লিটনে বলীয়ান ভারতীয়দের অর্থ অস্ত্র ও মাদক পাচার, হুন্ডির কারবার
নির্মাণকাজে ব্যবহৃত পাথর ভারত থেকে বাংলাদেশে আনতে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসের শুরুতে ব্যাংকের ঋণপত্র (এলসি) খোলে জেএইচএম ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি। পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্ত স্থলবন্দর পেরিয়ে সেই দফায় ৩৯৮ মেট্রিক টন স্টোন চিপস আনার কথা ছিল। কিন্তু ২০ অক্টোবর তার চেয়ে অনেক কম পাথর আসে দেশে। কাগজে-কলমে সব ঠিক থাকলেও ‘জেসিডি২পিজেড৪বিও২জিএনএল’ নম্বরের বিল অব ল্যান্ডিংয়ে কম পণ্য আসে। তবে মূল্য পরিশোধ করতে হয় বেশি পণ্যের। বিষয়টি খুব সহজ হওয়ার কারণ ভারতে পণ্য রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ছিলো জেএইচএম এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট লিমিটেড, যেটি জেএইচএম গ্রুপেরই আরেকটি প্রতিষ্ঠান।
দ্য মিরর এশিয়ার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ২০১৯ ও ২০২০ সালে দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি ব্যবসার নামে অর্থপাচার করেছে জেএইচএম গ্রুপ। এটি ভারতে প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমানে বাংলাদেশ হয়ে দুবাই পর্যন্ত সক্রিয়। এই গ্রুপটির প্রায় ৫০টি আমদানি-রফতানির তথ্য নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে দ্য মিরর এশিয়া নিশ্চিত হয়েছে যে, বাংলাদেশ থেকে ভারতের অর্থপাচারের পাশাপাশি ভারত থেকে বাংলাদেশ হয়ে দুবাইয়েও অর্থপাচার করেছে কোম্পানিটি।
মেয়র লিটনের পরিবারে আলাদিনের চেরাগ-১: এক বছরেই ছয় প্রতিষ্ঠানের মালিকানা
মেয়র লিটনের পরিবারে আলাদিনের চেরাগ-২: ভারতীয় নাগরিকের সঙ্গে মেয়র লিটনের রহস্যময় ব্যবসায়িক সম্পর্ক
মেয়র লিটনের পরিবারে আলাদিনের চেরাগ-৩: লিটন আর দুর্নীতি যেন একই সূত্রে গাঁথা
বাংলাদেশে এই পুরো প্রক্রিয়ায় জেএইচএম গ্রুপকে প্রত্যক্ষ সহায়তা করেছেন দুজন ব্যক্তি- একজন চট্টগ্রামের মেহেদী হাসান বিপ্লব আর অন্যজন রাজশাহীর মুখলেসুর রহমান মুকুল। এদের মধ্যে মুকুল বেনাপোল, সোনামসজিদ, হিলি ও ভোমরা স্থলবন্দরের দায়িত্বে ছিলেন। এই বন্দরগুলো দিয়ে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচারের (টিবিএমএল) যাবতীয় প্রক্রিয়া জেএইচএম গ্রুপের পক্ষে সম্পন্ন করেন তিনি।
অপরাধ জগতে রাজশাহী অঞ্চলের হুন্ডি সম্রাট বলে পরিচিত এই মুখলেসুর রহমান মুকুল ওরফে হুন্ডি মুকুলকে নেপথ্যে থেকে শকিত জোগান রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (রাসিক) মেয়র ও শাসক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। তিনি মুকুলের প্রতিষ্ঠানকে রাসিকে’র বহু উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজ দিয়ে আসছেন। এ ছাড়া লিটনের বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিত রাজশাহী-৩ আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান আসাদ মধ্যস্থতা করে রাজশাহীর বালুমহালের কাজ পাইয়ে দিয়েছেন হুন্ডি মুকুলকে। ফলে এ অঞ্চলে যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বালু সরবরাহ করে চলেছেন এ হুন্ডি ব্যবসায়ী।
এ অঞ্চলের আরেক হুন্ডি ব্যবসায়ী আতিকুর রহমান কালু। তিনি শুধু খায়রুজ্জামান লিটনের ঘনিষ্ঠ নন, তার দলেরও একজন বড় নেতা। রাজশাহী নগরীর একমাত্র গরুর হাটের ইজারাদার এই কালু, যার বিরুদ্ধে অতি সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনেছে। লিটন নগরীর রাণীবাজার এলাকায় এই কালুর ভবনে তার নিজের রাজনৈতিক কার্যালয় বানিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের এ প্রেসিডিয়াম সদস্য দুদকের হাত থেকে কালুকে রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
জেএইচএম, হুন্ডি মুকুল আর গরু এনামুল ট্রিলজি
দ্য মিরর এশিয়ার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে হুন্ডি ব্যবসার মূল চক্রের হোতা ভারতীয় নাগরিক তিন ভাইয়ের নাম। উঠে আসে জেএইচএম নামের একটি কোম্পানির নাম। এই প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান। পরিচালক হিসেবে আছেন তারই দুই ভাই জাহাঙ্গীর আলম ও হুমায়ূন কবির। অর্থপাচারের অভিযোগের কারণে ৬ বছর ধরে তারা নিজের দেশে প্রবেশ করতে পারেন না বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। ফলে তারা দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে অবস্থান করেছেন। পরবর্তীতে তারা দুবাইয়ে পালিয়ে যান। বর্তমানে সেখানে বসবাসের পাশাপাশি তারা ব্যবসা করছেন।
ভারতের সিআইডি ও ইডি সূত্রে জানা যায়, জেএইচএম গ্রুপের এ তিন ভাই তাদের দেশে গরু চোরাচালান ও অর্থপাচারের দায়ে বিচারাধীন আসামি এনামুল হকের ভাতিজা। এনামুল হকের একটি ব্যবসায়িক কোম্পানি রয়েছে, যার নাম হক গ্রুপ। এই হক গ্রুপের সঙ্গেও সম্পৃক্ততা রয়েছে রাজশাহীর অর্থপাচারকারী মুখলেসুর রহমান মুকুলের। বাংলাদেশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও এই মুকুলের নাম অর্থপাচারকারী হিসেবে উঠে এসেছে। তবে খায়রুজ্জামান লিটনের ছত্রছায়ায় থাকার কারণে তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি দেশের কোনো সংস্থা।
২০২০ সালের আগস্টে ঢাকার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার আড়ালে চলছে জেএইচএমের অর্থপাচার ও অবৈধ কারবার। ভারতের মুর্শিদাবাদের নাগরিক মেহেদী হাসানসহ তিন ভাই ও তাদের মামা এনামুল হকের ছত্রছায়ায় ভারত ও বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে হুন্ডি, মাদক ও অবৈধ অস্ত্রপাচারের একটি বিশাল নেওয়ার্ক। সেই নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়ে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের কয়েকজন শূন্য থেকে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। মুখলেসুর রহমান মুকুল তাদের একজন।
২০১৮ সালের ২৯ মার্চ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের স্পেশাল ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট শাখার তৎকালীন অতিরিক্ত ডিআইজি রেজাউল করিমের সই করা চিঠিতে রাজশাহী অঞ্চলজুড়ে গড়ে ওঠা এই হুন্ডি ও মাদক চোরাকারবারিদের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবগত করা হয়। এ ছাড়া ২০১৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন পরিচালক (যুগ্ম সচিব) ফরিদ আহম্মদ স্বাক্ষরিত আরেক চিঠিতে এ চোরাকারবারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সবুজ সংকেত না পেয়ে এ চক্রের প্রভাবশালী হোতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কারণ এ চক্রের সদস্যদের অনেকে ভিড়ে গেছেন স্থানীয় রাজনীতিতে। কেউ কেউ অবৈধ টাকা বৈধ করার জন্য নেমেছেন ঠিকাদারি ব্যবসায়। এদের মধ্যে অন্যতম মুখলেসুর রহমান মুকুল।
জানা গেছে, জেএইচএমের অন্যতম সহযোগী রাজশাহীর মুখলেসুর রহমান মুকুলকে নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, একসময় তিনি ছিলেন মুদি দোকানদার। মুদি দোকান ছেড়ে জেএইচএমের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন তিনি। মুকুল একটি ফেসবুক পোস্টেও নিজেই সেই তথ্য তুলে ধরেন। তাতে তিনি জেএইচএম গ্রুপকে তাদের কোম্পানি বলে দাবি করেন। এখন তিনি গাড়ি, বাড়িসহ অগাধ সম্পদের মালিক। মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনের মাধ্যমে রাজশাহী নগর সংস্থার বিভিন্ন উন্নয়নকাজের ঠিকাদারিও তার দখলে।
জানা গেছে, মুকুল তার প্রতিষ্ঠান ‘মুন এন্টারপ্রাইজ’-এর নামে ভারত থেকে যেসব পাথর ও পেঁয়াজ আমদানির করেন তার অন্তত ৯৯ শতাংশই হলো জেএইচএম ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট প্রাইভেট লিমিটেড ও এমএস হক মার্কেন্টাইল প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা হলো কলকাতার এম কে পয়েন্ট ফোর্থ ফ্লোর ও সিক্সথ ফ্লোর, বেনটিক স্ট্রিট। এম এস হকের মালিক জেএইচএমের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসানের মামা এনামুল হক। সম্প্রতি ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদকপাচার, অবৈধ অর্থ লেনদেনসহ বিভিন্ন অভিযোগে এনামুলকে গ্রেপ্তার করেছে। আর মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগের তদন্ত চলছে। এসব বিষয়ে তদন্তের অনুরোধ জানিয়ে ২০১৯ সালের ১৭ মার্চ ভারতের ডাইরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স শাখা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে একটি চিঠি দেওয়া হয়।
একটি গাড়ি ও কোটি টাকার কাজ
রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশন সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মুখলেসুর রহমান মুকুলের প্রতিষ্ঠান মুন এন্টারপ্রাইজ আরসিসি’র এক শ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজের দরপত্র পেয়েছে। আরসিসি’র একাধিক সূত্র জানায়, সংস্থাটিতে দরপত্রের ক্ষেত্রে আইনগত প্রক্রিয়া কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। অভিযোগ আছে, বিপুল আর্থিক কমিশনের বিনিময়ে পছন্দের ঠিকাদারদের নির্ধারিত কাজ পাইয়ে দেন স্বয়ং মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন।
মেয়র লিটনের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মী আসাদুজ্জামান আসাদ, যিনি রাজশাহী-৩ আসনের সংসদ সদস্য, প্রধানত মুকুলের সঙ্গে লিটনের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্যস্থতাকারী। লিটন ও আসাদ প্রভাব খাটিয়ে আওয়ামী লীগের পূর্বের বলয়কে টেক্কা দিয়ে মুকুলের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মুন এন্টারপ্রাইজকে রাজশাহীর তিনটির মধ্যে দুটি বালুমহাল ইজারা পাইয়ে দেন। ফলে রাজশাহীর সব উন্নয়ন কাজে বালু সরবরাহ এখন এচেটিয়াভাবে মুকুলের নিয়ন্ত্রণে।