কেন কোটা আন্দোলন, শুরুটা হয়েছিল কীভাবে

২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন/সংগৃহীত ছবি

দেশে বর্তমানে শিক্ষার্থীদের একটি আন্দোলন চলছে। যাকে তারা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহালে গত ৫ জুন হাইকোর্টের রায়ের পর এই আন্দোলনের শুরু।

বিষয়টি এখন উঠেছে আপিল বিভাগে। সেখানেও প্রাথমিকভাবে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সরব রাজপথ। দেশের প্রায় সবকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই কোটা বাতিলের আন্দোলন চলছে।

বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য ইতিহাস রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই কয়েকটি বিশেষ গোষ্ঠী চাকরিতে প্রবেশে কোটা সুবিধা পেয়ে আসছিল।

২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা নির্ধারিত ছিল। অর্থাৎ, প্রতি ১০০ জনে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ পেতেন ৪৪ জন। বাকি ৫৬ জন আসতেন মুক্তিযোদ্ধার পরিবার, অনগ্রসর জেলা, নারী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কিংবা প্রতিবন্ধীদের মধ্য থেকে।

যাদের মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি আসতেন মুক্তিযোদ্ধার প্রজন্মরা; তারা পেতেন ৩০ শতাংশ কোটা। এর বাইরে ১০ শতাংশ নারী কোটা, ১০ শতাংশ জেলা কোটা, ৫ শতাংশ কোটা ছিল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য এবং এক শতাংশ কোটা ছিল প্রতিবন্ধীদের।

এমন ব্যবস্থাকে চরম বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে ২০১৮ সালে দানা বেঁধেছিল কোটাবিরোধী আন্দোলন। ২০১৮ সালের ওই আন্দোলন সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে নাড়া দিয়েছিল। তখন কোটা বাতিলে একরকম বাধ্য হয়েছিল সরকার।

তখনকার সেই আন্দোলনকে যদিও কোটা বাতিলের আন্দোলন বলা হচ্ছিল না। আন্দোলনকারীরা এটিকে বলছিলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন। তারা মূলত কোটার সংস্কার চাচ্ছিলেন। সংখ্যার বিচারে ছোট জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশই যদি কোটা থাকে, সেখানে সাধারণরা ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন জানিয়ে তারা আন্দোলন করছিলেন।

নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান

কোটাভিত্তিক নিয়োগনীতি সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালের শুরু থেকে আন্দোলন চলছিল। তখন পর্যন্ত এ আন্দোলনটি ছিল ক্ষুদ্র ও অনেকটা অসংগঠিত। তাই সরকার প্রথমে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। তবে সব সমীকরণ উল্টে দিয়ে আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে।

সে বছরের ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে ৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বিশাল মিছিল নিয়ে বের হন। তারা টিএসসি-নীলক্ষেত-কাঁটাবন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে জমায়েত হন শাহবাগ মোড়ে। চৌরাস্তার সংযোগস্থলে জড়ো হয়ে তারা যান চলাচল বন্ধ করে দেন।

ওই সময় আন্দোলনকে বেগবান ও সফল করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের শাখা গঠিত হয়। এ আন্দোলন শেষেও তাদের কার্যক্রম চোখে পড়ে। পরবর্তীতে সেখান থেকেই গড়ে ওঠে ছাত্র অধিকার পরিষদ ও গণঅধিকার পরিষদ নামে নতুন রাজনৈতিক সংগঠনের।

ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলা

আন্দোলনের শুরু থেকেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে বাধা প্রদান করে এসেছে। যা এখনও দেখা যাচ্ছে। নতুন করে যখন কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের হামলার খবর আসছে। যেটি আরও বেশি হয়েছিল ২০১৮ সালে।

তখন চাকরির বাজারে অস্থিরতা, হতাশা আর ক্ষোভ থেকেই কোটা সংস্কার আন্দোলন দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিস্তৃত হয়েছিল। ছাত্রলীগের আক্রমণ, পুলিশের মামলা ও নির্যাতন, আদালতের রিমান্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ- যুক্তিসঙ্গত আলোচনার বাইরে এসবের মাধ্যমে ওই আন্দোলনকে দমানোর চেষ্টা হয়েছিল।

সে বছরের ৮ এপ্রিল বিকেল ও রাতে পুলিশ ও ছাত্রলীগের মুখোশধারীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালিয়েছিল। নারী শিক্ষার্থীদের নিপীড়নের অভিযোগও উঠেছিল। দফায় দফায় আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ও আবাসিক হলসহ বিভিন্ন স্থানে নিপীড়ন করেছিল ছাত্রলীগ। যেটি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়েই হয়েছিল।

ওই সময় শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল পাঁচটি। ভালোভাবে লক্ষ্য করলে তাদের কোনো দাবিই আসলে পূরণ করেনি সরকার। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল- কোটা ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া, সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ, কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ পরীক্ষা না রাখা ও চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় একাধিকবার কোটার সুবিধা ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করা।

যদিও তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোনো কোটা না রাখার ঘোষণা দেন। পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের চাকরিতে কোটা বিলুপ্ত করে পরিপত্র জারি করা হয়। তখন পাঁচটি দাবির কোনোটিই না মেনে কৌশলে আন্দোলন থামিয়ে দিতে সফল হয়েছিল সরকার।

ডাকসু নির্বাচনেও কোটার ঢেউ

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে জোরদার করতে ২০১৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শাহবাগে পাব্লিক লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। যেখান থেকে ছাত্ররাজনীতিতে উঠে আসে নুরুল হক নুর, রাশেদ খাঁন, ফারুক হোসেন, আখতার হোসেনসহ বেশ কয়েকটি নাম। যদিও এই সংগঠনের নেতাকর্মীদের অনেকেই আজ দ্বিধাবিভক্ত।

কোটা আন্দোলনের এক বছর পরই হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। দীর্ঘ ২৮ বছর পর হওয়া এ নির্বাচনেও কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রভাব দেখা যায়। সাধারণ ছাত্রদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা কোটা সংস্কার আন্দোলনের অনেকেই ডাকসু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

২০১৯ সালের এ নির্বাচনের জন্য কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ  প্যানেল ঘোষণা করে। পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নুরকে ভিপি (সহসভাপতি), যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ রাশেদ খাঁনকে জিএস (সাধারণ সম্পাদক) ও আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হোসেনকে এজিএস (সহসাধারণ সম্পাদক) করে ডাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদে আংশিক প্যানেল ঘোষণা করা হয়।

এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের বাইরে থেকে ছাত্র অধিকার পরিষদের নুর ভিপি পদে ও আখতার হোসেন সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে জয়ী হন।

ফের কোটাবিরোধী আন্দোলন

২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরে পাওয়ার জন্য উচ্চ আদালতে রিট করেন। যে রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ জুন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট।

হাইকোর্টের ওই রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। গত বৃহস্পতিবার সকালে কোটার পক্ষের এক আইনজীবীর আবেদনের প্রেক্ষিতে শুনানি করেনি আদালত।

সুতরাং, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের এই রায় স্থগিত না করায় পূর্বের নিয়মানুযায়ী সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা আপাতত বহাল থাকছে। হাইকোর্টের ওই রায়ের পর গত ৬ জুন থেকেই তা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা।

তবে কিছুদিন আন্দোলন চললেও মুসলমানদের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা চলে আসায় ২৯ জুন পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত রাখেন শিক্ষার্থীরা। এরপর গত ৩০ জুন থেকে ফের আন্দোলন শুরু করেন তারা। ১ জুলাই থেকে এই আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

দেশের কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই আন্দোলন চলেছে। এতে করে ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে ঘণ্টাব্যাপী তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।

শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, তাদের সকল দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এই কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। তবে শুক্রবার (৫ জুলাই) ছুটির দিন হওয়ায় আন্দোলন কিছুটা বন্ধ রয়েছে। যদিও এদিনও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মানববন্ধন করেছেন।

এখন যে দাবি শিক্ষার্থীদের

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এখন ২০১৮ সালে জারি করা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র বহাল চাইছেন। এর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দাবির মধ্যে আরও রয়েছে- পরবর্তী সময়ে সরকার কোটাব্যবস্থা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে চাইলে ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল রেখে কমিশন গঠন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দেওয়া।

এছাড়া সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা; চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করা, কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া এবং দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।

অর্থাৎ, ২০১৮ সালে যেসব দাবিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল, সেই দাবিগুলোই সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঘুরেফিরে আসছে।