমগুলোর ওজন সর্বোচ্চ ৩৫০ গ্রাম এবং এতে চিনির পরিমাণ ১৫ শতাংশ বা তার বেশি। আকারে এটি সাধারণ আমের চেয়ে বেশ বড় ও লম্বা এবং গন্ধ ও স্বাদে মিষ্টতাও বেশি। রঙ গাঢ় লাল বা লাল ও বেগুনীর সংমিশ্রণ।
ওপরের খোসার নিচে ভেতরের সুস্বাদু খাওয়ার অংশটি একেবারেই আঁশমুক্ত এবং উজ্জ্বল হলুদ সুগন্ধযুক্ত।
উত্তর আমেরিকার ডোল ব্র্যান্ডের আমের সঙ্গে এর কিছুটা মিল আছে। তবে মূল্যের দিক থেকে তাইয়ো নো তামাগো অনেকটাই এগিয়ে।
মিয়াজাকি আমের দাম এত বেশি কেন
২০১৬ সালে জাপানের ফুকুওকায় নিলামে এক জোড়া মিয়াজাকি আমের মূল্য উঠেছিল ৫ লাখ জাপানি ইয়েন। মূল্যটি সে সময়ের বাজার রেট অনুযায়ী ৪ হাজার ৫৪৭ মার্কিন ডলারের সমতূল্য ছিল। ইন্টারনেটের সুবাদে এই খবরটি ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই মূলত সবার নজর কাড়ে জাপানি আমটি।
তাইয়ো নো তামাগোর সর্বোচ্চ ফলন হয় এপ্রিল থেকে আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে। গাছ থেকে সংগ্রহের পর সেরা আমগুলোর সরাসরি চলে যায় নিলামে। প্রতি বছর এপ্রিল মাসে মিয়াজাকি শহরের পাইকারি বাজারে শুরু হয় এই নিলাম। স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে আমের রঙ, মিষ্টতা, স্বাদ, ও আকার-আকৃতির বিচারে নির্ধারিত হয় সেরা মানের আম।
নিলামে দেশের বড় বড় ফল ডিস্ট্রিবিউটররা সেগুলোর জন্য বিড করে। গড়পড়তায় নিলামের মূল্য থাকে আম প্রতি ৫০ মার্কিন ডলার বা ৫ হাজার ৮৬৩ টাকা (১ মার্কিন ডলার = ১১৭ দশমিক ২৫ বাংলাদেশি টাকা)। তবে কখনও কখনও এই মূল্য অনেক বেড়ে যায়। এখন পর্যন্ত একটি আমের সর্বোচ্চ দাম উঠেছে ২ হাজার মার্কিন ডলার (২ লাখ ৩৪ হাজার ৫০৩ টাকা)।
২০১৯ সালে জাপানে এক জোড়া তাইয়ো নো তামাগোর দাম উঠেছিল প্রায় ৫ হাজার মার্কিন ডলার, যা সে সময়ের বাজার রেট অনুসারে প্রায় ৪ লাখ টাকারও বেশি। ২০২৩ সালে ভারতে এই আমের কেজি বিক্রি হয়েছে আড়াই লাখ রুপিতে।
এমন চোখ কপালে তোলা দামের নেপথ্যে রয়েছে আমটির সুনির্দিষ্ট চাষাবাদ পদ্ধতি এবং দুষ্প্রাপ্যতা। সঠিক পরিবেশের মাঝে সুক্ষ্ম পরিচর্যার মাধ্যমে যে উন্নত মানের আমের উৎপাদন হয় তা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না। এছাড়া পরিপক্কতা লাভের পর যে গভীর লাল বর্ণটি আসে তা আমের অন্যান্য জাতের মধ্যে বেশ দুর্লভ।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই আমগুলোর কেনাবেচা শুধুমাত্র সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং বিভিন্ন কর্পোরেট উপহার এবং বিশেষ উদযাপনের দিনগুলোতে উপহার হিসেবে বিক্রি হয় এই আম। এমনকি হাত বদলের আগে এগুলোকে যত্ন সহকারে সুক্ষ্ম কারুকাজ মেশানো বাক্স বা মোড়কে ভরা হয়।
মিয়াজাকিতে সূর্য ডিমের চাষ পদ্ধতি
এই উপক্রান্তীয় অঞ্চলের প্রধান সুবিধা হলো উর্বর মাটি এবং পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত; এর সঙ্গে যুক্ত হয় দিনভর সূর্যালোকের নিরবচ্ছিন্ন উষ্ণতা। এই সবকিছু একসঙ্গে সূর্যডিম আমের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করে মিয়াজাকিকে।
এছাড়া স্থানীয় কৃষকরা যত্ন সহকারে আম গাছগুলোর জন্য গ্রিনহাউসের ব্যবস্থা করেন। ঘরগুলো ফলের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ সরবরাহ করে। বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিটি আম সতর্কতার সঙ্গে একটি জালে আবদ্ধ করা হয়। এই জাল গ্রিনহাউস সিলিংয়ের সঙ্গে একটি ওভারহেড তারের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা থাকে। ফলে ঘরে ভেতরে থাকলেও প্রতিটি ফল গ্রিনহাউস গ্লাসে প্রতিফলিত সূর্যালোক পায়। এতে করে বৃদ্ধির পাশাপাশি সেই নজরকাড়া গভীর লাল রঙ পেতেও সহায়তা করে। ব্যবহার করা হয় যাতে রঙ অভিন্ন হয়।
সম্পূর্ণ রূপে পরিপক্কতা পেয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে আমগুলোকে ছিড়ে ফেলা হয় না। বরং সেগুলো নিজে নিজেই গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়। নিচে স্থিতিশীল জাল থাকায় আমগুলো পড়ে শক্ত আঘাতে ওপরের ত্বক নষ্ট হয়ে যায় না। এভাবে হাতের কোনো স্পর্শ ছাড়াই সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে বেড়ে ওঠা আমগুলো তাদের মৌলিক গড়ন, ওজন, গন্ধ ও স্বাদ পায়।
এরপর চূড়ান্তভাবে বাজারে সরবরাহের আগে স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে আমের গুণগত মান নিশ্চিত করা হয়। এখানে চাষ ও পরিচর্যার পুরোটা সময় কৃষকরা থাকলেও তাদেরকে দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয় না।
বাংলাদেশে সূর্যডিম আমের উৎপাদন
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সূর্যডিম আমের চাষ হলেও উৎপাদনের দিক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল বেশ এগিয়ে। সেখানে রাংগুই বা আম্রপালির সঙ্গে একত্রে চাষাবাদ হচ্ছে সূর্য ডিমের।
খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার অন্তর্গত ধুমনিঘাট এলাকার ৩৫ একরের আম বাগানটি তৈরি হয়েছিল ২০১৬ সালে। এখন পর্যন্ত বাগানটিতে সূর্যডিম আম গাছের সংখ্যা প্রায় ১২০টি। এগুলোর প্রত্যেকটির বয়স ৩ থেকে ৪ বছর এবং প্রত্যেকটিতেই এ পর্যন্ত আম ধরেছে ৩০ থেকে ৪০টি।
এ বছর মুন্সীগঞ্জের উত্তর বেতকা মামুদাতপুর গ্রামের একটি আম বাগানে ৪টি আমগাছ থেকে উৎপাদিত হয়েছে ৩০ কেজি মিয়াজাকি আম। এই বাগানের মিয়াজাকিগুলো বিক্রি হয়েছে সর্বনিম্ন কেজি প্রতি ৭০০ টাকায়।
সম্প্রতি ঢাকার আসাদগেটে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ফল বাগানে ছোট কয়েকটি ছাড়া বাকি সবগুলো আমগাছ-ই ছিলো ফলশূন্য। সেই ছোট গাছগুলো ছিল এই জাপানি আমের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদিত সূর্যডিম আম সংখ্যা ছিলো ২৪ টন। আর ২০২৩-২৪-এ এই সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছে ২৫ টন, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ উৎপাদন।
প্রথম দিকে শখের বশে হলেও এখন অনেকেই মিয়াজাকি চাষকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছেন। বাংলাদেশে এ আমের চাষাবাদ শুরুর পর প্রথম দিকে প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। ২০২৩-এ অনেক খামারি একই পরিমাণ বিক্রি করেছেন ২ হাজার টাকায়। এমনকি অনেকে এর কমেও দিচ্ছেন।
বিশ্ব বিখ্যাত আমের এই দর পতন বেশ সমালোচনার জন্ম দিয়েছে সারা দেশজুড়ে।
মূলত মিয়াজাকির উৎপাদনে জাপানে যেমন যত্ন নেওয়া হয়, তা এখানে নেওয়া হয় না। অন্য জাতের আমের মধ্যে একসঙ্গে এগুলোও চাষ করা হয়। কিন্তু জাপানসহ বিশ্বের অন্যত্র মিয়াজাকির জন্য থাকে আলাদা নেট হাউসের ব্যবস্থা। প্রত্যেকটি আম কতটা সূর্যালোক এবং কতটা পানি পাচ্ছে- তা সুক্ষ্মভাবে যাচাই করা হয়। এমনকি কোনও কোনও স্থানে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েও এই আমের পর্যবেক্ষণের রীতির কথা শোনা যায়।
মিয়াজাকি আমের মূল আকর্ষণ যে গভীর লাল রঙ, সেই রঙটাই এখানে পাওয়া যায় না। আর এতেই প্রমাণিত হয় আমের গুণগত মানের ঘাটতির বিষয়টি। কেননা এই রঙ আসার জন্য মিয়াজাকির কৃষকদের মত বিশেষ চাষাবাদ প্রক্রিয়া এবং যত্নের প্রয়োজন।
শেষাংশ
মিয়াজাকির পরিবেশের মতো অবিকল সুবিধা প্রদান সম্ভব না হলেও বাংলাদেশের উষ্ণ প্রকৃতি মিয়াজাকি বা সূর্যডিম আম উৎপাদনের জন্য সহায়ক। তবে চাষ পদ্ধতিতে জাপানিদের মতো যত্নের নিশ্চয়তা থাকলে ফলনে বিশ্ব মানের লাল আম পাওয়া সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে বিশ্ব বাজারের আকাশচুম্বি মূল্যের সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে স্থানীয় বাজারেও।
বিগত বছরগুলোর ফলনের সূত্রে ইতোমধ্যে দেশ জুড়ে এই আমের উপযোগিকা দৃষ্টিগোচর হওয়া শুরু করেছে। এই পরিস্থিতি কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের সমৃদ্ধির জন্য নিঃসন্দেহে এক ইতিবাচক সংযোজন।