নাবিল গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির ‘নাটের গুরু’ লিটন
ইসলামী ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির মূল হোতা নাবিল গ্রুপের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। দ্য মিরর এশিয়ার অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (আরসিসি) মেয়র লিটনের ছত্রছায়ায় নাবিল গ্রুপ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। শুধু লিটনই নয়, নাবিল গ্রুপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে তার ব্যবসায়িক অংশীদার এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক শামসুজ্জামান আউয়ালেরও।
গত ৭ জুলাই ঋণ জালিয়াতির ঘটনা তদন্তে নাবিল গ্রুপের ১১টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই চিঠিতে সাত কর্মদিবসের মধ্যে ঋণ কেলেঙ্কারির তথ্য জানাতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এবং পর্যাপ্ত সম্পত্তি বন্ধক ছাড়াই নাবিল গ্রুপ রাজশাহী অঞ্চলে ইসলামী ব্যাংকের তিনটি শাখা থেকে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, এর নেপথ্যে সহায়তা করেছেন খায়রুজ্জামান লিটন। ঋণের ওই অর্থের একটি অংশ লিটন-আউয়ালের পকেটেও গেছে।
নাবিল গ্রুপের সঙ্গে লিটন-আউয়াল জুটির ব্যবসায়িক সম্পর্ক প্রথম প্রকাশ পায় ২০২১ সালে। ওই বছর রাজশাহী শহরের লক্ষীপুর এলাকায় অবস্থিত ২১৮ কাঠার পুকুর সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি ব্যবহার করে ভরাট করা হয়। ২০২২ সালে পুকুরটির শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়। সে সময় জানা যায়, লিটন-আউয়াল জুটি এই জমিতে একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের জন্য নাবিল গ্রুপের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন।
খায়রুজ্জামান লিটনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক এক শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, নাবিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আমিনুল ইসলাম স্বপনের সঙ্গে মেয়র লিটনের ঘনিষ্ঠতার কথা তারা দীর্ঘদিন ধরেই জানেন। তবে তাদের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে কি-না তা নিশ্চিত নন তিনি। খায়রুজ্জামান লিটনকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে এবং কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে সক্রিয় রাখতে আমিনুল ইসলাম স্বপন বিপুল অর্থ সহায়তা দিয়েছেন বলে দাবি করেন এই নেতা। বিনিময়ে মেয়র লিটন নাবিল গ্রুপকে সব ধরনের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সহায়তা দেন।
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (আরসিসিআই) সাবেক এক পরিচালক বলেন, গত ৫ বছর ধরে নাবিল গ্রুপ পেছন থেকে আরসিসিআই নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে সাবেক এই পরিচালক বলেন, ‘খায়রুজ্জামান লিটনের প্রভাবে শামসুজ্জামান আউয়াল ও আমিনুল ইসলাম স্বপন এখানে নাটের গুরু হয়ে উঠেছেন। স্বপনের স্ত্রী ইশরাত জাহানকেও নাবিল গ্রুপের পরিচালক দেখিয়ে আরসিসিআই পরিচালক করেন লিটন।
‘সরকারি মাল, দরিয়ায় ঢাল’
ইসলামী ব্যাংক থেকে নাবিল গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির তথ্য প্রথম ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়। তখন ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকা শিরোনাম করেছিল ‘ইসলামী ব্যাংকের ভয়ঙ্কর নভেম্বর’। পরে জানা যায়, নাবিল গ্রুপের ছত্রছায়ায় অস্তিত্বহীন ও নামসর্বস্ব কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে সুলতান অ্যাসোসিয়েটস অন্যতম। তথাকথিত এই প্রতিষ্ঠানের মালিক সুলতান আহমেদ। তিনি ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩৮০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। রাজশাহীর স্টেশন রোডে নবনির্মিত একটি ভবনকে এ প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই সুলতান আহমেদ শামসুজ্জামান আউয়ালের ঘনিষ্ঠ। আসলে তিনি একটি মোটরসাইকেলের দোকানে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। ইসলামী ব্যাংকের নিউমার্কেট শাখা থেকে তাদের ঋণ দেওয়া হয়।
এছাড়া জামান সিন্ডিকেটের মালিক রোকনুজ্জামান মিঠুকে ব্যাংকটির পাবনা জেলা সদর শাখা থেকে ঋণ দেওয়া হয়। ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, পাবনা জেলার হেমায়েতপুর উপজেলার ইসলামপুরে জামান সিন্ডিকেটের কার্যালয়। যেটি আসলে কয়েকবার ভাড়া নিয়ে শুধুমাত্র রাতেই খোলা হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের পাবনা শাখার ব্যবস্থাপক নাবিল গ্রুপের একজন অফিস সহকারীর নামে ৯৫০ কোটি টাকা ঋণ কীভাবে দিলেন তার সঠিক কোনো ব্যাখ্যা নেই।
শাজাহান আলী রাজশাহীতে নাবিল গ্রুপে হিসাবরক্ষক হিসেবে কাজ করেন। তার নামে এসএস স্ট্রেইটলাইন নামে একটি প্রতিষ্ঠান ৯০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। প্রায় হাজার কোটি টাকার এই মালিকের বাড়ি রাজশাহীর নওহাটা ইউনিয়নে। আদতে তার কোনো ব্যবসা নেই।
এছাড়া ৫০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া এনএন্ডএন ট্রেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক নাবিল গ্রুপের কর্মচারী রায়হানুল ইসলাম। ঋণ প্রস্তাবে তথাকথিত কোম্পানির দেওয়া ঠিকানায় নাবিল গ্রুপের আরও দুটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নেমপ্লেটও দেখা যায়।
যেখানে জামায়াত-আওয়ামী লীগ একাট্টা
খায়রুজ্জামান লিটন ও শামসুজ্জামান আউয়ালের সঙ্গে নাবিল গ্রুপের আমিনুল ইসলাম স্বপনের ঘনিষ্ঠতা মাঠের রাজনীতিতে দুই মেরুতে অবস্থান নেওয়া আওয়ামী লীগ ও জামায়াত ইসলামীর যোগসাজশের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে।
জানা গেছে, রাজশাহীর পবা উপজেলার টেকতাপাড়া গ্রামের হাজী জানবক্স দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতে ইসলামীর সদস্য। পাশের গ্রাম ভেড়াপাড়ায় তার একটি রাইস মিল ছিল। হাল আমলের প্রযুক্তিতে পরিচালিত এই এলাকার চালকলগুলো ‘জামাতিদের বৈঠকখানা’ নামে পরিচিত ছিল। বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে দাওকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ে হাজী জানবক্সের ছেলে আমিনুল ইসলাম স্বপনের লেখাপড়া শুরু হয়। মাধ্যমিক পর্যায় থেকে তিনি ওই স্কুলে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৯৬ সালে এসএসসি পাস করার পর তিনি ছাত্রশিবিরের স্থানীয় পর্যায়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক ছিলেন।
১৯৯৯ সালে স্বপন জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত নারকেলবাড়িয়া কৃষি কলেজে ভর্তি হন। সেখানেও তিনি ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠানটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সাথে কৃষি অনুষদ হিসাবে একীভূত হয়। এরপর তিনি ছাত্রশিবির নিয়ন্ত্রিত শহীদ শামসুজ্জোহা হলে থাকতে শুরু করেন। ছাত্রশিবির পরিচালিত ‘কনটেস্ট’ কোচিং সেন্টারের অন্যতম পরিচালক ছিলেন তিনি।
২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষে রাবি থেকে স্নাতক হওয়ার পর তিনি ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তি হন। সেখানে তিনি অধ্যাপক ড. আবু জোফর মোসলেহ উদ্দিন ও পরবর্তীতে তার মাধ্যমে তিনি যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাশিম আলীর ঘনিষ্ঠ হন।
২০০৬ সালে রাজশাহীতে ফিরে আসেন আমিনুল ইসলাম স্বপন। তিনি সিনজেন্টা কীটনাশক ডিলারশিপের সাথে ব্যবসা শুরু করেন। ২০০৭ সালে তিনি জামায়াতের সংগঠন এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাস্টের সাথে ব্যবসা শুরু করেন। এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৮ সালে মীর কাশিম আলীর অর্থায়নে।
২০০৮ সালে আমিনুল ইসলাম স্বপন তার এলাকায় শিমুল এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। ওই সময় তিনি ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা থেকে মাত্র ৫ লাখ টাকা ঋণ পান। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ইসলামী ব্যাংকে পরিবর্তন আসার সাথে সাথে স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন চাপ মোকাবিলায় আমলা ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরির চেষ্টা শুরু করেন আমিনুল ইসলাম। এরই অংশ হিসেবে নিজ এলাকার পবা উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলেন। উপজেলার তৎকালীন ইউএনও আলমগীর কবির (বর্তমানে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব) বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও কর্মসূচীতে অর্থ প্রদান শুরু করেন। এভাবে এই আমলা আর স্বপন একে অপরের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। আলমগীর কবির বদলি হয়ে রাজশাহীর এডিসি (রাজস্ব) হলে এই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ শুরু করেন স্বপন।
মেয়র লিটনের সঙ্গে আলমগীর কবিরের সম্পর্ক রয়েছে। তাই অল্প সময়ের মধ্যেই এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে স্বপনের। এরপর থেকে জামায়াত-আওয়ামী লীগ একসঙ্গে ব্যবসা করে আসছে।
ইসলামী ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তার ছেলেকে ঢাকায় নাবিল গ্রুপে কয়েক লাখ টাকা বেতনে চাকরি দেওয়া হয়েছে। ওই কর্মকর্তা মুনিরুল মাওলা ২০২১ সালে ব্যাংকের এমডি ও সিইও হন। ফলে লিটন-আউয়াল-স্বপন ত্রয়ীকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
শুরু হয়েছে তদন্ত
দুদকের উপ-পরিচালক ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে একটি দল ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণের নামে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের তদন্ত করছে। তদন্তের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও নাবিল গ্রুপকে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক। এই ঋণ কেলেঙ্কারিতে ১১টি কোম্পানি নাবিল গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
চিঠিতে ইসলামী ব্যাংকের গুলশান করপোরেট শাখা ঢাকা, রাজশাহী এবং নিউমার্কেট শাখা, রাজশাহী ও পাবনা শাখা থেকে নাবিল গ্রুপের ১১টি কোম্পানির তথ্য চাওয়া হয়েছে।
নাবিল গ্রুপের কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে নাবিল নাবা ফুডস লিমিটেড, নাবিল কোল্ড স্টোরেজ, নাবিল ফিড মিলস লিমিটেড, নাবিল অটো রাইস মিলস, নাবিল অটো ফ্লাওয়ার মিলস, শিমুল এন্টারপ্রাইজ, নাবা এগ্রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, আনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, নাবা ফার্মা লিমিটেড, নাবিল গ্রিন ক্রপস লিমিটেড এবং ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড প্যালেস।
দুদকের কর্মকর্তারা জানান, নথি চেয়ে ২০২৩ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রথম চিঠি দেওয়া হয়। তবে জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিদর্শন চলমান থাকায় পরিদর্শন শেষে প্রতিবেদন পাঠানো হবে।