দুর্নীতি করে অঢেল সম্পদের মালিক উপ-পরিচালক মাহাবুব
দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ-পরিচালক মাহাবুবুল আলমের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, তিনি নামে-বেনামে গড়েছেন বহু সম্পদ। নিজের স্ত্রী, কন্যা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নামেও রয়েছে বহু স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ।
সূত্র জানায়, দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-২ এর উপ-পরিচালক মাহবুবুল আলম ২৮ বছর আগে পরিদর্শক হিসাবে চকুরি শুরু করেন। ২০২০ সালের শুরুতে দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে দুদকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে। প্রাথমিকভাবে তার অপরাধের সত্যতা পাওয়া গেলেও অদৃশ্য শক্তির বলে ঝুলে আছে তদন্তের অগ্রগতি।
জানা গেছে, দুদকে জমা দেওয়া অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রাথমিক তদন্তে মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মে যুক্ত হয়ে দুর্নীতিবাজদের অব্যাহতি দেওয়ার বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণের প্রমাণ মিলেছে। দুদকের তদন্তে দুর্নীতি, ঘুষ গ্রহণ; অনৈতিকভাবে অর্জিত অর্থে নিজের ছাড়াও স্ত্রী, মেয়ে এবং নিকটজনের নামে রাজধানীর শান্তিনগর ও রামপুরায় বহুতল ভবন, ফ্ল্যাট, দোকান, গাড়ি, বিভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ, বরগুনার আমতলী উপজেলায় নিজ গ্রামে কয়েক শ বিঘা জমিসহ অঢেল সম্পত্তি গড়ার অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া যায়।
সূত্র জানায়, এসব অভিযোগ বিষয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে অভ্যান্তরীণ অনুসন্ধান চালায় দুদক। তিন বছর অনুসন্ধান শেষে অধিকাংশ অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অনুসন্ধান প্রতিবেদনে প্রতিফলিত না হওয়ায় তৎকালীন পরিচালকের (বর্তমান মহাপরিচালক, বিশেষ অনুসন্ধান) নেতৃত্বে বিশেষ গোয়েন্দা টিমের মাধ্যমে এসব অভিযোগ বিষয়ে ফের তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।
ওই তদন্তেও মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে সব অভিযোগের প্রমাণ পায় বিশেষ গোয়েন্দা দল। অভিযোগ রয়েছে, ওই সময়ের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় এসব বিষয়ে মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি দুদক। এরপর ২০২১ সালে মাহবুবুল আলমের দুর্নীতির আরো একটি অভিযোগ জমা পড়ে কমিশনে।
আরো জানা যায়, একই ধরনের আরেকটি অভিযোগ জমা পড়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেও। ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে অভিযোগের সংশ্লিষ্ট নথি দুদকে পাঠিয়ে এ বিষয়ে তদন্তের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে তা অবহিত করতে বলা হয় দুদককে। পরে ওই অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের পরিচালক মুহাম্মদ ইউসুফকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মধ্যে মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে একই ধরনের আরেকটি অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে। অনুসন্ধান শেষে ২০২৩ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রতিবেদন দাখিল করেন তিনি।
২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল দুদকের নীতিনির্ধারণী সভায়ও মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়া ও দুর্নীতির অভিযোগ এবং এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা হয়। বিষয়টি সভায় উপস্থাপন করেন দুদক মহাপরিচালক (প্রশাসন) রেজওয়ানুর রহমান।
দুদক পরিচালক মুহাম্মদ ইউসুফের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, মাহবুবুল আলমের নামে দান ও কেনাসূত্রে ১৮টি দলিলে ৪৫৫ শতক জমি এবং ২০ লাখ ১ হাজার ৩০০ টাকা বিনিয়োগসহ ২৯ লাখ ৮৩ হাজার ৫৯১ টাকার অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। এ ছাড়া পটুয়াখালীর গলাচিপা আড়তপট্টিতে ছয়টি দোকান কিনেছেন তিনি। গ্রামে এক কোটি ৩ লাখ ৫১ হাজার টাকা মূল্যের কৃষি জমি রয়েছে তার। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, মাহবুবুল আলমের স্ত্রীর নামে ১৪টি দলিলে ৩৫৪ শতক জমি কেনার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ছাড়া একটি কোম্পানিতে পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করার কথা বলা হয়েছে। তার মেয়ের নামেও সাতটি দলিলে ১৪৫ দশমিক ৮৮ শতক জমি, ২৬ লাখ টাকার গাড়ি কেনা ছাড়াও পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগসহ অন্যান্য সম্পত্তি থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
ওই সভায় বলা হয়েছিল, প্রতিবেদনে প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি নিরপেক্ষভাবে অনুসন্ধান ও যাচাই করা হয়েছে মর্মে কমিশনের নিকট প্রতীয়মান হয়নি। এ ছাড়া অভিযোগের সব বিষয় অনুসন্ধান প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয়নি। তাই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা মোতাবেক বিশেষ সংস্থার মাধ্যমে এ বিষয়ে তদন্ত করা হবে। কমিশন মনে করছে মাহবুবল আলমের নামে-বেনামে এবং নিকটআত্মীয়ের নামে আরও সম্পত্তি থাকতে পারে।
এদিকে, উপ-পরিচালক মাহবুবুল আলমের বিরুদ্ধে দুদকে জমা পড়া এক অভিযোগে বলা হয়েছে, পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায় তার জমি ও তিনতলা একটি ভবন রয়েছে। এ ছাড়া বরগুনার আমতলীর সোনাখালী গ্রামে তার বসতবাড়িতে দুইতলা ভবন, পটুয়াখালীর পায়রাবন্দরের পাশে কলাপাড়ায় কয়েক শ বিঘা জমি, আমতলী উপজেলায় কয়েক শ বিঘা ধানী জমি ও তিনটি দীঘি, ঢাকার শান্তিনগরে তার টাকায় ভাগ্নি জামাই হাবিবুর রহমানের নামে সাততলা এবং রামপুরায় ছয়তলা ভবন রয়েছে।
এ ছাড়া, ঢাকার নয়াপল্টন এলাকায় চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী নামে ২০তলা মার্কেটে ভাগ্নি জামাই হাবিবুর রহমানের নামে শেয়ার, আমতলী উপজেলায় বাড়ি, হাবিবুর ও তার ছেলের নামে রিকন্ডিশন মোটর গাড়ির শো-রুম, মিরপুরে দীপ্তি আবাসন প্রকল্পের নিকট আত্মীয়ের নামে শেয়ার; যার মালিক দেখানো হয়েছে ফারুক মৃধা, নজরুল ইসলাম ও মশিউর রহমানসহ আরও কয়েকজনকে। মাহবুবুল আলমের বোন, বোনজামাই, ভাগ্নে-ভাগ্নি, শ্যালক ও শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের নামেও ঢাকা ও পাবনায় শত শত বিঘা জমি কিনেছেন বলে অভিযোগ। বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শত কোটি টাকার এফডিআর রয়েছে তার।
অভিযোগে জানা যায়, বরগুনার আমতলী উপজেলার একটি স্কুল ও কলেজে এডহক কমিটির সভাপতি পদ নিয়েও তিনি আইনবহির্ভূত প্রভাব খাটান। এসব অভিযোগ বিষয়ে তিন দফা প্রমাণ পেয়েও আজ অবধি উপ-পরিচালক মাহাবুবুল আলমের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করা যায়নি। অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে খোদ দুদককেও থেমে যেতে হচ্ছে।
এসব বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন সোমবার (১ জুলাই) দ্য মিরর এশিয়াকে জানিয়েছেন, তদন্তে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার পরও কেন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি তা আমার জানা নেই। তবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আইন অনুযায়ী তারা অবশ্যই আমল যোগ্য অপরাধে অপরবাধী।
অপর দিকে মাহবুুবুল আলমের বক্তব্য জানতে দ্য মিরর এশিয়া নানাভাবে চেষ্টা করেও সফল হয়নি। তার ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।