জাপানে নারী কূটনীতিককে যৌন হয়রানির বিচারে নতুন আশা

জাপানের বাংলাদেশ দূতাবাসে নারী সহকর্মীকে যৌন হয়রানির ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত চাপা পড়ে যাচ্ছে। ২০১৫ সালে কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভুত ওই ঘটনাটি ঘটলেও উপযুক্ত বিচার পাননি ভুক্তভোগী ওই নারী কূটনীতিক। অভিযোগ রয়েছে- আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেন অভিযুক্ত কূটনীতিক নূরে আলম। তবে বর্তমানে একজন পেশাদার কূটনীতিক অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হওয়ায় বিষয়টি ফের আলোচনায় উঠে এসেছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ২৮ জুন টোকিও মিশনে কাউন্সিলর ও হেড অব চ্যান্সারি পদে মোহাম্মদ নূরে আলম যোগ দেন। এরপর সেখানে আগে থেকেই কাজে নিয়োজিত থাকা ফার্স্ট সেক্রেটারি মঞ্জু মনোয়ারাকে নানাভাবে মানসিক নির্যাতন শুরু করেন। এ ব্যাপারে এর আগে নূরে আলমের বিরুদ্ধে ঢাকায় পররাষ্ট্র সচিবের কাছে অভিযোগ করেছেন মঞ্জু মনোয়ারা।

তিনি বলেন, ধারাবাহিকভাবে হয়রানির ঘটনায় আমার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন বিনষ্ট হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাকে গর্ভের যমজ সন্তানও হারাতে হয়েছে। লিখিত অভিযোগে বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলা হয়, নূরে আলম প্রথমদিকে বিভিন্ন ধরনের আদিখ্যেতা দেখানো কথা বলতেন এবং আশা করতেন যেন আমিও সে ধরনের কথা বলি। কিন্তু সাড়া না পেয়ে আমার ও আমার পরিবারের ওপর মানসিক নির্যাতন শুরু করেন। শুরুর দিকে একদিন অসুস্থতার জন্য অফিস শেষ হওয়ার আধা ঘণ্টা আগে ছুটি চাইলে নূরে আলম বলেন, ‘যাও যাও বাসায় গিয়ে ঘুমাও, তুমি তো আর আমার কাছে আসবা না?’ নূরে আলম ওই নারী কর্মকর্তার অসুস্থতাকে তাচ্ছিল্য করে বলেন, ‘যতদিন তুমি তোমার স্বামী পরিবর্তন না করবে, ততদিন কোনো ডাক্তারের ওষুধ তোমাকে সুস্থ করতে পারবে না’।

২০১৩ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ থেকে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল ‘মহুয়া পালা’ করতে টোকিও যায়। তখন সেই দলের দুই নারী সদস্য মঞ্জু মনোয়ারার বাসায় রাতে ছিলেন। তখন নূরে আলম বলেন, ‘আজ তো তোমার মহাবিপদ। মহুয়া সুন্দরী তার সখী নিয়ে তোমার বাসায় থাকবে। তোমার জামাই তো আর তোমার সাথে ঘুমাবে না।’ এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের এপ্রিলে ঢাকা থেকে নৃত্য নন্দন নামের আরেকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন টোকিও সফরে গেলে দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি তার বাসায় নারী সদস্যদের পরিবর্তে পুরুষ সদস্যদের থাকার ব্যবস্থা করেন। তখনো নূরে আলম বলেন, ‘মঞ্জু কি তোমার বাসায় মেয়েদের রাখা নিরাপদ মনে করছ না? নাকি এবার নিজের জন্য ব্যবস্থা করে নিলা?’ ২০১৩ সালের ৪ নভেম্বর দূতাবাসের একটি কাজে গাড়ি ব্যবহারের অনুমতি চাইলে নূরে আলম বলেন, ‘তুমি কি আমার ঘরের বউ নাকি যে তোমাকে আমার গাড়ি দেওয়া লাগবে?’

২০১৩ সালের ৭ ও ৮ মে রাষ্ট্রদূত দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি মঞ্জু মনোয়ারাকে একটি কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করতে বলেন। তখন ওই নারী কর্মকর্তা অন্তঃসত্ত্বা থাকায় রাষ্ট্রদূত দূতাবাসের স্টাফ কার ব্যবহারের জন্য নির্দেশ দেন। রাষ্ট্রদূতের নির্দেশ সত্ত্বেও হেড অব চ্যান্সারি নূরে আলম দূতাবাসের গাড়ি তাকে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, ‘তোমার জামাইয়ের তোমার ড্রাইভার হওয়া ছাড়া আর কী ঘোড়ার ডিমের কাজ আছে যে, তোমাকে নিয়ে যেতে পারে না’। এ সময় মঞ্জু মনোয়ারার স্বামী মোহাম্মদ সাব্বির আহমেদ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বিব্রত হন সাব্বির। এ অপমান সইতে পারেননি মঞ্জু। তার গর্ভে প্রচণ্ড ব্যথা হয় এবং তৎক্ষণাৎ গর্ভপাতও ঘটে। ওই দুর্ঘটনার পর দূতাবাস থেকে চিকিৎসা বিল পাওয়ার বিধান থাকলেও তাকে তা দেওয়া হয়নি। অথচ নূরে আলম দূতাবাসের খরচে তার ব্যক্তিগত ডিনারের বিলও পরিশোধ করতে চান।

চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি এমন একটি ডিনারের বিল স্বাক্ষর করতে মঞ্জুকে চাপ দেন নূরে আলম। স্বাক্ষরে অস্বীকৃতি জানালে নারী কর্মকর্তার উদ্দেশে অশ্রাব্য ভাষায় বলেন, ‘ওই খানে বসে আমি ... কী করতাছি!’ সর্বশেষ গত ১২ জুন মিশনের কমার্শিয়াল কাউন্সিলরের ফাইনান্সিয়াল নোটের ওপর পর্যবেক্ষণ পছন্দ না হলে নূরে আলম ওই নারী কর্মকর্তার উদ্দেশে বলেন, ‘ওরে আমি লাত্থি মেরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে ফেলে দেব’। এ সময় সেখানে দূতাবাসের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর হাসান আরিফও উপস্থিত ছিলেন। লিখিত অভিযোগে মঞ্জু মনোয়ারা বলেছেন, ‘সব মিলিয়ে আমি অত্যন্ত ভীত ও নিজেকে অনিরাপদ মনে করছি। এমন যৌন হয়রানির হুমকিতে আমি ও আমার স্বামী অত্যন্ত হতাশ। আর সন্তান হারানো সবচেয়ে বেশি কষ্টের।’

অভিযোগ প্রসঙ্গে মঞ্জু মনোয়ারার সঙ্গে জাপানে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। পরে তার স্বামী সাব্বির আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এসব ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন।

এদিকে মঞ্জু মনোয়ারার এ অভিযোগে ফুঁসে উঠেছেন পররাষ্ট্র ক্যাডারের নারী কর্মকর্তারা। সরকারি চাকরি ১৯৭৯-এর ২৭(বি) ধারা অনুসারে, ‘কোন নারী সহকর্মীর সঙ্গে যেকোন ধরনের অশালীন বাক্য উচ্চারণ করাও গুরুতর অপরাধের শামিল’ উল্লেখ করে তারা এর দ্রুত শাস্তি দাবি করেছেন।

মিশনে অবস্থানরত এক নারী কূটনীতিক দ্য মিরর এশিয়াকে বলেন, ‘আমরা নারী কর্মকর্তারা অনেক ত্যাগ স্বীকার করে দেশ ছেড়ে দূরে দায়িত্ব পালন করি। বছরের পর বছর দেশের জন্য বিদেশে অবস্থান করে কাজ করি। আমাদের যদি নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে কূটনৈতিক পেশায় নারীরা আসবে না।’

বিভিন্ন মিশনে দায়িত্ব পালন করে বর্তমানে ঢাকায় কর্মরত আরেক নারী কূটনীতিক বলেন, মিশনগুলোতে নারী হয়রানির অসংখ্য ঘটনা ঘটে। যেগুলো কেউ সামাজিক হয়রানির ভয়ে প্রকাশ করে না। আবার যে সাহস করে প্রকাশ করে, অন্যায়কারীরা জোটবদ্ধ হয়ে তার ক্ষতি করে। তাই ৯৯ শতাংশ ঘটনাই গোপন থাকে। এতে অন্যরা সাহস পায়। এ ধরনের ঘটনার বিচার হওয়া দরকার।

এদিকে, আওয়ামী আমলের অবসান হওয়ার পর দেশে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে কাজ শুরু করেছেন পেশাদার কূটনীতিক সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আশা করছেন, অতীতের যাবতীয় অনিয়ম-অপকর্ম আমলে নিয়ে এখানেও সংস্কার উদ্যোগ নেবেন সাবেক এই কূটনীতিক।