২ মিলিয়ন পাউন্ডের বাসায় থাকছেন টিউলিপ, নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগ

টিউলিপ সিদ্দিক। ফাইল ছবি

নিজের খালার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মিত্রের মালিকানাধীন ২ মিলিয়ন পাউন্ডের বাড়িতে বসবাস করার বিষয়টি সামনে আসার পর গতরাতে যুক্তরাজ্যের নগরমন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক গুরুতর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন। টিউলিপের খালা বাংলাদেশের স্বৈরাচারী প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। লেবার পার্টির টিউলিপ সিদ্দিক দুই বছর আগে উত্তর লন্ডনে নিজের মালিকানাধীন ফ্ল্যাট থেকে সরে এসে তার পরিবারের সাথে কয়েক মাইল দূরে একটি পাঁচ বেডরুমের বাসায় ওঠেন। এই বাড়িটির মালিক তাদের এক পারিবারিক বন্ধু; এই কোটিপতি ব্যবসায়ীর নাম আব্দুল করিম।

গত বছর আব্দুল করিমকে টিউলিপ সিদ্দিকের খালা শেখ হাসিনা বিশেষ ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলেন। হাসিনা গত সপ্তাহে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের ‍মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। এর আগের ১৫ বছর শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে স্বৈরাচারি কায়দায় শাসন করেছিলেন।

গতকাল রাতে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইলের পক্ষ থেকে টিউলিপের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এই লন্ডন শহরের উপকণ্ঠের বড় বাড়িটির জন্য তাকে কী পরিমাণ ভাড়া দিতে হয়। তবে তিনি এটি বলতে রাজি হননি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টিউলিপ যদি বাজার দরের চেয়ে কম ভাড়া দিয়ে থাকেন সেটিও খোলাসা করা উচিত। এখানে প্রশ্ন উঠছে যে টিউলিপ ওই বাসায় থাকার কারণে আব্দুল করিমকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে কি-না। একই সময়ে টিউলিপ তার আগের বাসা থেকে হাজার হাজার পাউন্ড আয় করছেন।

টিউলিপের এই বিষয়টির সঙ্গে যুক্তরাজ্যের উপ-প্রধানমন্ত্রী অ্যাঞ্জেলা রেনারের মামলার মিল পাওয়া যায়। নির্বাচনের আগে অভিযোগ উঠেছিল, যুক্তরাজ্যের বর্তমান উপ-প্রধানমন্ত্রী অ্যাঞ্জেলা রেনার তার স্বামীর বাসায় থেকে নিজের বাসা থেকে ভাড়া উত্তোলন করেন। যদিও রেনারের বিরুদ্ধের কোনো অনিয়ম পাওয়া যায়নি।

সংস্কারপন্থি সংসদ সদস্য নাইজেল ফারাজ টিউলিপ সিদ্দিকীর বাসার বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এটি কেমন যেন ঘোলাটে।’

টিউলিপের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র (৪১) বলছে, নিরাপত্তজনিত কারণে আগের বাসাটি ছেড়ে ভাড়া বাসায় উঠেছেন তিনি। তবে তিনি গণমাধ্যমে সরাসরি কথা বলতে রাজি হননি।

টিউলিপের খালা শেখ হাসিনা গত সোমবার ব্যাপক আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন। দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী শতাধিক আন্দোলনকারীকে হত্যা করেছে।

পদত্যাগের পরপরই শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। সঙ্গে রয়েছেন তার বোন ও টিউলিপের মা রেহানা সিদ্দিক। বলা হচ্ছে, শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্যে আশ্রয় চাচ্ছেন।

ব্যবসায়ী আব্দুল করিম ২০২২ সালের জুলাইয়ে ২.১ মিলিয়ন পাউন্ডে বাড়িটি কেনার পরপরই টিউলিপ সিদ্দিক শহরতলীর ওই বাড়িটিতে ওঠেন। তিনটি ওয়াশরুম ও দুটি রিসিপশন রুম থাকা ওইরকম একটি বাসার মাসিক ভাড়া ৫,০০০ পাউন্ডের মতো হতে পারে বলে জানা গেছে।

যদি টিউলিপ সিদ্দিক ওই বাসাটি বাজার দরের চেয়ে কম মূল্যে ভাড়া নিয়ে থাকেন তবে পার্লামেন্টারি নিয়ম অনুযায়ী তাকে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কারণ এটি অর্থনৈতিক সুবিধা। তার বিরুদ্ধে সংসদীয় তদন্ত হয়েছে। এতে উঠে এসেছে, তিনি তার মালিকানাধীন ফ্ল্যাটের চেয়ে ১০,০০০ টাকা বেশি আয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিস্তারিত তথ্য দিতে পারেননি। দ্য স্ট্যান্ডার্ড কমিশনার তার বিরুদ্ধে সংসদীয় নিয়ম ভঙ্গের প্রমাণ পেয়েছেন। তবে টিউলিপের জবাবদিহির প্রেক্ষিতে প্রশাসনিক ত্রুটি ধরে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

আব্দুল করিম শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখার নির্বাহী সদস্য। তার বাংলাদেশে ব্যবসা রয়েছে। তিনি টিউলিপের পারিবারিক ঘনিষ্ঠ। ২০২২ সালে বার্কশায়ারের লাংলে মেরিশে আব্দুল করিমের মেয়ের বিয়ের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে টিউলিপ ও তার মা শেখ রেহানা উপস্থিত ছিলেন।

টিউলিপের নতুন বাসায় ওঠার পর গত বছর আব্দুল করিমকে বাংলাদেশে কর্মার্শিয়ালি ইম্পর্ট্যান্ট পার্সনের (সিআইপি) মতো বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। সিআইপি হওয়ার কারণে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পান। এছাড়া বিদেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে পান বিশেষ সুবিধা। তিনি যেই দেশেই ভ্রমণ করুন না কেন, বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে তাকে ‘লেটার অব ইন্ট্রোডাকশন’ দেওয়া হয়।

টিউলিপ ওই বাসায় ওঠার পর আব্দুল করিম বাংলাদেশের শাহজালাল ইসলামি ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান হন। তিনি ব্যাংকটির ১.২ মিলিয়ন পাউন্ড শেয়ারহোল্ডার হিসেবে ডিরেক্টরও হয়েছেন।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার একটি সূত্র বলছে, যখন আব্দুল করিম ব্যাংকটির ডিরেক্টর হতে চেয়েছিলেন তখন তার এই সেক্টরে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। তবে তিনি তখন শেখ হাসিনা পরিবারের সঙ্গে যোগসূত্রের বিষয়টি তুলে ধরেন। সূত্রটি এও বলেছে, পরবর্তীতে আব্দুল করিমকে ব্যাংকের প্রবেশে সহায়তার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকেও কল করা হয়।

টিউলিপ সিদ্দিক যে তার খালার কাছে আব্দুল করিমের জন্য সুপারিশ করেছিলেন তার কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। তবে এরপর থেকে আব্দুল করিম প্রধানমন্ত্রীর আরও কাছের হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার অফিসে সাক্ষাৎ করেন আব্দুল করিম। সেখানে শেখ হাসিনা আব্দুল করিমের ভূয়সী প্রশংসা করেন। পরের মাসেই আব্দুল করিম বাংলাদেশে নতুন ব্যবসা শুরু করেন। প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘দ্য লন্ডন টি এক্সেঞ্জ’।

আব্দুল করিম লেবার পার্টির সঙ্গেও সখ্যতা গড়ে তোলেন। গত বছরের মার্চে তখনকার বিরোধী নেতা কেয়ার স্টারমার আব্দুল করিমের রেস্টুরেন্ট উদ্বোধন করেন।

গতরাতে কমিটি অন স্ট্যান্ডার্ডস ইন পাবলিক লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান অ্যালিস্টেয়ার গ্রাহাম বলেছেন, টিউলিপ যদি বাজার দরের চেয়ে কম ভাড়া দিয়ে থাকেন তবে সেটি তার খোলাসা করা উচিত। তিনি বলেন, সে যদি নতুন বাসায় গিয়ে আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন তবে তার সেটি স্বীকার করতে হবে।

‘এখন তার ঘোষণা করা উচিত ছিল যে আব্দুল করিম বাংলাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সেখানে যে তার খালা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সেটি অন্য ব্যাপার। যেহেতু মানুষজন সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন তাই এটাকে আরও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা উচিত ছিল। তারপর যে কেউ সংসদীয় কমিশনারের কাছে অভিযোগ করতে পারতো এবং তাদের তদন্ত করতে বলতে পারতো।’

এ ব্যাপারে শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি ডেইলি মেইল। কিন্তু ব্রিটেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারুক সৈয়দ বলেছেন, টিউলিপ সিদ্দিক যে আব্দুল করিমের বাড়িতে বাস করছেন তা তিনি জানেন না। করিম যে সিআইপি হয়েছেন তাও তিনি জানেন না।

তিনি বলেন, ‘টিউলিপ সিদ্দিক সংসদের একজন সম্মানিত সদস্য এবং তিনি একজন মন্ত্রী এবং আমরা জানি তিনি ভালো কাজ করছেন।’

গতকাল রাতে আব্দুল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রশ্নের উত্তর দেননি। আর টিউলিপ সিদ্দিক অন-দ্য-রেকর্ড বিবৃতি প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানান।

দুই বছর আগে প্রতিবেদন হয়েছিল যে, টিউলিপের মা রেহানা সিদ্দিকও উত্তর লন্ডনে ১.৪ মিলিয়ন পাউন্ডের একটি বাড়িতে বাস করছিলেন। যেটির মালিক বাংলাদেশের অন্যতম ধনকুবের সালমান এফ রহমানের পরিবার। সালমান এফ রহমান শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ছিলেন।

এই সম্পত্তিটি একটি অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে মালিকানাধীন ছিল। যা অবশেষে সালমান এফ রহমানের ছেলের কাছে ফিরে আসে।

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং বলপূর্বক গুমের অভিযোগ রয়েছে। টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটিশ রাজনীতিতে প্রবেশের আগে দলটির মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেছিলেন। টিউলিপ সিদ্দিক শিক্ষা পরামর্শদাতা ক্রিশ্চিয়ান পার্সিকে বিয়ে করেছেন (৩৯)। তাদের দুটি সন্তান রয়েছে।

এই বিশেষ প্রতিবেদনটি গত ১০ আগস্ট যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইলে প্রকাশিত হয়েছে।