সাবেক চেয়ারম্যানের অপকর্মের পাহারাদার পাভেল আরও প্রতাপশালী

ফজলুল জাহিদ পাভেল

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সব কাজের যেন কাজির দায়িত্ব পালন করছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব (পিএস) ফজলুল জাহিদ পাভেল। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে তৎকালীন চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের একান্ত সচিব হয়েছিলেন সরকারের এই উপসচিব। তখন থেকে খয়ের খাঁ হিসেবে ইকবাল মাহমুদের সব ধরনের কাজেরই দেখভাল শুরু করেন পাভেল। ইকবাল মাহমুদ অবসরে গেলেও পাভেল রয়েছেন বহাল তবিয়তে। যদিও প্রশাসন ক্যাডার থেকে প্রেষণে যোগ দেওয়া কোনো কর্মকর্তাই ৩ বছরের বেশি একই দায়িত্বে থাকতে পারেন না।

২০২১ সালের ৯ মার্চ ইকবাল মাহমুদ অবসরে চলে যান। তার মেয়াদের শেষ ৫ মাসে অন্তত ২ শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে নানা সুবিধা ও ঘুষের বিনিময়ে দায়মুক্তি দিয়ে যান। দায়মুক্তি পাওয়া ওইসব ব্যক্তির নাম-ঠিকানাসহ তালিকা ২০২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারী এমন ৪০৮ টি নথি দাখিল করার নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। আদালতের নির্দেশে দায়মুক্তি পাওয়া ওই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই পুনরায় তদন্তের মাধ্যমে মামলা দায়ের করা হয়। এ সব মামলাই তদারকি করেন পাভেল।

এর বিনিময়ে চেয়ারম্যান থাকাকালে ইকবাল মাহমুদের কাছ থেকে ফজলুল জাহিদ পাভেল গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কিনেছেন একাধিক বাড়ি। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় কলেজ শিক্ষিকা স্ত্রীর নামে রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট, বেশ কয়েকটি ব্যাংকে রয়েছে নগদ টাকা। শেয়ার বাজারেও বেনামে বিনিয়োগ করেছেন কয়েক কোটি টাকা। কথিত আছে, ইকবাল মাহমুদের আমলে পাভেলের ইশারার বাইরে কিছুই হতো না।

এসব মামলার দেখাশুনার জন্যই অবসরে যাওয়ার আগেই চতুর ইকবাল মাহমুদ বিশ্বস্ত ব্যক্তিগত সহকারী ফজলুল জাহিদ পাভেলের দুদকের চেয়ারটি মজবুত করে যান। যাতে চাইলেই পাভেলকে দুদক প্রশাসন ক্যাডারে ফেরত পাঠাতে না পারে।

ইকবাল মাহমুদের পর দুদকের চেয়ারম্যান হয়ে আসেন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। ফজলুল জাহিদ পাভেল কৌশলে বর্তমান চেয়ারম্যানের সঙ্গেও থেকে যান। তিনি নতুন চেয়ারম্যানের পিএস নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত পিএসের প্রক্সি দিচ্ছিলেন। পরে উপ-সচিব মো. আল-মামুন দুদক চেয়ারম্যানের পিএস হিসেবে নিয়োগ পান। এর পরেও রহস্যজনকভাবে পিএস হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে যান ফজলুল জাহিদ পাভেল।

দুদকের তিন সদস্যের কমিশনের অর্গানোগ্রামে তিনজন পিএসের পদ থাকলেও পাভেলসহ বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন চারজন। মো. আল-মামুন পিএস হিসেবে যোগদানের আগে পাভেল বর্তমান চেয়ারম্যানের পিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মামুন যোগদানের পরও তিনি পিএসের পদ ছাড়েননি। অনুসন্ধান ও তদন্ত-৭-এর পরিচালক হিসেবে দুদক প্রধান কার্যালয়ের গ্যারেজ ভবনে তার সুপরিসর কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে সেখানে খুব কমই বসেন তিনি।

পর্ব-১: দুর্নীতি করে অঢেল সম্পদের মালিক উপ-পরিচালক মাহাবুব

দুদক সূত্র জানায়, অফিসিয়াল পদবি যাই থাকুক না কেন, ফজলুল জাহিদ পাভেলের মূল কাজ হচ্ছে পূর্বতন চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি দেখভাল করা। ইকবাল মাহমুদের দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও বিতর্কিতভাবে সম্পাদিত নথিগুলো পর্যবেক্ষণে রাখা।

অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান চেয়ারম্যানের পিএস হিসেবে থাকলেও তিনি দুদক এবং দুদক চেয়ারম্যানের সার্বিক কার্যক্রমের নিয়মিত ‘আপডেট’ দেন ইকবাল মাহমুদকে। এ কারণে ইকবাল মাহমুদের অনেক দুর্নীতি-অনিয়মের নথিতে হাত দিতে কেউ সাহস করেন না।

বর্তমান চেয়ারম্যানের পিএস মো. আল-মামুন সম্প্রতি যুগ্ম-সচিব হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেছেন। অন্য একটি সরকারি দপ্তরে তার পদায়নও হয়েছে। কিন্তু কমিশনকে ‘ম্যানেজ’ করে তিনিও চেষ্টায় আছেন ‘মহাপরিচালক’ হিসেবে দুদকেই থেকে যেতে। অন্যদিকে, এই চেয়ারে স্থায়ীভাবে বসতে উন্মুখ পাঁচ বছর আগে দুদকে প্রেষণে আসা পরিচালক ফজলুল জাহিদ পাভেল। এজন্য তিনি ক্ষমতার বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগও চালিয়ে যাচ্ছেন।

দুদকে যোগদানের আগে ফজলুল জাহিদ পাভেলের বিরুদ্ধে রয়েছে বহু অভিযোগ। ২০১৪ সালে খাগড়াছড়ি জেলার দিঘিনালা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। এসময় ৮১টি বাঙালি গুচ্ছগ্রাম ছিল খাগড়াছড়ির দিঘিনালায়। গ্রামগুলোতে রেশন কার্ডধারী মানুষ ছিলেন ২৬ হাজার। তাদের সঞ্চিত অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে খাগড়াছড়ির দিঘিনালার তৎকালীন উপজেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ ছিল, স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ কর্মকর্তারা পরিকল্পিতভাবে ‘গুচ্ছগ্রামভিত্তিক প্রকল্প-সভাপতি’ নিয়োগে ব্যাপক ঘুষ-বাণিজ্য করেছেন। ২ লাখ টাকা নিয়ে তখন ‘গুচ্ছগ্রামভিত্তিক প্রকল্প-সভাপতি’ নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ পাওয়া প্রকল্প সভাপতিরা রেশন কার্ডধারীদের ওজনে কম দেওয়া ও পঁচা চাল রেশন হিসেবে সরবরাহ করেন।

পর্ব-২: পরিচালক ফানাফিল্যার শত কোটির বাড়ি, উপ-পরিচালক আবু বকরের সিন্ডিকেট বাণিজ্য

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পদে থেকে প্রকল্প-সভাপতি নিয়োগের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সেই অভিযোগটি সময়ের শ্যাওলায় ঢাকা পড়ে যায় ইকবাল মাহমুদের ইশারায়। খাগড়াছড়ির গুচ্ছগ্রামের দরিদ্রদের রেশন নিয়ে যে নয়-ছয় হয়েছে সেটির গতানুগতিক জবাব ছাড়া তিনি তেমন কিছুই দেননি। তার বিষয়ে ন্যূনতম একটি অনুসন্ধানও ইকবাল মাহমুদ কমিশন করেননি।

এদিকে, কমিশনের অন্য কর্মকর্তাদের বসার স্থান সংকুলান না হলেও চেয়ারম্যানের ‘খাস লোক’ হওয়ার দাপটে একাই কব্জায় রেখে দিয়েছেন দুটি কক্ষ। নির্ধারিত কক্ষের পরিবর্তে সারাক্ষণ অবস্থান করেন মূল ভবনের ৫ তলাস্থ ‘রেডব্লক’ এ চেয়ারম্যান দফতর সংলগ্ন কক্ষে।

কথা বলতে কয়েক দফা ফজলুল জাহিদ পাভেলের কক্ষে গেলেও প্রতিবারই কক্ষ বন্ধ পাওয়া যায়। এসব বিষয়ে সোমবার তার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মোবাইলে ‘কল’ দেওয়া হয়। তিনি রিসিভ করেননি।

দুদক সূত্রে জানা যায়, শুধু ফজলুল জাহিদ পাভেল নন, প্রশাসন ক্যাডার থেকে ডেপুটেশনে আসা পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ, পরিচালক উত্তম কুমার মন্ডল, আব্দুল আউয়ালও ৫-৬ বছর ধরে দুদকে পড়ে আছেন। তাদের প্রত্যেকের যুগ্ম-সচিব হিসেবে পদোন্নতি হলেও পড়ে আছেন দুদকেই। তারা কেউই সরাসরি অনুসন্ধান-তদন্ত করছেন না। তাদেরকে কোনো মামলার বাদী হতেও দেখা যায় না।

‘তদারককারী কর্মকর্তা’ হিসেবে এদের অনেক গাফিলতির অভিযোগ দুদকে পড়ে আছে। প্রমাণও মিলেছে সবগুলোর। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত বা ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না। পদোন্নতি পেয়েও কী অদৃশ্য মোহে তারা নিম্নতম পদে পড়ে আছেন দুদকে? এ নিয়ে খোদ দুদকেই নানান কানাঘুষা আছে।

এসব বিষয়ে নিয়ে কথা হয় দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের সঙ্গে। তিনি দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, ‘এ ধরনের দৃষ্টান্ত যদি দুদকেই হয়ে যায় সেটি দুদককে মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য করে তুলবে। মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গেলে এই প্রতিষ্ঠানটিও কিন্তু অকার্যকর হয়ে পড়বে।’ এদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেন সাবেক এই চেয়ারম্যান।

পর্ব-১: দুর্নীতি করে অঢেল সম্পদের মালিক উপ-পরিচালক মাহাবুব

পর্ব-২: পরিচালক ফানাফিল্যার শত কোটির বাড়ি, উপ-পরিচালক আবু বকরের সিন্ডিকেট বাণিজ্য