বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে অশনি সংকেত, বাড়তে পারে লোডশেডিং

নানামুখী চেষ্টার পরও স্বাভাবিক গতি ফিরছে না দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। সৌদি আরব ও কাতারের কাছ থেকে বাকিতে জ্বালানি তেল ক্রয়ের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, সে বিষয়েও কোনো ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। ফলে সামনের দিনগুলোতে এ খাতের সংকট আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকার পরও কেবল জ্বালানি সংকটের কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। ফলে প্রতিদিনই বাড়ছে বিদ্যুতের লোডশেডিং।

সূত্র বলছে, ২০২৩ সালে ডলার সংকটের কারণে দেশের বিদ্যুৎ খাতে সংকটের সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি সামলাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লা আমদানি কমিয়ে দেয় সরকার। ফলে বছর জুড়ে লোডশেডিং ছিল। সে সময়ের চেয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়ে খারাপ হয়েছে। যার প্রভাব ইতিমধ্যে দেখা দিয়েছে বিদ্যুৎ খাতে। রাজধানী ঢাকা ছাড়া দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহর ও গ্রামে লোডশেডিং অনেকটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে।

জানা গেছে, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বকেয়া দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এ কারণে বেসরকারি উৎপাদনকারীরা ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে পারছে না।

গত বছর এমন সংকট থাকলেও চলতি বছরে তা আরো বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, বর্তমানে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ রয়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলার। যা দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। রিজার্ভের ধারা এভাবে থাকলে আমদানি চাপে থাকবে। অর্থাৎ বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করতে পারবে না সরকার।

ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, পরিস্থিতি সামলাতে প্রথমে সৌদি আরবের কাছ থেকে বাকিতে জ্বালানি তেল কেনার প্রস্তাব দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। এ ছাড়া এপ্রিলের শেষ দিকে ঢাকা সফরে এলে কাতারের আমিরের কাছেও বাকিতে তেল বিক্রির পস্তাব দেওয়া হয়।

যদিও সরকারের সে প্রস্তাবে এখনো পর্যন্ত কোনো সাড়া দেয়নি মধ্য প্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ এ দেশ দুটি। এ অবস্থায় সহসাই দেশের বিদ্যুৎ খাতে কোনো সুখবর আসছে না বলে মনে করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, দেশে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আছে। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা।

গত ডিসেম্বরে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থ ঘাটতি ও আমদানিকারক এবং সরকারের কাছে অর্থ বকেয়া থাকায় জাহাজ ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত হাই সালফার ফুয়েল অয়েল (এইচএসএফও) আমদানি কমিয়ে দিয়েছে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল।

বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সাবেক সভাপতি ইমরান করিমের উদ্ধৃতি দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ প্রায় ৩৫ লাখ টন ১৮০-সিএসটি এইচএসএফও আমদানি করবে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ৯ শতাংশ কম।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডলার ঘাটতির কারণে জ্বালানি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ঋণপত্র খুলতে পারছে না স্থানীয় ব্যাংকগুলো। ব্যাংকগুলো বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ও খুচরা যন্ত্রাংশ ক্রয় সম্পর্কিত ঋণপত্র নিষ্পত্তি করতে হিমশিম খাচ্ছে।

এ অবস্থায় জ্বালানি আমদানি খাতে ডলার পাওয়ার বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফয়সাল খান।

তিনি বলেন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরা আশা করি, মার্কিন ডলারের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

২০২৪ সালে সরকারকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির শর্তের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানির স্বয়ংক্রিয় মূল্য প্রবর্তন করতে হবে বলেও মনে করেন এ বিশেষজ্ঞ।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণী কাঠামোতে যাওয়ার অংশ হিসেবে স্থানীয়ভাবে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা মূল্যস্ফীতি আরও বাড়াতে পারে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি রেকর্ড স্তরে পৌঁছেছে এবং কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।