অনেক অবৈধ টাকার বিনিয়োগ হাব সাদিক অ্যাগ্রো
দেশের আলোচিত ছাগলকাণ্ডের লেজ ধরে একে একে বেরিয়ে আসছে দুর্নীতির সব চমকপ্রদ তথ্য। সরকারি বিধি নিষেধ উপেক্ষা করে বিদেশ থেকে উন্নত জাতের গরু আমদানি, টাকা পাচার, দেশের পশুর বাজার নিয়ন্ত্রণসহ নানা কর্মকাণ্ড চলতো আলোচিত সাদিক অ্যাগ্রোর আড়ালে।
সূত্র বলছে, সাদিক অ্যাগ্রোকে কেন্দ্র করে মূলত দেশের অবৈধ টাকার মালিকদের একটি সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। ওই সিন্ডিকেটের মধ্যে টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে অভিযান চালানো হয়।
সূত্র বলছে, সাদিক অ্যাগ্রোর মো.ইমরান হোসেনকে সামনে রেখে মূলত ব্যবসা করছে ওই সিন্ডিকেটটি। এতে যুক্ত রয়েছে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
ইতিমধ্যে বিতর্কিত পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী ও মাগুরা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখরের নাম প্রকাশ্যে এসেছে। এ ছাড়া পুলিশের বর্তমান উচ্চ পদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তার জড়িত থাকা নিয়েও গুঞ্জন চলছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু দেশ থেকে ইমরান বিভিন্ন জাতের গরু দেশে এনে চড়া দামে বিক্রি করছিলেন। এসব গরু আনতে সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেননি তিনি। এসব গরু আমদানি করা নিষিদ্ধ হওয়ায় কৌশলে কোনো উড়োজাহাজে করে দেশে আনার পর কোম্পানিটির কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত থাকত না। বিমানবন্দরে সেগুলা ঘুরে বেড়াত। পরে সেগুলো নিলামে তোলা হলে সাদিক অ্যাগ্রোই কম মূল্যে কিনে নিত। এভাবে পরিকল্পনা করে দেশে আমদানি নিষিদ্ধ গরু আনত সাদিক অ্যাগ্রো।
জানা গেছে, ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত সাদিক অ্যাগ্রো সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে গরু পাচার কারবারের সঙ্গে যুক্ত। দেশের প্রভাবশালীদের সহায়তায় এটি পরিচালনা করে আসছেন মো. ইমরান হোসেন। সম্প্রতি ইমরান মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে ১২টি গরুর একটি চালান দেশে নিয়ে আসেন। গরুগুলো থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার থেকে সংগ্রহের পর উখিয়া হয়ে নরসিংদীর শেখ ক্যাটল ফার্মে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে গরুগুলো ট্রাকে করে ঢাকার মোহাম্মদপুরে সাদিক অ্যাগ্রোতে নিয়ে আসা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে গরুগুলো বাংলাদেশে প্রবেশের সময় কক্সবাজারের হলুদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস সব সহযোগিতা করেন। গরুগুলো ঠিকভাবে বাংলাদেশে নিয়ে আসাকে সফল অভিযান আখ্যা দিয়ে ফেসবুক পেজে ধন্যবাদ দেওয়া হয়।
ঢাকা ক্যাটল ক্লাব ফেসবুক পেজে দেওয়া ওই স্ট্যাটাসে কমেন্ট করেন শেখ জেআর নামে এক ব্যক্তি। তিনি লেখেন, ‘যে ঝুঁকি নিয়ে আমরা এ কাজ করেছি এটা আপনার কারণে সম্ভব হয়েছে। আমরা অনেকেই নতুন স্বপ্ন দেখছি।’
জানা গেছে, অবৈধ পথে চোরাকারবারির মাধ্যমে দেশে পশু আনছেন ইমরান, অন্যদিকে সংবাদ সম্মেলন করে অবৈধ পথে পশু আমদানি না করতে নিষেধ করছেন। কোরবানির ঈদের আগে তিনি এমন প্রতারণার আশ্রয় নেন। আবার সম্প্রতি চোরাই পথে সীমান্ত দিয়ে রাজস্থান থেকে আটটি গরু আনেন ইমরান। এসব গরুর প্রতিটি ১২ থেকে ২০ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। অবৈধভাবে বিদেশ থেকে আনা এসব গরু চড়া দামে বিক্রি করছেন ইমরান।
প্রতিষ্ঠানটির সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং ম্যানেজার মোহাম্মদ মহিদুল ইসলাম জানান, গরুগুলো রাজস্থান থেকে আনা হয়েছে। সৌন্দর্য এবং বাহ্যিক গঠনের কারণে এসব গরু চড়া দামে বিক্রি করা হয়েছে।
জানা গেছে, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) বেনজীর আহমেদের গোপালগঞ্জের গরুর খামারটি প্রস্তুত করে দেন ইমরান। অবৈধভাবে সীমান্ত দিয়ে আনা বেশ কিছু গরু বেনজীরের খামারেও পাঠানো হয়। সাদিক অ্যাগ্রোতে বেনজীর আহমেদের বড় অঙ্কের আর্থিক বিনিয়োগ রয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার যোগসাজশে গরু চোরাচালানের মাফিয়া হয়ে ওঠেন ইমরান।
অভিযোগ রয়েছে, চোরাচালান বিষয়ে অন্য কোনো খামারের মালিক বা সংশ্লিষ্ট কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের বিভিন্ন মামলায় ফাঁসিয়ে দেন ইমরান। এ জন্য অনেকে মুখ বন্ধ রেখেছেন।
সূত্র জানায়, ফার্মটিতে কেবল বেনজীর ও শিখরই নন, বিনিয়োগ রয়েছে পুলিশ, রাজনীতিক, আমলাদেরও। সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল আজিজের পরিবারেরও এখানে বিনিয়োগে রয়েছে। মূলত অবৈধ অর্থ বিনিয়োগ নিয়ে বিরোধ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে সাদিক অ্যাগ্রোতে অভিযান চালানো হয়। অভিযান শুরুর পর সাদিকের স্বত্বাধিকার মো. ইমরান হোসেনের কথায় সেটা স্পষ্ট হয়েছে বলে মনে করে একাধিক সূত্র।
ফার্মটিতে কর্মরত বেশ কয়েকজন কর্মী অবৈধভাবে আনা গরুর বিষয়ে নানান তথ্য দিয়েছেন। তারা জানান, বিদেশ থেকে যেসব গরু আনা হয়, তার বেশিরভাগই রাখা হয় আমিনবাজার ১৬ নামের এলাকায় সাদিক অ্যাগ্রোর আরেকটি খামারে। সেখান থেকে সুযোগ বুঝে নেওয়া হয় বিভিন্ন খামারে। যদিও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, থাইল্যান্ড থেকে কোনো গরু বাংলাদেশে আনার সুযোগ নেই।
গত পাঁচ বছরে থাইল্যান্ড থেকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর গরু আমদানির কোনো অনুমোদন দিয়েছে কি না জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক ডা. মো. মাহবুবুল আলম ভূঞা বলেন, আমার জানা মতে এ ধরনের কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি। তবে এ নিয়ে আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি।
এর আগে ২০২১ সালে ১৮টি আমেরিকান ব্রাহামা জাতের গরু দেশে আনে সাদিক অ্যাগ্রো। সে সময় গরুগুলো প্রথমে ঢাকা কাস্টমস আটকের পর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাভারের কেন্দ্রীয় গো প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে রাখা হয়। পরে রহস্যজনকভাবে গরুগুলো চলে যায় ইমরানের দখলে।
গত ঈদুল আজহার আগে ব্রাহামা জাতের গরু বিক্রি করে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করেন ইমরান। তবে এসব গরু আমদানি ও বিক্রিতে প্রাণী সম্পদ বিভাগের কোনো অনুমোদন ছিল না বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্রাহামা জাতের গরু পালন জাতীয় প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন নীতিমালায় অনুমোদন নেই। ফলে এই জাত পালনের কোনো অনুমোদন আমরা দেইনি। অবৈধভাবে আনা ব্রাহামা গরুগুলো প্রজনন অনুপযোগী হওয়ায় নিয়ম অনুসারে সেগুলো গরু খামারিদের সংগঠনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কোনো ব্যক্তিকে দেয়া হয়নি। কিন্তু ইমরান কৌশলে এসব গরু নিজের নামে নিয়ে নিয়েছেন। আবার এসব গরু বাজারেও বিক্রির খবর এসেছে।