হারুনের হাজার কোটি টাকার সম্পদের উৎস কোথায়

হারুনের হাজার কোটি টাকার সম্পদের উৎস কোথায়

চাকরি জীবনের শুরু থেকেই নানা অনিয়ম, প্রতারণা ও উচ্ছৃঙ্খল কর্মকাণ্ডের কারণে সমালোচিত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ। ডিবি হারুন নামে অধিক পরিচিত এ পুলিশ কর্মকর্তা বছরের পর বছর অপরাধ করলেও কখনো শাস্তি পাননি। উল্টো পদোন্নতি পেয়ে বসেছেন পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ সব ইউনিটে।

নিয়োগ বাণিজ্য, নারী কেলেঙ্কারি, ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, জমি দখল, গুম, খুন, অর্থ পাচারসহ এমন কোনো অপরাধ নেই, যেখানে হারুনের নাম নেই। বছরের পর বছর অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। রাজধানীর উত্তরা, গাজীপুর ও কিশোরগঞ্জে হারুনের অন্তত হাজার কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে।

নামে-বেনামে অন্তত তিনটি রিসোর্টের মালিকানা আছে হারুনের। রয়েছে একাধিক আবাসিক হোটেল। আরো অন্তত ১০টি কোম্পানির মালিক তিনি। শুধু ঢাকায়ই আলিশান বাড়ি করেছেন দুই ডজনেরও বেশি। এর বাইরে আছে অর্ধশতাধিক প্লট ও ফ্ল্যাট।

রাজধানীর উত্তরায় হারুনের বহুতল একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট ও প্লটের তথ্য পাওয়া গেছে। ৩ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর রোডে (লেকপাড়ের রোডে) রয়েছে ‘পার্ক লেক ভিউ’ নামে ৬ তলা একটি আলিশান বাড়ি। এটি গেস্ট হাউস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একই রোডের মাথায় ৮ তলা আরেকটি বাড়িতে সপরিবারে থাকতেন তিনি। ৩ নম্বর সেক্টরের ৭ নম্বর রোডে ১০ কাঠা জায়গার ওপর হারুনের শ্বশুরের নামে একটি ১০ তলা মার্কেট। চার রাস্তার মোড়ে জমিসহ এই ভবনটির বাজারমূল্য শতকোটি টাকার বেশি। ১২ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডের ২১ নম্বরে ৬ তলা একটি বাড়ি বন্ধক রেখে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন হারুন।

১৩ নম্বর সেক্টরের শাহ মখদুম এভিনিউয়ে ১২ নম্বর প্লটটির মালিক হারুন। এখানে কয়েকটি দোকান ভাড়া দেওয়া আছে। একই সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডের ৭৯ নম্বর হোল্ডিংয়ের একটি প্লট জজ মিয়া নামের এক ব্যক্তির কাছে ভাড়া দেওয়া আছে। এছাড়া ৩ নম্বর সেক্টরে ১৫ নম্বর রোডের ২৩ নম্বর হোল্ডিংয়ে ১৪ তলা বাণিজ্যিক ভবন, ১৩ নম্বর সেক্টরে ৩ নম্বর রোডের ৪৯ নম্বর বাড়িতে ৬ তলা ভবন, ৩ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডের ১ নম্বর হোল্ডিংয়ে ৭ কাঠার বাণিজ্যিক প্লট, ১০ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর রোডের ৩৯ নম্বর হোল্ডিংয়ে ৫ কাঠার একটি প্লটের মালিক হারুন।

৫ নম্বর সেক্টরে ৬ নম্বর রোডে ২৯ ও ৩০ নম্বর হোল্ডিংয়ের ১০ কাঠার দুটি প্লটের একটিতে টিনশেড ঘর বানিয়ে ভাড়া দেওয়া এবং অন্যটি গোডাউন। ১৪ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর রোডের ১৭ ও ১৯ নম্বর প্লট চারটি কোম্পানির শোরুম হিসেবে ভাড়া দেওয়া। ১০ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ৪ নম্বর বাড়ির ৫ তলায় কথিত মামা জাহাঙ্গীরের অফিস। এই অফিসেই হারুনের সব সম্পত্তির কাগজপত্র রক্ষিত থাকে বলে জানিয়েছে জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ঠ সূত্র।

উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর প্লটটি হিরন নামে এক ব্যক্তির কাছে ৩২ কোটি টাকায় বিক্রি করেছেন হারুন। ৩ নম্বর সেক্টরের সাবেক ৯ নম্বর রোডে ৭ কাঠার ৪১ নম্বর প্লটটি মাসিক ১৪ লাখ টাকায় ভাড়া দেওয়া আছে। ১১ নম্বর সেক্টরে ৫ কাঠার আরেকটি প্লট ভাড়া দেওয়া আছে। এছাড়া ১৩ নম্বর সেক্টর, জম টাওয়ারের পাশে, উত্তরা থার্ড ফেইসে, পূর্বাচলে কয়েক ডজন ফ্ল্যাট রয়েছে হারুনের।

বনানী কবরস্থানের দক্ষিণ পাশে ২০ কাঠার প্লট দখল করে একটি কোম্পানির কাছে ৭০ কোটি টাকায় বিক্রি করেন হারুন। টঙ্গীর সাতাইশ মৌজায় ৮ বিঘা জমিতে কোনো অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ করা হচ্ছে ‘জেএইচ-জিওটেক্স লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

টঙ্গীর গুশুলিয়া মৌজায় ছায়াকুঞ্জ-৫ আবাসিক প্রকল্পের ভেতরে ১২ বিঘা জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে আবাসিক হোটেল। অভিযোগ রয়েছে, গাজীপুরের পুলিশ সুপার থাকার সময় ওই এলাকার ভূমিদস্যু কামরুজ্জামান ওরফে কামরুল ওরফে মাউচ্ছা কামরুলের সঙ্গে সখ্য ছিল হারুনের। কামরুলের ভূমিদস্যুতার রক্ষক ছিলেন এই পুলিশ সুপার। সম্প্রতি কামরুলের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানেও হারুনের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।

হারুনের ১০ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ৪ নম্বর বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী ইফাতুল বলেন, জাহাঙ্গীর সাহেব এখানে একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। দুই সপ্তাহ ধরে এখানে আসেন না। তার পরিবারের কেউ এখানে নেই।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে তার বৈধ আয়ের সঙ্গে সম্পদের পরিমাণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। দেশে-বিদেশে তিনি যে সম্পদ অর্জন করেছেন, সেটি দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে। ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন তিনি। তাকে সংবিধান পরিপন্থী অস্বাভাবিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। সেটি ব্যবহার করেই তিনি এই সম্পদ গড়েছেন। তার সঙ্গে অনেক যোগসাজশকারী ও সহায়তাকারী আছে। এখন এর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার এবং জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার।