ভারত না জানিয়ে ব্যারেজ খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশে বন্যা ‘বিপর্যয়কর’: শেখ রোকন
বাংলাদেশে হঠাৎ করেই বেশ কয়েকটি জেলায় দেখা দিয়েছে বন্যা। যা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বৃহস্পতিবার সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে,‘ চলমান বন্যায় দেশের আট জেলায় ২৯ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মারা গেছেন অন্তত দুইজন।
আজ সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, সতর্কতা না দিয়ে বাঁধ খুলে দেওয়ার মাধ্যমে ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে। এদিকে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আজ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ভারতের ত্রিপুরায় ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে, বাংলাদেশে এমন একটি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। এটা বাস্তবে সঠিক নয়।‘
আর নদী গবেষক শেখ রোকনের মতে, সতর্ক না করে ড্যাম খুলে দেওয়ায় বাংলাদেশে প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ পায়নি। তাই হঠাৎ এ বন্যা বাংলাদেশের জন্য বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
নদী গবেষক শেখ রোকন ফেসবুকে লিখেছেন, সুনির্দিষ্টভাবে ডুম্বুর ও কলসি ড্যাম ও ব্যারাজের গেট খোলার তথ্য জানায়নি। ভারত যেটা জানিয়েছে, সেটা হলো বৃষ্টিপাত ও বন্যার তথ্য। অভিন্ন নদী অববাহিকায় বৃষ্টিপাত ও বন্যার তথ্য পরস্পরকে জানানোর বিষয়ে ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের চু্ক্তিও রয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের তথ্য চীন আমাদের জানিয়ে থাকে। আবার আত্রাই বা পুনর্ভবা নদী অববাহিকার দিনাজপুর বা ঠাকুরগাঁওয়ে অতিবর্ষণ বা বন্যা হলে আমরা ভারতকে সতর্ক করি, যাতে করে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর বা দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা প্রস্তুতি নিতে পারে। এ ক্ষেত্রেও ভারত ত্রিপুরায় অতিবৃষ্টিপাত ও বন্যার তথ্য জানিয়েছে।
তিনি বলেন, কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে ডুম্বুর ও কলসি ড্যাম ও ব্যারাজের গেট খোলার তথ্য জানায়নি। ভারতীয় পররাষ্ট্র বা আবহাওয়া দফতরও সেটা দাবি করেনি। এই যে ড্যাম বা ব্যারাজের গেট খোলার তথ্য জানায়নি, সেটাই বন্যাটিকে বিপর্যয়কর করে তুলেছে।
দ্য মিরর এশিয়ার পাঠকদের জন্য শেখ রোকনের বন্যা সংক্রান্ত ফেসবুক পোস্টটি তুলে ধরা হলো-
“বন্যা ও বেহুদা বিতর্ক। অনেকে ফেসবুক, ফোন, হোয়াটসঅ্যাপে, মেসেঞ্জারে নক করেছেন। সময়ের অভাবে সবাইকে একসাথে বলি- ভাইরে বা আপারে, বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করেন। অতিবৃষ্টি হলে বন্যা হয়; বন্যার পানি গড়িয়ে নিচে নামে, বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার মানে না; এটা তো যে কেউ জানে! এজন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। কুমিল্লার গোমতীর পানিতে যে ফেনীর মুহুরিতে বন্যা হবে না, সেটাও কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই বোঝা যায়। এসব নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। এখানে ভারত-বিরোধিতা বা ভারত-বন্ধুত্বেরও কিছু নেই। প্রশ্নটা অন্যত্র।
প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, গোমতী বা মুহুরীতে ভারতীয় ড্যাম বা ব্যারাজ আছে কি-না? উত্তর হচ্ছে, আছে। যারা বলছেন, মুহুরীতে ব্যারাজ নেই, তারা ভুল বলছেন। মুহুরী নদীতে দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার কলসিতে একটি ব্যারাজ রয়েছে। মুহুরী অববাহিকার উপনদীগুলোতেও রয়েছে একাধিক ড্যাম। না জেনে কথা না বলাই ভালো। এবারের অতিবৃষ্টির বন্যা যে ড্যাম-ব্যারাজ খোলার জন্যই বিপর্যয়কর হয়েছে, সেটা বোঝা যায় স্রোত দেখে। স্বাভাবিক বন্যার পানি নদীতে স্রোত তৈরি করতে পারে, মাঠে ও বসতিতে স্রোত তৈরি করার কোনো কারণ নেই। এবারের বন্যা কতটা বিপর্যয়কর হয়েছে, পানি নেমে যাওয়ার পর আরও বেশি বোঝা যাবে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, গোমতীর ডুম্বুর ড্যাম বা মুহুরীর কলসি ব্যারাজ থেকে পানি ছাড়ার আগে উজানের দেশ ভারত ভাটির দেশ বাংলাদেশকে আগাম সতর্ক করেছিল কি-না? উত্তর হচ্ছে, করেনি। এটা ঠিক, বৃষ্টিপাত ও বন্যার আগাম তথ্য বাংলাদেশকে জানিয়ে থাকে। কিন্তু ডুম্বুর-কলসি ব্যারাজ বা ড্যাম খুলে দেওয়ার তথ্য বাংলাদেশকে জানায়নি।
তৃতীয় প্রশ্ন, না জানিয়ে ড্যাম বা ব্যারাজ খুলে দিলে কী অসুবিধা? বন্যা তো এমনিতেই হচ্ছে। স্বাভাবিক বন্যা হতেই পারে, তাতে খুব একটা অসুবিধা নেই। কিন্তু যখন হঠাৎ ড্যাম বা ব্যারাজ খুলে দেওয়া হয়, তখন সেই বন্যা বিপর্যয়কর হতে বাধ্য। স্বাভাবিক বন্যায় হয়তো তিন দিন ধরে পানি বাড়ে ও চলে যায়। কিন্তু ড্যাম বা ব্যারাজ খুলে দিলে তিন দিনের বন্যা তিন ঘণ্টার ঘনত্বে চলে আসে। আর যদি ভাটির দেশকে না জানিয়ে ব্যারাজ ছাড়া হয়, তাহলে বন্যা মোকাবিলার প্রস্তুতি ও দুর্গতদের উদ্ধার তৎপরতার সময়ও থাকে না। জান ও মালের ক্ষতি অনেক বেশি হয়। এবার সেটাই ঘটেছে।
চতুর্থ প্রশ্ন, না জানিয়ে ড্যাম-ব্যারাজ খুলে দেওয়ার জন্য যৌথ নদী কমিশনে বাংলাদেশ পক্ষ কি ভারতীয় পক্ষের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে? উত্তর, সম্ভবত না। সেজন্যই আমি বলেছিলাম, যৌথ নদী কমিশন ঘুমাচ্ছে কি-না?
পঞ্চম প্রশ্ন, তাহলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আবহাওয়া বিভাগ ‘তথ্য জানানোর কথা’ বলছে কেন? লেখাটি ফেসবুকে দেওয়ার পর অনেকে ফোনে ও হোয়াটসঅ্যাপে জানতে চেয়েছেন। এখানে কমেন্টও করেছেন। আমার বক্তব্য হলো, ভারত যেটা জানিয়েছে, সেটা হলো বৃষ্টিপাত ও বন্যার তথ্য। আবারও বলছি ‘বৃষ্টিপাত ও বন্যার তথ্য’। অভিন্ন নদী অববাহিকায় বৃষ্টিপাত ও বন্যার তথ্য পরস্পরকে জানানোর বিষয়ে ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের চু্ক্তিও রয়েছে। যেমন ব্রহ্মপুত্রের তথ্য চীন আমাদের জানিয়ে থাকে। যেমন আত্রাই বা পুর্নভবা নদী অববাহিকার দিনাজপুর বা ঠাকুরগাঁওয়ে অতিবর্ষণ বা বন্যা হলে আমরা ভারতকে সতর্ক করি; যাতে করে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর বা দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা প্রস্তুতি নিতে পারে। এই ক্ষেত্রেও ভারত ত্রিপুরায় অতিবৃষ্টিপাত ও বন্যার তথ্য জানিয়েছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন ছিল, সুনির্দিষ্টভাবে ডুম্বুর ও কলসি ড্যাম ও ব্যারাজের গেইট খোলার তথ্য কি ভারত জানিয়েছিল? উত্তর হচ্ছে, না। ভারতীয় পররাষ্ট্র বা আবহাওয়া দপ্তরও সেটা দাবি করেনি। এই যে ড্যাম বা ব্যারাজের গেইট খোলার তথ্য জানায়নি, সেটাই বন্যাটিকে বিপর্যয়কর করে তুলেছে।
এ ধরনের ইস্যুতে আমি ফেসবুকে সংক্ষেপে লেখার পক্ষে নই। কারণ ছোট করে লিখে পরে ব্যাখ্যা বড় করতে করতে অনেক সময় চলে যায়। আর আমাদের যাদের খেটে খেতে হয়, তাদের অঢেল সময় থাকে না। তারপরও বিতর্ক স্বাগত; কিন্তু না জেনে বেহুদা বিতর্ক সেই মূল্যবান সময়ের অপচয় ছাড়া কিছু নয়। বেহুদা বিতর্ক বাদ দিয়ে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ান। সবাইকে নদীময় শুভেচ্ছা।”