হাজার কোটি টাকা পাচার, ভিয়েতনামে ব্যবসা-সম্পদ গড়েছেন একরাম

হাজার কোটি টাকা পাচার, ভিয়েতনামে ব্যবসা-সম্পদ গড়েছেন একরাম

নোয়াখালী-৪ আসনের সাবেক এমপি একরামুল করিম চৌধুরী। সদর ও সূবর্ণচর দুই উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনের দায়িত্বে থাকলেও গত ১৬ বছরে নিয়ন্ত্রণ করেছেন গোটা নোয়াখালী। একরামুল করিমের দুর্নীতি অনিয়ম জেলার মানুষের মুখে মুখে। টানা চারবারের এমপি থাকা অবস্থায় টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, চাঁদাবাজি থেকেই কামিয়েছেন কয়েক হাজার কোটি টাকা।

এছাড়াও পুরো নোয়াখালীতে নিজ বলয়ে গড়েছেন একাধিক বাহিনী। হাজার কোটি টাকার মালিক হলেও দেশে দৃশ্যমান বড় কোনো সম্পদ গড়েননি একরাম ও তার পরিবার। অনিয়মে আয় করা টাকা পাচার করেছেন বিদেশে। ভিয়েতনামে গড়েছেন ব্যবসা ও সম্পদ। একরাম থেকে সরাসরি জেলার প্রতিটি উন্নয়ন কাজের পার্সেন্টিজ পেতেন ওবায়দুল কাদের।  

স্থানীয়রা জানায়, ১৬ বছরে একরামুল করিম চৌধুরীর ইশারায় সব অপকর্ম চলতো এই শহরে। কোনো ভিন্নমতের জায়গা ছিল না। বরং বিরোধী মত দমন করে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করেন সাবেক এই এমপি। পাশাপাশি নিজের অবস্থান পোক্ত করতে পরিবারের সদস্যদেরও জেলা-উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে বসান। এছাড়া তাদের একাধিক ব্যক্তিকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধি বানিয়েছেন অনেকটা গায়ের জোরে।

শুধু টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেই কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন একরাম। নোয়াখালীতে যত সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার সবকটির ঠিকাদার ছিলেন তার নেতৃত্বে। যেসব কাজের টেন্ডার হতো সেখান থেকে কমপক্ষে পাঁচ শতাংশ কমিশন দিতে হতো সাবেক এই এমপিকে। এই কমিশনের পরিমাণ ১০ শতাংশ অবধি গিয়ে ঠেকতো কাজের ধরনভেদে। কিছু ক্ষেত্রে বেশিও নিয়েছেন একরাম।

পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর, এলজিইডি ও পিডব্লিউডি, ডিসি অফিস, বিএডিসির টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে একটি নিজস্ব বাহিনী তৈরি করেছেন। সেই বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছেন শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল ওয়াদুদ পিন্টু ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মাহমুদুর রহমান জাবেদ। পিন্টু জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদেও দায়িত্ব পালন করছেন।

এছাড়া সড়ক ও জনপথের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাওলা লিটন। এছাড়াও এখানে দায়িত্ব পালন করেন আবু তাহের ও জেলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক মোজাম্মেল হক মানিক নামের আরও দুই আওয়ামী লীগ নেতা। টেন্ডার নিয়ন্ত্রণের জন্য আগের মতো অস্ত্রবাজি বা গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে হুমকি-ধমকির প্রয়োজন না হলেও ই-টেন্ডারের এই যুগে অফিস ম্যানেজ করে কারসাজির মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বী ঠিকাদারদের ননরেসপনসিভ দেখিয়ে পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ দিতে কলকাঠি নিয়ন্ত্রণ করেন জাবেদ। এই অপকৌশলের বাইরে কিছু ঠিকাদার শিডিউল কিনলেও তাদের ফোনে ড্রপ করতে নিষেধ করা হয়।

যেকোনো কাজ দেওয়ার বিনিময়ে দলীয় ফান্ডের কথা বলে ঠিকাদারের কাছ থেকে নেয়া হয় ৬ পার্সেন্ট টাকা। আর নিজেদের নামে কাজ বের করে বিক্রি করলে জাবেদ ও পিন্টু নেন আরও ১০ পার্সেন্ট। মোট ১৬ পার্সেন্ট কমিশনের এই টাকার একটি বড় অংশ চলে যায় এমপি একরামুল করিমের কাছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য সাবেক এই এমপি নোয়াখালী জেলা সদর হাসপাতালের আরএমও ডা. সৈয়দ মহিউদ্দিন আবদুল আজীম প্রধান, সহকারী সুরুজ, জহির মোল্লাদের দিয়ে ওষুধ, হাসপাতাল সরঞ্জামাদি বাইরে বিক্রি করাতেন। সে সঙ্গে হাসপাতালের যত কেনাকাটা হতো তাও তাদের দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করাতেন। এছাড়া হাসপাতালের এই সিন্ডিকেটের সদস্যদের মাধ্যমে মেডিকেল সার্টিফিকেট বাণিজ্যও করাতেন সাবেক এমপি একরামুল।

টেন্ডারবাজির অন্যতম হোতা জাবেদ মামা বাহিনীর প্রধান হিসেবেও পরিচিত। তার বাহিনীতে রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। মামা বাহিনী নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিলেন জাবেদের কথিত ভাগ্নে রকি। টেন্ডারবাজির পাশাপাশি শহরে চলাচলকারী ১৩ হাজার সিএনজি থেকে নোয়াখালী সদরের বিভিন্ন স্থান থেকে মামা বাহিনী চাঁদা আদায় করতো। যদিও বিআরটিএর নিয়ম অনুযায়ী জেলা সদরে দুই হাজার সিএনজির রেজিস্ট্রেশন দিতে পারবে। কিন্তু সেখানে জাবেদ পিন্টু ও মানিকরা ক্ষমতা প্রয়োগ করে ১৩ হাজার রেজিস্ট্রেশন দেয়ার ব্যবস্থা করেন। অতিরিক্ত ১১ হাজার সিএনজি মালিকের কাছ থেকে ৬০ হাজার করে রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ আদায় হয়েছে। সিএনজির নিবন্ধন ও সড়কের চাঁদা থেকে মাসে শতকোটি টাকা আয় হতো। যার একটি ভাগ চলে যেত এমপি একরামের কাছে।  

সাবেক এই এমপির আয়ের আরেকটি বড় উৎস ছিল নিয়োগ বাণিজ্য। জেলা উপজেলায় যত সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ হয়েছে সেখান থেকে কমিশন দিতে হয়েছে। চাকরি না পেয়েও অনেককে টাকা দিতে হয়েছে। 

জানা যায়, পুলিশের নিয়োগে একরাম তার বাহিনীর মাধ্যমে কমিশন নিয়েছেন পাঁচ লাখ টাকা। গত ১৩ বছরে যতবার নিয়োগ হয়েছে ততবারই এই বাবদ কমিশন তাকে দিতে হয়েছে। এছাড়া নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পদে নিয়োগের বাবদও তিন লাখ টাকা করে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

একরামের ভাগ্নে কবিরহাট পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হক রায়হান। বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে এসে গত পনেরো বছরে তিনি কবিরহাট পৌরসভার মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সুযোগে গড়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। তার স্ত্রী ব্যবহার করেন প্রায় কোটি টাকা দামের গাড়ি। এই রায়হান কবিরহাট থানায় হামলার মামলার এক নম্বর আসামি।

স্থানীয়রা জানান, ২০১৪ সালের ৬ মার্চ গভীর রাতে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে আটকে রাখার খবর পেয়ে মদ্যপ অবস্থায় কবিরহাট থানায় হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয় মেয়র রায়হানের নেতৃত্বে। পরে ওবায়দুল কাদের ও একরামুলের প্রভাবে তিনি বেঁচে যান। কবিরহাট পৌরসভা যেখানে অনিয়মই, নিয়ম। রায়হান গত ১৩ বছরে বাজার ইজারা, টোল আদায়, সিএনজি স্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি অব্যাহত রাখেন তার অনুসারীদের দিয়ে।

অল্প দরে বাজার ইজারা দেখিয়ে নিজে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। একাধিক সূত্র জানায়, পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রায় তিন বছরের বেতন বকেয়া রয়েছে। কিন্তু প্রত্যেক সন্ধ্যায় তার আয়োজনে বসতো মদের আসর। গত ১৩ বছর আঁকড়ে ছিলেন কবিরহাট প্রেস ক্লাবের সভাপতি পদও। কবিরহাট উপজেলার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে ১০ পার্সেন্ট করে কমিশন আদায় করতেন।

অপরদিকে, অন্যায় অনিয়মে পিছিয়ে ছিলেন না মেয়রের আপন ছোট ভাই কবিরহাট পৌরসভা আওয়ামী লীগের সদস্য মামুনুল হক মামুন। চলতি বছরের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে একজন সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন। মামুন তার ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন সরকারি দফতরে করতেন তদবির।  অনেক অসহায় মানুষের থেকে সে হাতিয়ে নেন মোটা অঙ্কের অর্থ। কিন্তু অনেকের কাজ না হলেও তিনি আর টাকা ফেরত দেননি। অসহায় মানুষ ভয়ে মুখ খুলতে পারেনি। মেয়র পরিবারের দখলে রয়েছে কবিরহাট বাজারের অনেক খাস জায়গা।  

একরামুলের স্ত্রী ও কবিরহাট উপজেলা পরিষদের টানা তিনবারের চেয়ারম্যান। স্বামীর প্রভাব খাটিয়ে লুটে নিয়েছেন টিআর, কাবিখাসহ বিভিন্ন সরকারি বরাদ্দ। তার সরকারি বরাদ্দ আত্মসাতের বিষয়টি  কবিরহাট উপজেলায় ওপেন-সিক্রেট। এজন্য মাঝে মাঝে স্বামীকেও পাত্তা দিতেন না শিউলী। নিজের টাকায় জেলা শহর মাইজদীর বালুর মাঠ এলাকায় গড়ে তুলেছেন বহুতল ভবন।  

জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুর রহমান বলেন, গত ১৬ বছরে এমপি থাকা অবস্থায় একরামুল কবির পুরো নোয়াখালীবাসীকে জিম্মি করেন। আমাদের বিএনপির কয়েক হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে তিনি তার নিজস্ব বাহিনী দিয়ে আগলে রেখেছেন। অনিয়ম দুর্নীতির মধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ অর্থ আয় করেছেন।

হলফনামায় তার এমন সম্পদের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকার। ১০ বছরের ব্যবধানে তার সম্পদের পরিমাণ ফুলেফেঁপে উঠলেও কমেছে তার ব্যাংক ঋণের পরিমাণ। ২০১৮ সালের হলফনামায় তার ব্যাংক ঋণ ৪ কোটি ১০ লাখ ৭ হাজার ৫৩৯ টাকা উল্লেখ করা হয়েছে। আর ২০০৮ সালে তার হলফনামায় ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৮৫ লাখ ৩৯ হাজার ৭২০ টাকা। এছাড়া ২০১৮ সালে দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী একরামুলের অস্থাবর সম্পদের মূল্য ১ কোটি ৬০ লাখ ৯০ হাজার টাকা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে, একরামুল করিম চৌধুরী নিজ নামে দেখিয়েছেন ১ কোটি ৩০ লাখ ৫৬ হাজার ২৮০ টাকার কৃষি জমি, ১১ লাখ ২৯ হাজার টাকার অকৃষি জমি, ২৩ কোটি ৭৪ লাখ ৪৯ হাজার ১৪৫ টাকা মূল্যের ভবন, বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট এবং ১১ হাজার টাকার শেয়ার।

অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে একরামুল করিম চৌধুরীর ব্যাংকে জমা রয়েছে ২ কোটি ১৮ লাখ ৩৪ হাজার ৬৮৮ টাকা এবং সঞ্চয়পত্র রয়েছে ৮৩ লাখ ১৪ হাজার টাকার। এছাড়া ১ কোটি ৩৯ লাখ ৬৩ হাজার ২০২ টাকা মূল্যের গাড়ি, ৯৩ হাজার ৬০০ টাকা মূল্যের স্বর্ণ, ৩ লাখ টাকার ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, ৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা মূল্যের আসবাবপত্র এবং ৩ কোটি ১ লাখ ৪৮ হাজার ৬৮৮ টাকা ব্যবসায় পুঁজি রয়েছে বলে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়।

হলফনামায় একরাম ও তার পরিবারের সম্পদের পরিমাণ কম হলেও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তার বেশির ভাগ সম্পদই ভিয়েতনামে। দেশ থেকে পাচার করে সেখানে বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েন তিনি।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী-৪ আসন থেকে দলের মনোনয়ন পেয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতিতে দ্রুত নিজ বলয় গড়ে তুলেন। স্থানীয়রা জানান, ৭৩-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নৌকার প্রার্থী আবদুল মালেক উকিলের বিরুদ্ধে নির্বাচনে অংশ নেন একরামুলের বাবা ইদ্রিস মিয়া। বাবার পক্ষে নৌকার বিরুদ্ধে ভোট করা একরামুল স্বরূপে ফেরেন ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। তিনি নোয়াখালী-৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে নোয়াখালী-৫ আসনে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঘড়ি প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। ওই নির্বাচনে সেখানে দলের মনোনয়ন পেয়েছিলেন ওবায়দুল কাদের। কিন্তু বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের কাছে তাদের ভরাডুবি হয়। তখন হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে একরামুল করিম চৌধুরীর অনুসারীদের বিরুদ্ধে অন্তত এক ডজন মামলা করেন ওবায়দুল কাদেরের অনুসারীরা।