ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এ সরকার দিল্লির অধীনতা মানছে
বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে পশ্চিমবঙ্গের গেদে থেকে ভুটান সীমান্তবর্তী ডালগাঁও পর্যন্ত ট্রেন চালাতে চায় ভারত। আগে করা এ প্রস্তাব নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে গত শনিবার। আলোচনা হয়েছে তিস্তা প্রকল্প নিয়েও। এ ছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদারে ১০টি সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) সই করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে দুই দেশের সরকারপ্রধানের মধ্যে একান্ত ও দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে তাদের উপস্থিতিতে এসব এমওইউ সই হয়। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান।
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের ট্রেন চলাচলসহ সমঝোতা স্মারক নিয়ে দেশের নাগরিকদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। দ্য মিরর এশিয়া অর্থনীতিবিদ ড. প্রফেসর মাহবুব উল্লাহ চৌধুরীর কাছে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে একাধিক করিডোর নিয়েছে ভারত। এ করিডোরের বিনিময়ে যে মাশুল পাওয়ার কথা, সে বিষয়ে আমরা সঠিক তথ্য জানি না। একবার আওয়ামী লীগের এক উপদেষ্টা বলেছিলেন, মাশুল চাওয়া অসভ্যতা। এটা কোনো সভ্য দেশ আশা করতে পারে না। এসব সমঝোতা স্মারক টোটালি দিল্লির মর্জিমাফিক।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতীয় রেল চলাচলে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক পরিবেশ অর্থাৎ কস্ট অব বেনিফিট কী; তার কোনো উল্লেখ নেই এ চুক্তিতে। এ ধরনের রেল চলাচলে সড়ক ও পরিবেশের ক্ষতি হবে। এরচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য বিপদজনক। এক দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কাজগুলো করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের শ্রমবাজার ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে উল্লেখ করে মাহবুব উল্লাহ চৌধুরী বলেন, প্রতিবছর ভারত ৫ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে। এর মাত্রা আরো বাড়বে। ফলে দেশে বেকারত্বের হার আরো বাড়বে। ক্ষমতার আসন টিকিয়ে রাখার জন্যই সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
এ বিষয়ে রাজনীতি ভাষ্যকার ফরহাদ মজহারের কাছে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ধরণ ঔপনিবেশিক। এক-এগারোর পরবর্তী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট শক্তি ক্ষমতায় এসে যে শক্তিশালী মাফিয়া ও লুটেরা শ্রেণি তৈরি করেছে, তার সমর্থনের ভিত্তি দিল্লি। তাদের ক্ষমতার দর্প বাড়বে। বাংলাদেশের বক্ষ ভেদ করে ভারত রেললাইন নেবে না কি করবে সেটা একান্তই দিল্লির সিদ্ধান্তে ঘটছে। এর বিরোধিতা করার কোনো রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশে নেই। কোনো রাজনৈতিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরও বাংলাদেশের নেই।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ দিল্লির কলোনি, যেমন ইসরাইলের কলোনি ফিলিস্তিন। মনে রাখবেন রেললাইন শক্তিশালী কলোনিয়াল সিম্বলও বটে। যাকে অনেকে ‘কলোনিয়াল ভায়োলেন্স’-এর চিহ্ন মনে করেন। একপক্ষীয়ভাবে এ সব তথাকথিত ‘চুক্তি’ বা সম্পর্ক ঠিক হচ্ছে। এর ভালো কি মন্দ বিচার করার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। কলোনি কী করে! কলোনি এই কাজগুলোই করে। বাংলাদেশের বাজার দখল শুধু নয়, ভারতের বাজার বিকাশের অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশে। আমরা কাঁটাতারের কারাগারে বন্দি থেকে সস্তা শ্রম সরবরাহের ক্ষেত্র হয়ে থাকব। এতে লাভবান হবে ভারতের ধনিক শ্রেণি। বাংলাদেশের অর্থনীতি এর দ্বারা উপকৃত হবে না। কিন্তু প্রাণ, পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংসের দায় আমাদের বহন করতে হবে। আমাদের অর্থনৈতিক বিকাশের সম্ভাবনা এতে আরও রুদ্ধ হবে। কারণ এর সঙ্গে আমাদের আভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থা বিকাশ কিম্বা অবকাঠামো নির্মাণের কোনো সম্পর্ক নেই।
নাগরিক ঐক্য’র আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার কাছে জানতে চাইলে তিনি দ্য মিরর এশিয়া’কে বলেন, শুধু আমার কাছে না, দেশের সব মানুষের কাছে বিষয়টি সারপ্রাইজিং। বাংলাদেশ অবিরল ভারতের স্বার্থ দেখে আসছে। একদমই একতরফা চুক্তি। ভেরি সারপ্রাইজিং। তিনি আরো বলেন, এটা এক ধরনের দাসখত দেওয়ার সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। এটার জন্য বাংলাদেশের মানুষ বিক্ষুব্ধ। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য এ সরকার সব করছে। দিল্লির অধীনতা মানছে। দিল্লিকে খুশি করাই এই সরকারের কাজ। তিস্তা নিয়ে এখনো কোনো সুরাহা হয়নি, বর্ডার অরক্ষিত।
বর্তমানে পাঁচ রুটে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ট্রেন চলে। তিনটি যাত্রীবাহী ইন্টারচেঞ্জ, বাকি দুটি পণ্যবাহী। নিয়মানুযায়ী, ভারতীয় ট্রেন সীমান্তে আসার পর বাংলাদেশি ইঞ্জিনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আসে। বাংলাদেশী লোকোমাস্টার (চালক) তা চালিয়ে আনেন। ফিরে যাওয়ার সময়েও একই নিয়ম অনুসরণ হয়। নতুন প্রস্তাবে ভারত পশ্চিমবঙ্গের গেদে থেকে ভুটান সীমান্তবর্তী ডালগাঁও পর্যন্ত পণ্যবাহী ট্রেন চালু করতে চায়। এক্ষেত্রে সময় ও দূরত্ব কমাতে ব্যবহার করতে চায় বাংলাদেশের রেলপথ। অর্থাৎ দর্শনা দিয়ে ঢুকে ঈশ্বরদী-আব্দুলপুর-পার্বতীপুর হয়ে চিলাহাটি পর্যন্ত বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতীয় ট্রেনটি আবার ভারতে ঢুকবে।