ক্রমে স্বৈরাচার হয়ে ওঠা শেখ হাসিনার প্রতিহিংসার শিকার ড. ইউনূস: টাইম
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ব্যক্তিগত ক্রোধে’ জালিয়াতি, মানি লন্ডারিং এবং অর্থ আত্মসাতসহ দুই শ’রও বেশি মামলার মুখোমুখি গরীবের ব্যাংকার হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
যুক্তরাষ্ট্রের টাইম ডটকম সোমবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটি সাক্ষাৎকার ভিত্তিক প্রতিবেদনে এসব জানায়। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড.ইউনূস।
টাইম ম্যাগাজিন বলছে, বাংলাদেশে ক্রমে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা সরকারের প্রতিহিংসার বিচারে ড. ইউনূস একজন সাধারণ অপরাধী, যাকে আক্ষরিক অর্থে ঢাকার আদালতে বন্দি অবস্থায় দেখা যায় জানুয়ারিতে। ড. ইউনূস এবং তার টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি গ্রামীণ টেলিকমের অন্য তিন কর্মকর্তাকে বাংলাদেশের শ্রম আইন লঙ্ঘনের জন্য ছয় মাসের কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমটির ভাষ্য, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার সহযোগীদের জামিন দেওয়া হয়েছিল, যদিও এটি জালিয়াতি, মানি লন্ডারিং এবং আত্মসাতসহ দুই শ’রও বেশি মামলার মাত্র একটি।
টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে ড. ইউনূসের প্রতি শেখ হাসিনার ‘ক্রোধ’ প্রকাশের বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, শেখ হাসিনা ২০১১ সাল থেকে ক্ষুদ্রঋণের জনক ইউনূসকে দরিদ্রদের ‘রক্ত চোষা’ হিসাবে উপহাস করে আসছেন। একই বছর তাকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করেছেন।
অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি শেখ হাসিনার ‘ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে’ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের তীব্র পতন ঘটছে, সেই সঙ্গে একটি অঞ্চল জুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব হ্রাস পেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে টাইম।
গত ২০২২ সালে আওয়ামী লীগের এক সভায় শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটি এমডি পদের জন্য পদ্মা সেতুর মতো সেতুর টাকা বন্ধ করেছে, তাকে পদ্মা নদীতে দুইটা চুবানি দিয়ে তোলা উচিত। মরে যাতে না যায়, পদ্মা নদীতে একটু চুবানি দিয়ে সেতুতে তুলে দেওয়া উচিত। তাহলে যদি শিক্ষা হয়। পদ্মা সেতুর অর্থ বন্ধ করাল ড. ইউনূস। কেন? গ্রামীণ ব্যাংকের একটি এমডি পদে তাকে থাকতে হবে’।
গ্রামীন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষিত বর্ণনায় টাইমকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, দেশে তৎকালীন দুর্ভিক্ষ দেখে ‘অর্থনীতিকে একটি অর্থহীন বিষয়’ মনে হয়ছিল তার কাছে। জুম-অ্যাপে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এগুলো (অর্থনীতি) অন্তঃসারশূন্য ধারণা, যা আমাকে শেখায়নি কীভাবে দরিদ্র মানুষকে ক্ষুধা থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করা যায়’।
চার দশকেরও বেশি সময় ধরে, বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক বিশ্বের এক কোটিরও বেশি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে জামানতবিহীন ঋণ কর্মসূচীর আওতায় প্রায় ৩৭ বিলিয়ন ডলার বিতরণ করেছে। গ্রামীন ব্যাংকের এই ক্ষুদ্র ঋণের সপ্নদ্রষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। যিনি প্রথম গ্রাহককে ৫ ডলার ঋণ দেওয়ার কথা এখনও স্মরণ করেন।
টাইমের প্রতিবেদনে বলা হয়, সময়টা ১৯৭৪ সাল। ড. ইউনূস তখন মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষকতা থেকে তার জন্মভূমি বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন, যেটি তিন বছর আগে ‘গৃহযুদ্ধে’ পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছিল। ইউনূস নতুন দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন।
ইউনূস তার ক্যাম্পাসের কাছের গ্রাম ঘুরে ঘুরে বাস্তব সমাধান খুঁজতেন। এক দিন তিনি লুকিয়ে দেখতে পান, এক নারী একটি বাঁশের অভিজাত একটি টুল (বসার আসবাব) তৈরি করছেন একটি জীর্ণ ঘরের পাশে। ড. ইউনূস টাইমকে বলেন, আমি দেখলাম যে সে যে (টুল) আসবাব তৈরি করছে এবং সে যে বাড়িতে থাকে তার মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে। ওই নারী শুরুতে ইউনূসের সঙ্গে কথা বলতে ইতস্তত বোধ করেছিলেন। যদিও তিনি পরে ওই নারীর কাছ থেকে কথা আদায় করে জানতে পারেন, এসব আসবাব তৈরির উপকরণ সংগ্রহের জন্য তিনি ৫ ডলারের সমতুল্য অর্থ ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু তারপরে খোলাবাজারে তার টুল বিক্রির পরিবর্তে, ঋণ পরিশোধের শর্ত মানতে গিয়ে তার সমস্ত মালামাল ঋণদাতার নির্ধারিত মূল্যে দিয়ে দিতে হয়েছিল। ইউনূস জানান, তিনি এসব শুনে বলেন, ‘‘আমি বলেছিলাম, ‘এটা দাসত্ব, এটা কোনো ব্যবসা নয়!’ ৫ ডলারের জন্য এমন দারুণ দক্ষ কাউকে দাসে পরিণত করা যেতে পারে!’’
ইউনূস ওই নারীকে ৫ ডলারের সমতুল্য অর্থ ধার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং বলেন, যখনই তিনি সক্ষম হবেন তখন এ অর্থ পরিশোধ করলেই চলবে। তিনি তাকে এমন দুর্দশায় থাকা অন্যান্য গ্রামবাসীকে তার কাছে আসতে বলতে ওই নারী উৎসাহিত করেন। অবশেষে ৪২ জন নারীর একটি দলকে মোট ২৭ ডলারের সমান অর্থ ধার দেন ড. ইউনূস। সেই সাধারণ কাজটি থেকে একটি ‘মাইক্রোক্রেডিট’ গবেষণা প্রকল্প তৈরি করা হয়, যার সাফল্য ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংকে পরিণত হয়েছিল।
টাইম জানায়, ইউনূস যে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প শুরু করেন, তা বিশ্বজুড়ে এক শর বেশি উন্নয়নশীল দেশে কার্যকর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে ২০০৮ সালে প্রথম অফিস খোলার পর থেকে গ্রামীণ আমেরিকা ৩৫টি শহরে ছড়িয়ে পড়েছে এবং প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ দিয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের আচরণের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা বরাবর ১০০ জনেরও বেশি নোবেল বিজয়ীসহ ১৭০-এরও বেশি বিশ্বনেতা চিঠি দিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস-হোর্তা, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুনের মতো ব্যক্তিত্ব।
শ্রম আইন ও দুর্নীতি দমন আইনের অপব্যবহারের ফলে বাংলাদেশে আইনের শাসন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। একই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট। মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, অন্য আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে আমরাও এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছি, ড. ইউনূসকে হয়রানি ও ভয় দেখানোর জন্য বাংলাদেশে এসব মামলায় শ্রম আইনের অপব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। মিলার বলেন, শ্রম ও দুর্নীতি দমন আইনের অপব্যবহার বাংলাদেশে আইনের শাসন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পথকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলেও আমাদের উদ্বেগ রয়েছে।
এর আগে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দোষী সাব্যস্ত করা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবরুদ্ধ দশার প্রতীক। বাংলাদেশে কর্তৃপক্ষ স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে। সমালোচকদের দমিয়েছে।
টাইম বলছে, অধ্যাপক ইউনূসের বিচারের কারণে ওয়াশিংটনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ক্রমশ অবনতিশীল। বাংলাদেশে মানবাধিকারের অবনতিশীল চিত্রের মধ্যে রয়েছে লক্ষাধিক বিরোধী কর্মী রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছে এবং ২০০৯ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রায় ২৫০০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে, শেখ হাসিনাকে বাইডেন প্রশাসনের সর্বশেষ দুটি সামিট ফর ডেমোক্রেসি সমাবেশে আমন্ত্রণ জানায়নি।
টাইম বলছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে, গত বছর মে মাসে ওয়াশিংটন সুষ্ঠু নির্বাচনকে ক্ষুন্ন করে এমন যে কোনো বাংলাদেশির ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপরে ঘোষণা দেয়। যার জবাবে শেখ হাসিনা সংসদে বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে গণতন্ত্রকে দূর করার চেষ্টায় আছে। শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের চাপে নড়েনি এবং বিরোধীদের দ্বারা বয়কট করা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফিরে আসেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ন্যায্য নয় বলে নিন্দা করছেন।
ড. ইউনূসের সঙ্গে বিদ্বেষমূলক সম্পর্কের পেছনে টাইম দুটি কারণ উল্লেখ করেছে। তারা বলছে, প্রথমত এটি একটি খোলামেলা বিষয় যে, শেখ হাসিনাকে এ ঈর্ষা গ্রাস করেছে যে ড. ইউনূস তার নোবেল শান্তি পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়েছেন। শেখ হাসিনা গভীরভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার যাচনা করেন। প্রথমে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির কারণে শেখ হাসিনা এ পুরস্কার পাবেন বলে দৃড়ভাবে মনে করতেন। তারপর ২০১৭ সালে প্রতিবেশী বার্মা থেকে পালিয়ে আসা দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিমকে আশ্রয় দেওয়ার জন্যও শান্তিতে নোবেল তার পাওনা বলে ভেবে ছিলেন। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক এবং সরকারি কর্তাব্যক্তিরা নিয়মিত শোক প্রকাশ করেন যে, নরওয়ের নোবেল কমিটি শেখ হাসিনাকে স্বীকৃতি দেয়নি।
টাইম আরেকটি ‘মূল বিষয়’ হিসেবে বলছে, শেখ হাসিনা ড. ইউনূসকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখেন। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে এবং ড. ইউনূসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দেয়। যা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু সেই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি রাজনৈতিক দল চালু করেন। তার এ উদ্যোগ মাত্র ১০ সপ্তাহ স্থায়ী হয় এবং তারপর থেকে তিনি যে কোনো রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে অস্বীকার করে আসছেন।
ইউনূস বলেন, শেখ হাসিনা আমাকে রাজনীতিতে আসার জন্য অভিযুক্ত করে চলেছেন, যেন রাজনীতিতে আসাটা অপরাধ।
টাইম আরো বলছে, ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনা যখন বন্দী ছিলেন, ইউনূস তখন তার এ সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক দ্বৈরথ শুরু করেন; যাকে হাসিনা চরম বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করেন এবং তা কখনো ক্ষমা করেননি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া উপ-পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেছেন, শেখ হাসিনা এটাকে খুব খারাপভাবে নিয়েছেন যে তাকে (ইউনূস) রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে। মনে হয় যে এ কারণেই তাকে (ইউনূস) অসম্মান করা হচ্ছে, জেলে পাঠানো হচ্ছে, অপমান করা হচ্ছে।