পুলিশ গুলি করে মাথা দুই ভাগ করে দিলো এক ১০/১১ বছর বয়সী কিশোরের, মগজ চলে এসেছে হাতে

ঢাকায় পুলিশ জনতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি করছে

বাংলাদেশ এখনো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ঢাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাচ্ছে না। সাংবাদিক শিমু নাসের ঢাকার গত দুইদিনের পরিস্থিতি নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। দ্য মিরর এশিয়ার পাঠকের জন্য শিমু নাসেরের পোস্টটি হুবুহু এখানে দেওয়া হলো।

 

এত অবরুদ্ধ, এত হতাশ, এত ক্ষোভ আগে কখনো বোধ করিনি। চোখের সামনে পুলিশ গুলি করে মাথা দুই ভাগ করে দিলো এক ১০/১১ বছর বয়সী কিশোরের। মগজ চলে এসেছে হাতে। তাকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে লাভ নেই। কিন্তু সেই যাওয়াটাও যেতে দেবে না পুলিশ। এ যে কেমন অনুভূতি, সেটা আমার জন্য খুবই নতুন। নিজ দেশে এমন বন্দী আর অসহায় আমি আগে কখনো বোধ করিনি। 
*
বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেটের পর তারের ইন্টারনেটও পুরোপুরি বন্ধ। তাই যারা দেশের বাইরে বসে ফেসবুক বা অন্য মিডিয়ামে নানা কথা বলছেন কেউ কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। এমন তথ্য অন্ধকার যে কত ভয়াবহ হতে পারে সেটা এই পরিস্থিতির মধ্যে না থাকলে বোঝা দায়। মানুষের সংবাদের একমাত্র সোর্স টেলিভিশন। সেই টেলিভিশনগুলো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নানা ধরণের নাটক ও ক্রিপ্টেড সংবাদ প্রচার করছে সরকার। যাদের বাসায় টেলিভিশন নেই তারা রাস্তায় নেমে, ছাদে উঠে চারদিক দেখে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, সাত মসজিদ রোড, এলিফ্যান্ট রোড, মিরপুর রোড, কাটাবন এলাকা রণক্ষেত্র। শাহবাগ এলাকা ছাত্রলীগের দখলে। সেখানে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সন্দেহ হলেই যে কাউকে মারধোর করে ফোন, মানিব্যাগ রেখে দিচ্ছিল কালকে রাত পর্যন্ত তারা। সাউন্ড গ্রেনেড, গুলি আর টিয়ারশেলের ঝাঝালো গন্ধে এসব এলাকার মানুষ ইতিমধ্যে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে।    
*
পথ দখল করে আছে নানা বয়সী মানুষ। তবে বেশিরভাগই তরুণ। নানা ধরণের গুজব চারদিকে। কিছু কিছু জায়গায় ক্লান্ত পুলিশ, ক্লান্ত লীগ কর্মীরা চেয়ার পেতে ঝিমোয়। তারাও মোটামুটি তথ্য অন্ধকারে। তাদের সাথে কথা বললে তারাও বলে, আমরা কিছু জানি না, আমাদেরও ইন্টারনেট নাই। লীগ কর্মীদের অনেকে ঢাকা ভালো করে চেনেও না, বোঝাই যায় অনেককে ঢাকার বাইরে থেকে আনা হয়েছে এই বিশেষ পরিস্থিতি সামাল দিতে। 
*
গতকাল আমি এসব আর সহ্য করতে না পেরে ক্ষোভে, হতাশায় ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়ে বিকেল ৪টায় শাহবাগে দাঁড়াতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি শতশত ছাত্রলীগ কর্মী সেখানে লাঠিসোটা, রড ইত্যাদি নিয়ে অপেক্ষা করছে। বস্তায় বস্তায় ইট ওঠাচ্ছে তারা ওভারব্রিজগুলোতে। আমরা ঠিক ৪টায় জাদুঘর গেটের সামনে ৭/৮ জন জড়ো হয়েছি। প্ল্যাকার্ডগুলো লুকিয়ে রেখেছি ব্যাগে। ছাত্রলীগের জেরার মুখে পড়লাম। মাত্রই তারা আমাদের চোখের সামনে প্যাকেট লাঞ্চ করেছে। তাজা শরীর। ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দামও সেখানে কালো পাঞ্জাবি পরে চিন্তিত মুখে পায়চারি করছে। তাকেও বোধহয় কাজ দেখাতে হবে অন্যদের। বলতে না বলতেই আমাদের একজন মেয়েকে তারা পেটানো শুরু করলো। ৮/১০ ঘা খাওয়ার পর কোনোমতে তাকে ছুটিয়ে আনতে পারলেও তার মানিব্যাগ আর ফোনটা উদ্ধার করতে পারিনি। এরপর আমরা শাহবাগে আর না দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই। আমরা চলে আসি কাটাবন মোড়ে। 
কাটাবন মোড়ে আমরা যখন দাঁড়াই শুরুতে আমরা ছিলাম মাত্র ১০ জন। এরপর যাদের কাছে আমার ফোন নাম্বার ছিলো তারা ফোন করলে বলি কাটাবন চলে আসতে। দেখতে দেখতেই আমাদের সংখ্যাটা ২০০ ছাড়িয়ে গেলো। চলতি পথেরও অনেকে দাঁড়িয়ে গেলো। দুই তরুণ রিকশা ছেড়ে দিয়ে কোথা থেকে এক কেস পানি এনে আমাদের বিলিয়ে আবার নিজ পথে চলে গেল। আমাদের বেশিরভাগ প্ল্যাকার্ডেই ইংরেজিতে লেখা ছিলো, আমাদের ছাত্রদের হত্যা করা বন্ধ করুন (কিছু ছবি কমেন্টে দিচ্ছি)। আমরা শুধুতে শুধুই দাঁড়িয়েই ছিলাম প্ল্যাকার্ডগুলো হাতে নিয়ে। সেখানে দাঁড়ানো একজন বয়স্ক মহিলা এমন কাঁদতে শুরু করলো আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করবো। সন্ধ্যা নামতেই আমরা প্ল্যাকার্ডগুলো মাটিয়ে গোল করে রেখে আবু সায়ীদদের স্বরণে মোমবাতি জ্বালালাম, নিজেরা গোল হয়ে বসলাম। এরপর একটি অংশ মৌন মিছিল নিয়ে বাটা সিগন্যালের দিকে আগালো, আরেকটি দল সায়েন্স ল্যাবে ছাত্রদের সঙ্গে গিয়ে যোগ দিলাম।
মিছিল করা অংশটি আবার যখন কাটাবনে ফিরে আসে সেখানে পুলিশ ও ছাত্রলীগের লাঠিপেটার মুখে পড়ে।
*
নানা কারণে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই আমার ফোন সুইচড অফ আছে। তাই অনেকে আমাকে ফোনে বা অন্য কোনো মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারছেন না। আমি এখন ইন্টারনেটের আওতায় এসেছি কিছুক্ষণের জন্য। মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ক্ষুদে বার্তায় অসংখ্য বন্ধু উদ্বিগ্ন হয়ে মেসেজ করেছেন গত দুইদিন ধরে দেখতে পাচ্ছি। ধন্যবাদ আমার খোঁজ নেওয়ার জন্য। আমি শারীরিকভাবে ঠিক আছি। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত।
*
একটা সরকার যখন জনগণের হয় না, তখন তারা ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে জনগনের সাথে, সেটার নিজের চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না। আমি ঘুমের মধ্যেও এখন গুলি, মানুষের খোলা মস্তিষ্কের ছবি দেখছি, মানুষের মৃত্যু দেখছি।