এক বছরেই ছয় প্রতিষ্ঠানের মালিকানা
২০০৮ সালে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক) নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের বার্ষিক আয় ছিল মাত্র দুই লাখ ৪৪ হাজার টাকা; তিনি তখন স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন নেতা ছিলেন। ২০১৮ তার আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৭৮ লাখ ৩২ হাজার টাকায়; যা ২০২৩ সালে গিয়ে ঠেকে তিন কোটিতে। তখন পর্যন্ত লিটন বা তার পরিবারের মালিকানায় বড় কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। তবে এক বছরের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের এই সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নিজে ও পরিবার একে একে ছয়টি প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে গেছেন।
লিটনের সম্পদের একটি তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যায় তার ২০০৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেওয়া নির্বাচনী হলফনামায়। এতে বোঝা যায় কতটা দ্রুত তার সম্পদ বেড়েছে। ২০০৩ সালের হলফনামায় লিটন অস্থাবর সম্পদের হিসাব দিয়েছিলেন ৪ কোটি ১৭ লাখ ৬২ হাজার ৮৯৯ টাকার। ২০১৮ সালে তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, যা ২০০৮ সালে ছিল মাত্র ৫ লাখ ২৯ হাজার টাকা।
হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সাল পর্যন্ত লিটনের স্ত্রী শাহীন আক্তার রেনির কোনো আয় ছিল না। ৪ বছরের ব্যবধানে ২০২৩ সালে তিনি ‘ব্যবসা ও মাছ চাষ’ থেকে বছরে ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা আয় করেছেন। একই সময়ের মধ্যে রেনি ৭৯ লাখ টাকার মাছের খামার ও ২ কোটি ২০ লাখের অস্থাবর সম্পদসহ ১.৭৭ একর কৃষি জমির মালিক হন। শহরের উপকণ্ঠে একটি দোতলা বাড়িরও মালিক তিনি।
ইতিমধ্যে লিটনের পরিবার যে যুক্তরাজ্য ও দুবাইয়ের দুটি অফশোর কোম্পানির সঙ্গে সম্পৃক্ত সেই খবর ঢাকার একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা খায়রুজ্জামান লিটন সেই সংবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদলিপি ছাপানোর ব্যবস্থা করেছেন। সেখানে তিনি দাবি করেছেন, সিবন্ড শিপিং নামের কোম্পানির সঙ্গে তার ও তার পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই।
তবে দ্য মিরর এশিয়ার অনুসন্ধানে জানা গেছে, খায়রুজ্জামান লিটন ও তার মেয়ে আনিকা ফারিহা জামানের সিবন্ড শিপিংয়ের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। লিটন ও তার পরিবার বর্তমানে দুটি নয়, ছয়টি লিমিটেড কোম্পানির ব্যবসায়িক অংশীদার। যার মধ্যে অন্তত চারটি শিপিং কোম্পানি। ২০২৩ সালে রাসিক নির্বাচনে লিটন তৃতীয় মেয়াদে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পর থেকে এক বছরের মধ্যে এসব কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
রহস্যময় ব্যবসায়িক অংশীদার
রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ও তার পরিবারের ব্যবসায়িক অংশীদারদের কর্মকাণ্ড নিয়ে গেল সপ্তাহে ঢাকার গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। সেসব এতদিন অজানাই ছিল। বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার ২৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ওই খবরে বলা হয়, পুরো পরিবারটি একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন করে থাকে; যার নাম আমানা গ্রুপ।
গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছর দুয়েক আগে উত্তরায়ণ আমানা সিটি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে রাজশাহী শহরের ৬ হাজার বিঘা জায়গার ওপর একটি প্রাইভেট হাউজিং প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়; যার সভাপতি ছিলেন লিটনের স্ত্রী শাহিন আক্তার রেনি। তিনি একইসঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। এই হাউজিং কোম্পানির মাধ্যমে রেনি আমানা গ্রুপের একজন পরিচালকও হয়েছিলেন। সম্প্রতি এ কোম্পানির বিরুদ্ধে অন্যের জমি প্রজেক্টের আওতায় দেখিয়ে প্লট আকারে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। আমানা গ্রুপের বিরুদ্ধে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসার আদলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে প্রশাসনের কাছে লিখিতভাবে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
আরও পড়ুন: ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে মেয়র লিটনের রহস্যময় ব্যবসায়িক সম্পর্ক
২০২৩ সালের ১ অক্টোবর আমানা গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুল করিম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদুল হক এবং নির্বাহী পরিচালক আবু সাঈদ চৌধুরী অ্যাপোলো নোভা ক্যাপিটাল লিমিটেড নামে যুক্তরাজ্যের অক্সটেডের একটি রহস্যময় কোম্পানির পরিচালক হিসেবে যোগ দেন।
অ্যাপোলো নোভা ক্যাপিটালের একটি ‘ওয়ান জিবিপি’ কোম্পানি। যার সর্বশেষ ঠিকানা হলো ফ্ল্যাট ৫, হার্ডউইক হাউস, ইডেন প্লেস, অক্সটেড। কোম্পানির আগের পরিচালক যুক্তরাজ্যে বসবাসরত পাকিস্তানি নাগরিক তাহির রউফকে সেক্রেটারির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর অ্যাপোলো নোভা ক্যাপিটাল লিমিটেডের নাম পরিবর্তন করে আমানা বিগ বাজার করা হয়। তবে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আমানা গ্রুপ এখন পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগের জন্য কোনো অনুমোদন নেয়নি।
চলতি বছরের ২ মে একই ঠিকানায় আরেকটি কোম্পানি নিবন্ধিত হয়। কোম্পানির নাম সুইস মার্স গ্রুপ লিমিটেড। তাহির রউফের সাথে আমানা গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক আবু সাঈদ চৌধুরীও এই কোম্পানির পরিচালক। যিনি যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসের সদস্য নওশিনা মোবারিকেরও ব্যবসায়িক অংশীদার।
আমানার তিন কর্মকর্তাই লিটন-রেনি দম্পতির ব্যবসায়িক অংশীদার। এই দম্পতির মেয়ে আনিকা ফারিহা জামানেরও তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব রয়েছে। তাদের আরেক ব্যবসায়িক অংশীদার হলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আবুল হোসেন; যিনি গুরুতর কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই মাঝরাতে বিজিবির মহাপরিচালকের পদ থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। সি বন্ড শিপিং নামে তাদের একটি নিবন্ধিত কোম্পানি রয়েছে। এতে ডা. এম এ এ সরদার নামে আরও একজন পরিচালক রয়েছেন; যার আসল নাম মোহাম্মদ আলমগীর আখতার সরদার। তিনি কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে রিভার এজ শিপিং প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির পরিচালক।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, পাকিস্তান ও দুবাইয়ে একই নামে শিপিং কোম্পানি রয়েছে। পাকিস্তানে এর নাম রিভার এজ শিপিং প্রাইভেট লিমিটেড, তবে দুবাইয়ে এটি রিভার এজ শিপিং এলএলসি হিসাবে নিবন্ধিত। এই দুই দেশের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই জাফর হাবিব নামে এক পাকিস্তানি সম্পৃক্ত। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলো বলছে, এই ব্যবসায়িক নেটওয়ার্কটি ট্রেড বেইজড মানি লন্ডারিংয়ের (টিবিএমএল) লক্ষ্যে এগোচ্ছে।
শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা
লিটন ও তার পরিবারের এই ব্যবসায়িক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে ঢাকার গণমাধ্যমে অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশিত হলে তিনি প্রতিবাদলিপি দেন। এতে তিনি দাবি করেন, সিবন্ড শিপিং নামক কোম্পানির সঙ্গে তার ও তার মেয়ের নাম উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যুক্ত করা হয়েছে; এটি সঠিক নয়। তবে দ্য মিরর এশিয়ার অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ২৩ মে সিবন্ড শিপিং লিমিটেডের ওয়েবসাইটের ডোমেইন নিবন্ধন করা হয়; বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত ওই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটের নিবন্ধন নেওয়া হয় দুবাইয়ের ঠিকানা দিয়ে জাফর হাবিব নামক এক ব্যক্তির নামে। চলতি বছরের ১১ জুন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের আগেও ওয়েবসাইটে পরিচালনা বোর্ডের সদস্যদের তালিকায লিটন ও তার মেয়ের ছবিসহ নাম ছিল। ওয়েবসাইটের আর্কাইভে দেখা গেছে, খবর প্রকাশের একদিন পর নাম ও ছবিগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
আরও পড়ুন: লিটন আর দুর্নীতি যেন একই সূত্রে গাঁথা
তবে ওই সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া প্রতিবাদলিপিতে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য খায়রুজ্জামান লিটন দাবি করেন, রাজশাহীতে একটি নদীবন্দর প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ‘রাজশাহী পোর্ট পিএলসি’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করেছিলেন। আমানা গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুল করিম লিটনের প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে থাকলেও এটি কোনোভাবেই আমানার সঙ্গে যুক্ত নয়। তবে মিরর এশিয়ার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভিন্ন চিত্র।
খায়রুজ্জামান লিটন ও তার মেয়ে আনিকা ফারিহা জামান শুধু একটি কিংবা দুটি কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত নন। মিরর এশিয়ার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, রাজশাহী পোর্ট পিএলসি ছাড়াও আরও ৪টি কোম্পানি রয়েছে যেখানে লিটন বা তার মেয়ে পরিচালক পদে ছিলেন। এসব কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের তালিকায় স্পষ্টভাবে সিবন্ড শিপিং লিমিটেডের নাম উল্লেখ রয়েছে। প্রতিটি কোম্পানিতে আমানা গ্রুপের কয়েকজন পরিচালক রয়েছেন। এছাড়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে দুটির পরিচালনা পর্ষদের তালিকায় রয়েছে আমানা ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেডের নাম।
বাংলাদেশ জয়েন্ট স্টক রেজিস্ট্রারের নথি অনুযায়ী, ৯ জন পরিচালক নিয়ে ‘সুলতানগঞ্জ পোর্ট পিএলসি’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। যার একজন লিটনের মেয়ে আনিকা ফারিহা জামান। তিনি এই কোম্পানির ২০,০০০ শেয়ারের মালিক। আমানা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদুল হক এই কোম্পানির একজন পরিচালক। আমানা ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেডের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে তালিকায় রয়েছে আবদুস সাত্তারেরও নাম। সুলতানগঞ্জ পোর্ট পিএলসির পরিচালনা পর্ষদে সিবন্ড শিপিং লিমিটেডের নামও রয়েছে, যার প্রতিনিধি খায়রুল বারী।
খায়রুজ্জামান লিটন ও তার মেয়ে আনিকা ফারিহা জামান পদ্মা ডিস্ট্রিপার্ক পিএলসি নামে আরেকটি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন। মেয়র লিটন ২২০০ শেয়ার নিয়ে এই কোম্পানির চেয়ারম্যান। এর সঙ্গে তার মেয়ের ১৬০০ শেয়ার রয়েছে। সাত সদস্যের পরিচালনা পর্ষদে থাকার পাশাপাশি আমানা গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুল করিম ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদুল হকের প্রত্যেকের এই কোম্পানি এক হাজার করে শেয়ার রয়েছে। সিবন্ড শিপিং লিমিটেডের অন্যতম পরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আবুল হোসেন ঈগল রিজ কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (বিডি) লিমিটেডের প্রতিনিধি হিসেবেও পরিচালক হয়েছেন।
এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বরেন্দ্র শিপিং লাইন্স পিএলসিরও চেয়ারম্যান। এই কোম্পানিতে তার শেয়ার রয়েছে ২২০০টি। লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আবুল হুসেন এখানেও ঈগল রিজ কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (বিডি) লিমিটেডের হয়ে সমান সংখ্যক শেয়ার নিয়ে পরিচালক হয়েছেন। আমানা গ্রুপের ফজলুল করিম ও আবু সাঈদ চৌধুরীও এ কোম্পানির পরিচালক।
দ্য মিরর এশিয়ার কাছে থাকা নথি অনুযায়ী, লিটনকন্যা আনিকা ফারিহা জামান ‘ইন্দো বাংলা লাইনস পিএলসি’ নামের আরেকটি কোম্পানির পরিচালক। আমানা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদুল হকের পাশাপাশি এ কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে আমানা ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেডের নাম রয়েছে। এখানে ৯ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদে সিবন্ড শিপিং লিমিটেডেরও নাম রয়েছে।
দ্য মিরর এশিয়ার অনুসন্ধানে আরেকটি নাম উঠে এসেছে; মো. শামসুজ্জামান। তিনি রাজশাহীতে আউয়াল নামে পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরে মেয়র লিটনের ব্যবসায়িক অংশীদার এই শামসুজ্জামান। তিনি রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধি হিসেবে এফবিসিসিআইয়ের একজন পরিচালক।
শামসুজ্জামানের মোবাইল নম্বরে গত কয়েকদিন ধরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। একাধিকবার চেষ্টা করলেও এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন ও তার মেয়ে ফোন ধরেননি। ফলে তাদের কারো কাছ থেকে বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন: ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে মেয়র লিটনের রহস্যময় ব্যবসায়িক সম্পর্ক
আরও পড়ুন: লিটন আর দুর্নীতি যেন একই সূত্রে গাঁথা