‘ভাই আমার মুখে কি মাইরের দাগ দেখা যাচ্ছে?’

ছাত্রলীগের হাতে রেহাই পাননি মেয়েরাও।

কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর গতকাল রবিবার হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের এই ছাত্র সংগঠন রীতিমতো বর্বরতা চালিয়েছে। আব্দুল্লাহ আমান নামের নির্যাতিত একজন ফেসবুকে দীর্ঘ এক লেখায় ছাত্রলীগের নিষ্ঠুরতার বর্ণনা দিয়েছেন।

মিরর এশিয়ার পাঠকদের জন্য সেই লেখাটি পুরোপুরি তুলে ধরা হলো-

টিএসসি থেকে শাহবাগের দিকে চলে যাওয়া রাস্তাটা ধরে দৌড় দিলাম। চারুকলার কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম দুইটা মেয়ে আর একটা ছেলে গল্প করতে করতে হাঁটছে। ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভাই আমার মুখে কি মাইরের দাগ দেখা যাচ্ছে?’ খালি গা আমার। বুকে-পিঠে-বাহুতে লাঠি, বাঁশ আর লোহার ডান্ডা দিয়ে পেটানোর ছোপ ছোপ কালশিটে। মাথার কয়েক জায়গা ফুলে আছে। হাত দিলে আঠা আঠা লাগে। পুরো শরীরে টনটনে ব্যথা। বাম পা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছি। মুখের কী অবস্থা বুঝতে পারছি না। প্রশ্ন শুনে মেয়ে দুটো আমার দিকে তাকিয়েই যেন ভূত দেখার মতন আঁৎকে উঠে ছিটকে গেল দুই পাশে। ছেলেটাও চমকে তাকাল আমার দিকে। নাক দিয়ে গড়িয়ে নামা গরম রক্ত হাতের পিঠে মুছে সামনে এগোলাম। উত্তর পেয়ে গেছি।

এর ঘণ্টাখানিক আগে। রাত তখন ০৯টা।

সারদিন বাসা থেকে বের হইনি। নিউজ, ফেসবুকসহ সর্বত্র দেশব্যাপী বর্বর ছাত্রলীগের পৈশাচিক হামলায় রক্তাক্ত শিক্ষার্থীদের ছবি দেখেছি দিনভর। কোটা আন্দোলনের সঙ্গে শতভাগ সংহতি থাকলেও ২০১৩ তে শাহবাগ ও শাপলা চত্ত্বরের আন্দোলনের সঙ্গে স্ব-শরীরে সম্পৃক্ত থাকায় এ জাতীয় আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন জাগা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সারা দিনব্যাপী ছাত্রলীগের হামলায় নির্যাতিত ও রক্তাক্ত শিক্ষার্থীদের ছবি দেখে, খবর পড়ে ছাত্রলীগের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষে ভরে গেল মন। মার খাওয়া শিক্ষার্থীদের পাশে থাকতে, তাদের রক্ত দিতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়ে উঠলাম।

ঢাবি এলাকায় অনেকগুলো ছোট ভাই ও বড় ভাইদের নির্যাতিত হওয়ার সংবাদ পেয়েছি সারাদিন। আহত অবস্থায় অনেকেই কাতরাচ্ছে হাসপাতালে। কেবলই নিউজ পাচ্ছিলাম, ঢামেকে খুবই রক্ত সংকট চলছে। ঢামেকে কাতরানো মুমূর্ষদের রক্তদানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রক্ত দেওয়ার উদ্দেশে বাসা থেকে বের হলাম রাত ০৮টার দিকে। এদিকে সন্ধ্যা ৬:৩০ এর দিকে ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার পুরো ঢাবি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে বলে এক বিবৃতি দিতে দেখলাম।

রাত ০৯টা বা তার ৫-১০ মিনিট আগে পরে পৌঁছালাম টিএসসি। পরিবেশ খুবই স্বাভাবিক মনে হল। টিএসসির চায়ের দোকানগুলোতে ছেলে-মেয়েরা চা সিগারেট খেতে খেতে গল্প করছিল স্বাভাবিক দিনের মতোই। গাড়িঘোড়া সব চলছে। কয়েকজন পুলিশ বন্দুক হাতে বসে আছে। রাজু ভাস্কর্যের ঠিক সামনে উঁচু জায়গাটাতে শ দুয়েক বা আরও বেশি লোক দাঁড়িয়ে আছে। নিচে কিছু মানুষ বসা। লাঠি, বাঁশ আর লোহা-স্টিলের ডান্ডা হাতে বাচ্চা বাচ্চা থেকে মধ্যবয়সী কিছু লোক এলেমেলো ঘুরছে। হেলমেট পরা কয়েকজনকে মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখা গেল।

‘শেখ হাসিনার বাংলায়, রাজাকারের ঠাঁই নাই’ জাতীয় কিছু শ্লোগান শুনে পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম, এরা সবাই ছাত্রলীগ। একদমই পিচ্চি দেখতে কয়েকজনকে বলাবলি করতে শুনলাম, ‘হেলমেট ছাড়া গ্যাঞ্জাম করে কোনো মজা আছে বল!’

টিএসসি, সোহরাওয়ার্দি উদ্যানকেন্দ্রিক ছাত্রলীগ নির্যাতন-নিপীড়নের খবর জানা থাকা এবং সামনাসামনি কয়েকবার দেখার সুবাদে তাদের চড়াও হওয়ার ধরন সম্পর্কে আগে থেকেই ওয়াকিফহাল। চপ বিক্রির দোকানের পাশে যে যাত্রী ছাউনি, দেখলাম কয়েকজন পুলিশ সেখানে বসা। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে দ্রুত সেদিকে পা বাড়ালাম। ছাত্রলীগের কালো ছায়ায় অন্ধকার নেমে আসা এলাকা চটপট ত্যাগ করাই তখন টার্গেট।

পুলিশের সামনে থেকে হেঁটে পার হচ্ছি, তখুনি হুট করে একজন এসে কলার চেপে ধরল। কিছু বলব, তার আগেই আশপাশ থেকে ১০-১৫ জন মতন ছাত্রলীগ বাঁশ-লাঠি হাতে ছুটে এসে উপর্যপুরি আঘাত করতে শুরু করল আমার মাথা, মুখ, বাহু, পিঠ, উরু আর পায়ে।

‘এ শিবির’ বলে আমার কলার ধরে পুলিশের সামনে থেকে হিড়হিড় করে টেনে রাজু ভাস্কর্যের সামনে ছাত্রলীগের যে মূল জটলা, তার মাঝখানে নিয়ে গেল। কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড় আর লাঠি বাঁশের বাড়ি অনবরত পড়ছে। ভাস্কর্যের উপরে মেট্রো রেলের পিলারের লেখা চোখে পড়ল, ‘জয় বাংলা বলে আগে বাড়ো’। আরও কিছু দেখার আগেই জনা তিরিশেক লোক চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল আমাকে। যেন বাইরে থেকে বোঝা না যায়, ভেতরে কী হচ্ছে!

মাথায়, বুকে-পিঠে আর গোড়ালিতে লাঠি, বাঁশ দিয়ে মেরে মেরে রাস্তায় বসে পড়তে ততক্ষণে বাধ্য করা হয়েছে। মনে হচ্ছিল, কোনো অন্ধকার কালকুঠুরিতে আটকানো হয়েছে আমাকে।

ভিড় ঠেলে একজন সামনে এসে বসল আমার। পেছন থেকে একজন বাহু দিয়ে গলা চেপে ধরল শক্ত করে। দম নিতে পারছিলাম না, কথাও বলতে পারছিলাম না কোনো। জোরপূর্বক ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে ফোনের লক খুলে নিল সামনের লোকটা। ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম, মেসেঞ্জারসহ আমার সব অনলাইন অ্যাক্টিভিটি চেক করা শুরু করল খুব মনোযোগ দিয়ে। কোথাও তাদের বিরোধী কোনো বক্তব্য না পেয়ে অবশেষে উত্তরবঙ্গের অনার্স পড়ুয়া একজনের সঙ্গে একটা মেসেঞ্জার কথোপকথন চোখে পড়ে তার। ছাত্রলীগের বর্বর হামলায় দেশব্য়াপী রক্তাক্ত হওয়া শিক্ষার্থীদের একজনের ছবিসহ পোস্ট সে আমাকে শেয়ার করেছে। ‘এ জন্যই তো ছাত্রলীগ দেখতে পারি না দুই চোখে। অথচ আমরা সবসময়ই দু্র্নীতি, নির্যাতনমুক্ত শান্তিপূর্ণ একটা দেশ চেয়েছি, যেখানে সব ধর্ম-মতের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থাকবে ‘—এমন একটা কথা লিখে তাকে রিপ্লাই দিয়েছি আমি।

কথোপকথনটা নজরে পড়তেই ফোন চেক করা লোকটা বলে উঠল, ‘আরে এ তো দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত শিবির’। চারপাশ থেকে ‘শিবির শিবির’  আওয়াজ শুরু হল। হিংস্রতার মাত্রা বেড়ে গেল সাথে সাথেই। চতুর্দিক থেকে উপর্যপুরি চড়-কিল-ঘুষি এবং লাঠি-বাঁশের বাড়ি বন্যার মতন আছড়ে পড়া শুরু হল মাথা থেকে শুরু করে কোমর পর্যন্ত।

আচম্বিত ঘটনায় আমি পুরো হাক্কাবাক্কা খেয়ে গেছিলাম। মাথায় এত বেশি পরিমাণে আঘাত করা হচ্ছিল, কিছুই আঁচ করতে পারছিলাম না যে, কী হচ্ছে আসলে! খুবই আতঙ্কগ্রস্ত পড়লাম। পুরো একটা ছাত্রলীগ বাহিনীর মাঝখানে একা আটকা পড়ে গেছি। এত ছাত্রলীগ, একটা করে মারলেও আমার আজকে দফারফা! সর্বশক্তি জড়ো করে এক ঝটকা দিয়ে দৌড় দেওয়ার চেষ্টা করলাম রাজু ভাস্কর্যের সামনে। সেখানে ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয়রা দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছিল।

আমার ভাবনা ছিল, এরা একেবারেই পুলাপাইন। ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় কারও কাছে পৌঁছাতে পারলে অন্তত এই মাইরের হাত থেকে রক্ষা পাব। মার খেতে খেতে দৌড়াচ্ছি। বাম পায়ে খুব জোরে একটা বাড়ি পড়ায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম। হাচড়ে-পাচড়ে উঠে আবারও ছুটলাম। কে যেন টান দিয়ে আমার গায়ের পোশাক ছিঁড়ে ফেলল। কোনোমতে উপরে উঠে একজনকে জাপটে ধরলাম মার থেকে বাঁচতে। লোকটা তৎক্ষণাৎই নিরস্ত করল সবাইকে। নিচে থেকে কয়েকজন আওয়াজ দিচ্ছিল, ‘ভাই ও শিবির, ওরে আমাদের হাতে ছেড়ে দেন খালি’!

আরেকদফা ফোন চেক করা হল আমার। জাপটে ধরছিলাম যাকে, সে পেছনের কয়েকজন জুনিয়রকে নির্দেশ দিল, ‘ওকে একটু পাশে নিয়ে যা, এখানে কিছু করিস না, সবাই দেখতেসে। আমি আসতেসি।’

পেছন থেকে আবারও বাহু দিয়ে গলা চেপে ধরল একজন। দুইজন দুইপাশ থেকে দুই হাত মুচড়ে ধরল আমার। টেনে-হিঁচড়ে এই অবস্থায় নিচে নামাতেই নতুন হিংস্রতায় মারধর শুরু হল। গলা চেপে ধরায় শ্বাসনালি পুরো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফুসফুস বাতাসের অভাবে খাবি খাচ্ছিল। অক্সিজেনের অভাবে চোখের আলো নিভে আসছিল টের পাচ্ছিলাম, কিন্তু গলায় কোনো আওয়াজ আসছিল না। গলা চেপে ধরা আর হাত মুচড়ানো অবস্থায় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলাম রাস্তায়।

চোখে আলো ফিরতেই আমাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেখলাম। চোখ মেলতে দেখে হাঁটতে বলল। টিএসসি থেকে শাহবাগের দিকে চলে যাওয়া রাস্তার আইল্যান্ডের গ্রিলে হেলান দিয়ে বসানো হল আমাকে। এরমধ্যে ছাত্রলীগের সেই নেতৃস্থানীয় লোকটা হাজির। এসেই রায় দিল, ‘এ দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত শিবির কোনো সন্দেহ নাই। একে থানায় হ্যান্ডঅভার করে আয়। আগে একটা ভিডিও জবানবন্দি নিয়ে নিস’।

হেলমেট পরা ৪-৫ জন সামনে আসল এবার। সামনে থেকে আবারও আড়াল করে দাঁড়াল ১০-১৫ জন মতন। একজন ফোন ক্যামেরা অন করল ভিডিও নিতে। কালো ষণ্ডামতন একটা হেলমেট পরা ছাত্রলীগ তার হাতের হাতলওয়ালা চকচকে স্টিল বা লোহার একটা ডান্ডা ধরল আমার তলপেট বরাবর। একই প্রশ্ন বারবার করা শুরু করল—বল তোর অ্যাডমিন কে? আমাদের তথ্য কাদের দিচ্ছিলি? তুই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ছাত্রলীগ মেরেছিস এবং গাড়ি ভাঙচুর করেছিস, স্বীকার কর’!

প্রতিবারই আমার উত্তর ছিল, ‘ভাই আমার কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই, আমি এই এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলাম কেবলই একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে’। আশানুরূপ উত্তর না পাওয়ায় প্রশ্নশেষে প্রতিবারই চারপাশ থেকে লঠি আর বাঁশের বাড়ি পড়ছিল উরু আর বাহুতে। হেলমেট পরা ছাত্রলীগ তার হাতলওয়ালা চকচকে ডান্ডা আমার তলপেট থেকে একটু নিচে নমিয়ে জোরে গুতো দিয়ে জবানবন্দি নিতে চাপ দিচ্ছিল। গলার স্বর খাদে নামিয়ে ‘স্বীকার কর, নইলে তোরে জানে মেরে ফেলব’ বলে তাদের কথা মেনে নিতে বলছিল বারবার।

হাত দিয়ে আঘাত ঠেকাতে চেষ্টা করায় ডান হাত টান দিয়ে পেছনের গ্রিলের সাথে বাঁধল একজন। বা হাতও যাতে ব্যবহার করতে না পারি, সেজন্য আবারও গলা চেপে ধরল। বা হাত মুচড়ে পেছনে নিয়ে যাচ্ছিল বাঁধতে। একজন একটা কালো কাপড় বের করে বলল, ‘চোখ বেঁধে ফেল ওর!’

এতক্ষণ, টানা প্রায় ৪৫ মিনিট মতন ছাত্রলীগের এই বিরামহীন নির্যাতনে এমনিতেই শরীরে কোনো জোর পাচ্ছিলাম না। গোটা শরীরে ব্যথা। মাথা দিয়ে আগুনের হল্কা বেরোচ্ছে যেন। এরমধ্যে আবারও গলা চেপে ধরায় জ্ঞান হারানোর উপক্রম। চোখ উলটে যাচ্ছে দেখে, গলা ঢিল করে হাত খুলে দেয়।

ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় লোকটা তখন অবস্থা পর্যবেক্ষণে এসেছে আবার। পছন্দসই জবানবন্দি না দেওয়ার ক্ষোভে নেতার সামনে আমার এলানো শরীরের উপর আরেকদফা চড়াও হল সবাই। জাপটে ধরেছিলাম যাকে এবং যার কাছে আমার মোবাইল, সে কোনোভাবেই আমার জবানবন্দি সংগ্রহ করতে না পেরে এবং আমার শারীরিক অবস্থা দেখে তখন আমাকে ছেড়ে দিতে বলে।

তার হাতে তখনো আমার মোবাইল। আমার ঘড়ি, পকেটের টাকা-পয়সা ইত্যাদি সবই কোনদিক দিয়ে খোয়া গেছে, টেরও পাইনি। আমি ভাঙা গলায় কোনোরকমে তার কাছে মোবাইলটা চাইতেই মুখে হিংস্র এক হাসি টেনে বলল, ‘বেঁচে গেছিস এই বেশি, আবার মোবাইলও দরকার!

তার ইশারা পেয়ে এই কথা মাটিতে পড়ার আগেই চারপাশ থেকে লাঠি-বাঁশের বাড়ি পড়া শুরু হয়ে গেল ফের আমার বাহু, পিঠে আর উরুতে। এলাকা থেকে ভাগিয়ে দিতে কয়েকজন ধাওয়া দিতেই বুঝে গেলাম, ফোনের আশা নাই কোনো। দৌড় দিলাম শাহবাগের দিকে।

আমি আর নিতে পারছিলাম না তখন। আমার শুধু ভয় হচ্ছিল, আমি রাস্তায় পড়ে যেতে পারি যেকোনো সময়। আশেপাশের মানুষ ও পুলিশের নিষ্পৃহতা ছাত্রলীগের নির্যাতনেরও কয়েকগুণ বেশি শক্তিতে আমার মনে আঘাতের পর আঘাত করে দুর্বল করে ফেলছিল। গা গুলিয়ে আমার হড়হড় করে বমি আসছিল ছাত্রলীগের প্রতি তীব্র ঘেন্নায়।

হাঁটতে হাঁটতে আমি খুবই অবাক হচ্ছিলাম। একের পর বিস্ময়ের ডিম ফুটছিল আমার মস্তিষ্কে। এই কি আমার স্বাধীন রাষ্ট্র! সাধারণ একজন মানুষের রাস্তা হেঁটে যাওয়ারও নিরাপত্তা নাই যেখানে! যেখানে চাইলেই যে কাউকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে সেই রাস্তার উপরেই ফেলে নির্যাতন করা যায়! কী স্বাধীনতা আমার এই দেশে! কেবল মুখে দাঁড়ি থাকাতেই যেখানে আমাকে শিবির ট্যাগ দিয়ে নির্যাতন করা হয়!

এ কেমন স্বাধীন দেশ আমার! হঠাৎ করে ধরে সম্পূর্ণ  বাক-স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে, হাত বেঁধে চোখে কালো কাপড় পরিয়ে যেখানে জোরপূর্বক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়! আর এই ছাত্রলীগ, এরা কারা? কোন ধৃষ্ঠতায়, কার প্রশ্রয়ে আর কী লাভের আশায় নিরীহ শিক্ষার্থী এবং সাধারণ জনতার উপরে এভাবে চড়াও হওয়ার দুঃসাহস পায় এরা!

আমি জানি, আজ ছাত্রলীগকর্তৃক আমি যতটুকু আহত হয়েছি, তারও ঢের ঢের গুণ বেশি আহত ও রক্তাক্ত হয়ে দেশব্যাপী অসংখ্য শিক্ষার্থী মুমূর্ষ অবস্থায় হাসপাতালে বা বাসা-বাড়িতে শুয়ে বসে কাতরাচ্ছে। দীর্ঘ ১ ঘণ্টা ছাত্রলীগকর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়েও আমার চোখ থেকে এক ফোট অশ্রু বের হয়নি। কিন্তু আমার বোনদেরকে ছাত্রলীগের লাঠির মুখে বেদনাহত, রক্তাক্ত হওয়ার ছবি সামনে এলেই  ভিজে ওঠে চোখের কোল। দেশকে মনে হয় ফিলিস্তিন। দেশব্যাপী চলমান আন্দোলনে অংশ নেওয়া সেইসব শিক্ষার্থীদের বেদনার সামনে, তাদের ত্যাগের সামনে, তাদের ক্ষতির সামনে আমার সাথে ঘটা এই ঘটনা নিতান্তই তুচ্ছ বলে মনে হয়।

আমি গালি দিতে পারি না। কাউকে গালি দিতে আমার খুবই কষ্ট হয়, মুখে বেধে যায়। আমি যতদিন বেঁচে থাকব, ছাত্রলীগকে ঘৃণা করে যাব।  আমি যতদিন বেঁচে থাকব, এই দুঃশাসনকে ঘৃণা করে যাব। আমি যতদিন বেঁচে থাকব, এই বৈষম্য ঘৃণা করে যাব।

আমি যতদিন বেঁচে থাকব, এই স্বৈরাচারিতা ঘৃণা করে যাব। আমি যতদিন বেঁচে থাকব, আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপকারী সকল মতাদর্শ, রাজনৈতিক দল, প্রোপাগাণ্ডা, বৈষম্য এবং স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যাব। এই স্বাধীন বাংলায়, কোনো স্বৈরাচারীর ঠাঁই নাই। এই স্বাধীন বাংলায় আমার স্বাধীনতায় হাত দেওয়া কারও কোনো ঠাঁই নাই।

আমি আমার এবং দেশব্যাপী সকল শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের এহেন বর্বরোচিত হামলা এবং অস্ত্রসমেত নৃশংস কায়দায় ঝাঁপিয়ে পড়ার তীব্র নিন্দা জানাই। পাশাপাশি খুঁজে খুঁজে এদের প্রত্যেককে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানাই। সামাজিকভাবে ছাত্রলীগ বয়কটের আহ্বান জানাই আমার স্বাধীন দেশের স্বাধীনতামকামী সর্বস্তরের জনগণের প্রতি।