হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার ভারতীয় নীতি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে

চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বসে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুর সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। বিএনপির এই নেতা দলটির পররাষ্ট্র বিষয়ক সেলের প্রধানের দায়িত্বও পালন করছেন।

আমীর খসরু বলেছেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতের নীতি ‘সম্পূর্ণ ব্যর্থ’ হয়েছে। দুই দেশের সম্পর্ক কিছু প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। যাদের মধ্যে ছিলেন ​​অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক ও সাংবাদিকরাও। যারা রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে অনুভব না করেই নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের মানুষের আবেগ ও আকাঙ্ক্ষাকে উপলব্ধি করার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির এই নেতা। তিনি বলেছেন, গত এক দশকে যে তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেগুলোর প্রত্যেকটিই ছিল পাতানো। আর এর পেছনে ভারতের সমর্থন ছিল।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন একটি আবহ তৈরি করা হয়েছিল যে, শেখ হাসিনা ছাড়া এই দেশ মৌলবাদীদের কাছে চলে যাবে। হাসিনা না থাকলে ভারতের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। ভারতকে এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এই সত্য তিতা হলেও দিল্লীকে তা মেনে নেওয়া উচিত। আমীর খসরু সতর্ক করে বলেছেন, ভারত যদি তার অবস্থান না বদলায় তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে কয়েক বছর সময় লেগে যাবে।

আমীর খসরু বলেন, শেখ হাসিনার সরকারের শেষ দিনগুলোতে বাংলাদেশ যে রক্তপাত দেখেছে তা ‘অবশ্যই’ এড়ানো যেত যদি চলতি বছরের জানুয়ারিতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতো। যেভাবে ভারত জানুয়ারির নির্বাচনের ফলাফলকে স্বীকৃতি দিয়েছে তাতে হতাশা প্রকাশ করেছেন আমীর খসরু। ওই নির্বাচনকে সম্পূর্ণ জালিয়াতপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন।

রাজনৈতিক অচলাবস্থা

২০০৯ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের জয়ের পর বাংলাদেশে কার্যত রাজনৈতিক অচলাবস্থা বিরাজ করেছে। বিএনপি বরাবরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এসেছে। তাতে ভ্রুক্ষেপ করেনি আওয়ামী লীগ।

২০১৪ সালে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে নির্বাচন বর্জন করেছিল। ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনেও বিএনপি তার অবস্থান ধরে রাখে।

আমীর খসরু অভিযোগ করেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক অচলাবস্থা মোকাবিলা করার জন্য ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় আসেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হাসিনা এবং বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠক করেছিলেন। সুজাতা সিং সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টি নেতা প্রয়াত হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদকে নির্বাচনে আনতে দেনদরবার করেন। সুজাতা সিং তাকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার একরকম বাধ্য করেছিলেন।

আমীর খসরু এ প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিকে আমরা কী বলতে পারি, যেখানে স্পষ্ট একটি বানোয়াট ও লোক দেখানো নির্বাচন হবে এবং সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এরশাদকে বাধ্য করেছিলেন। এরশাদ ওই নির্বাচনে অংশ নিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। উল্টো তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধ্য করে ২০১৪ সালের ওই নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ এটা পছন্দ করেনি।’

তিনি বলেন, ‘ভারত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে বারবার আওয়ামী লীগ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাস্তবে তিনটি নির্বাচনের পেছনেই ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করেছে তারা। আমি সরাসরিই বলছি। এটাই সত্য। গত তিনটি নির্বাচনে ঠিক এমনটিই হয়েছে এবং এটি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে কঠিন বাস্তবতায় নিয়ে গেছে।’

আমীর খসরু আরও স্পষ্ট করেছেন যে, বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গ্রুপ ভূমিকা রেখেছে। তাদের মধ্যে প্রভাবশালী বেসামরিক কর্মকর্তা, অর্থাৎ অবসরপ্রাপ্ত আমলারা ছিলেন নীতিবৃত্তে। তাদের সঙ্গে সাংবাদিক ও একটি আদর্শবাদীরা জড়িত ছিলেন। যারা সম্ভবত ব্যক্তিগতভাবে লাভবানও হয়েছেন। তাদের নিয়ে আমীর খসরু বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের মানসিকতা বোঝার জন্য তারা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।’

বিএনপির এই নেতা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাংলাদেশের আন্দোলনকারীদের জন্য তার উদ্বেগের জন্য প্রশংসা করেছেন। তিনি এই বলে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন যে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর তিনি শুনছেন যে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের নীতি কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমি চেষ্টা করেছি। আমি ভারতে গিয়েছি, অনেক কথা বলেছি। কিন্তু শেখ হাসিনার ওপরই ভরসা রাখতে চেয়েছে; যে হাসিনা একা মৌলবাদকে দমন করে চলবে। কিন্তু হাসিনার পতনের পর আমি কিছু পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। যার নেতৃত্ব দিচ্ছে ভারতীয় নাগরিক সমাজ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও যুক্তিসঙ্গত অবস্থান নিয়েছেন।’